বৈধ-অবৈধের বেসাতির বলয়
Share on:
সত্য-মিথ্যা, বৈধ-অবৈধ, সাদা-কালোর বিষয়টি বর্তমান সময় ও সমাজে এমন এক পর্যায়ে এসেছে, যা এখন আর উচ্চকণ্ঠ-নিচকণ্ঠের ব্যাপার নয়, এটি মূল্যবোধে একটি দড়ি টানাটানির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
সত্য-মিথ্যা আলো ও অন্ধকারের মতো। সত্য সুন্দর। মিথ্যা অসুন্দর, অন্ধকারের সমতুল্য। আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য সাধারণ দৃষ্টিতে সহজে বোঝা গেলেও প্রকৃতপক্ষে এর সীমারেখা বাছ-বিচার করা কঠিন। কারণ মিথ্যার আবরণ সরিয়ে সত্যকে বের করতে হয়। আবার সত্যকে মিথ্যার প্রলেপ প্রলোভন থেকে মুক্ত রাখতে হবে। উভয় প্রকার কাজও দুঃসাধ্য এ জন্য যে, সত্যকে আত্মসাৎ করতে মিথ্যার প্রচেষ্টার অন্ত নেই। অন্ধকারও দ্রুত ধাবমান আলোকে গ্রাস করার চেষ্টা করে। আলো স্থায়ী কিন্তু তাকে ক্ষণস্থায়ী করতে চলে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। দেশ কাল পাত্র ভেদে সবাইকে সত্য ও মিথ্যা আলো-অন্ধকারের এ অবিরাম বোঝা-পড়াকে উপলব্ধি করতে হয়। মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দ উভয় প্রকার প্রবণতা সবসময় কার্যকর। ভালো প্রবণতা যদি মন্দ প্রবণতার চেয়ে জোরদার হয়, শক্তিশালী হয়, তাহলে তার দ্বারা ভালোর বিকাশ ও বিজয় সূচিত হয়। আবার মন্দ প্রবণতা যদি ভালো প্রবণতাকে পরাজিত করতে পারে, অতিক্রম করে, তাহলে ভালোর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মিথ্যার ভূমিধস বিজয় ঘটে। মানুষের মনের মধ্যে ভালোর প্রতি আগ্রহ যেমন আছে; মন্দের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতাও রয়েছে। এ প্রবণতা বা ইচ্ছার প্রতিনিয়ত ইন্ধন জোগাচ্ছে সেরা কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান এবং শয়তানরূপী জাতীয় ও ভূরাজনীতির ভায়রা ভাইয়েরা। সুতরাং জাতীয় জীবন সাধনার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত ভালোর প্রতি আগ্রহ ও আকাক্সক্ষাকে দৃঢ় করা, সত্যের প্রতি একাগ্র হওয়া এবং মিথ্যা অসত্য অসুন্দর থেকে দূরে থাকতে বিশেষ পথ-পন্থা ও কৌশল অবলম্বন করা।
বিষয়টির সাথে সিয়াম সাধনার তাৎপর্য অর্জনের উপায় উপলক্ষকে উপলব্ধির আওতায় আনা যায়। একজন রোজাদার তার আচার-আচরণে বিশ্বাস ও বয়ানে এমন হবেন যেন তার মধ্যে সত্য ও সুন্দরের প্রকাশ ঘটে। একজন রোজাদার ব্যক্তির চিন্তায় ও কাজে প্রকৃত রোজাদারের পরিচয় থাকা চাই। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, রোজাদার ব্যক্তির মধ্য যদি রোজার আগের আচার-আচরণ বিরাজ করে তা হলে রোজা রাখা শুধু উপবাস থাকার সমতুল্য হয়ে যায়। রোজাদার যদি মানসিকতায় রোজাদার না হয় তা হলে রোজা পালনের সার্থকতা নেই। মিথ্যা পরিহার, খারাপ ইচ্ছা পরিহার, খারাপ ইচ্ছা দমন, অন্যায়-অনিয়মকে প্রশ্রয় না দেয়াসহ সব ব্যাপারে ও বিষয়ে একজন রোজাদারের মধ্যে যথার্থ পরিবর্তন যদি না আসে তাহলে তার রোজা পালন নিছক অভিনয়ের তুল্য হয়ে দাঁড়ায়। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার গ্রহণে বিরত থাকাটা রোজা পালনের জন্য যথেষ্ট নয়, চিন্তায় ও কাজে, চলাফেরায়, দৃষ্টিপাতে, আলাপ-ব্যবহারে সব ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া সিয়াম সাধনার শর্ত।
বলা বাহুল্য, সত্য-মিথ্যা, বৈধ-অবৈধ, সাদা-কালোর বিষয়টি বর্তমান সময় ও সমাজে এমন এক পর্যায়ে এসেছে, যা এখন আর উচ্চকণ্ঠ-নিচকণ্ঠের ব্যাপার নয়, এটি মূল্যবোধে একটি দড়ি টানাটানির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন রঙের বাহারে বানানো টাকাকে কালো টাকা সাব্যস্ত করার বিধিবিধান নিয়ে টকশোতে ঝাল-মিষ্টির মহরত চলছে। আদি ও অকৃত্রিম রঙ সাদা-কালোকে নিয়ে, আদি বৈধতার আকাক্সক্ষা এবং অবৈধতার বিজয় প্রতিষ্ঠার মাতামাতি ভালোই চলছে। অথচ সবাই মেনে নিচ্ছেন যে, সাদার বিপরীতে কালোকেই যেন মানায় ভালো- যেমন দিন ও রাত, যেমন- ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, আনন্দ ও সর্বনাশ। একের উপস্থিতি অন্যের অনুপস্থিতিকে অনিবার্য করে তোলে। হয় তুমি না হয় আমি, এ ধরনের একটি বাধাবাধির ব্যাপার আর কী! কিন্তু গণতন্ত্রে যে উভয়ের দরকার।
‘খোলা আকাশ কি এত ভালো লাগত যদি কিছু কিছু মেঘ নাহি ঢাকত’ এটি শুধু সন্ধ্যা মুখার্জির সুরেলা কণ্ঠের কথা নয়- চাঁদে কলঙ্ক থাকবে, এটি সাংবিধানিক সত্যের মতো ধরে নিতে হচ্ছে, নিন্দার কাঁটা না বিঁধলে নাকি প্রেমের সাধ পূর্ণ হয় না। সত্যম শিবম সুন্দরের বাগ-বাগিচায় দু’-একটি আগাছা কিংবা নামহীন-গোত্রহীন ফুলের পদচারণা মেনে নেয়ার গত্যন্তর দেখা যায় না। তবে এ ভাবাভাবির অবকাশে অগোচরে অনেক অকল্যাণ হুড়মুড় করে ঢুকে যে শ্বেতশুভ্র রজনীগন্ধার গায়ে অসংখ্য অসময়ের রেণু স্পর্শ করেছে সকাল বিকাল, তার খোঁজখবর বনমালীর নেই। রাখার ফুরসতও মিলছে না। সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজের অপমান আপাদমস্তক নিজেকে নতজানু পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যায়-অনিয়ম আর অবাধ্যতারা বসার কথা বলে বনমালীর ঘরে যে শোবার এন্তেজাম করছে, এদিকে বনমালীর মন নেই।
দূর প্রাচ্যে, সাতসাগর আর তেরো নদীর পাড়ে, ফুলে ফুলে শোভিত এক স্বপ্নরাজ্যে এ দেশের এক দুধকুমার একবার হঠাৎ করে বিস্তর নগদ এনাম লাভ করলেন। সেই দেশের এমন নিয়ম যে, তিনি এ টাকা নিয়ে যেখানে যাবেন সেখানে প্রশ্ন পাবেন ‘ইহা ভাই আপনি কোথায় পাইলেন?’ এ প্রশ্নে দুধকুমারের লা জবাব অবস্থা দেখে অনেকে মজা পেলেন। এর কোনো জবাব তার মগজে নেই। অগত্যা তিনি একটি সিন্দুক কিনলেন, এ সিন্দুক তার ঘরে উঠানোর সুযোগও সীমিত। কেননা, সে দেশে বাসগৃহে কেউ বড় সিন্দুক ব্যবহার করে না, হাজার বছর আগে এর চল উঠে গেছে। কেননা, ছেঁচড়া চোর, হাতসাফাই- এ জাতীয় বদ খাসলতদিগকে সেখানে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। সবই আমানতদারের জিম্মায় রাখার বিধান চালু রয়েছে। অগত্যা দুধকুমার বিদেশী বাড়ির জানালা কেটে তার ঘরে সিন্দুক প্রবেশ করালেন এবং যথারীতি তথায় যাবতীয় নগদের নিবাস নির্ধারণ করলেন। দুধকুমারের ভাগ্য ভালো সেই দেশে দস্যুতায় দুর্দান্ত সম্রাটের পুত্ররা নেই। নইলে এর সব তাদের জিম্মায় চলে যেতে বিলম্ব হতো না। সেই দেশে এমন নিয়ম যে, একটি আস্ত গাড়ি মাগনা দিলেও কেউ নিতে চায় না, কেননা সেই গাড়ির লাইসেন্স, রুট পারমিট, ইন্স্যুরেন্সের দাবি মেটাতে মেটাতে এবং এর মালিকানা লাভের হলফনামা রচনায় চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারের অবকাশ ঘটে যাবে। সেই দেশে পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সুশাসনের মন্ত্র পড়িয়ে পদ্ধতি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়েনি।
বঙ্কিমবাবু আগের শতাব্দীর লোক ছিলেন। ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। কপালকুণ্ডলার আঁকিয়ে ছিলেন। ‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ -এ প্রশ্ন নিজের কাছে সে সময় সতত রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। কখনো ভাবেননি তার ভাবীকালের ভাতিজারা ‘তুমি অধম তাই আমিও অধমের মতো আচরণে অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছি’ বলে বিবৃতি দিতেও বিব্রত বোধ করেন না; বরং এরূপ বিবৃতি দেয়া যেন ‘হাইব্রিড নেতা হিসেবে বাহবা লভিবে তুমি এই সোনার ভুবনে’। বঙ্কিমবাবু হয়তো ভাবেননি তার প্রপৌত্ররা ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করিছে গমনের’ প্যারোডি সাজিয়ো ‘যাহারা গিয়াছে গোল্লায়’ আমরা তাহাদের টেক্কা দিয়া ‘দেখাইমু ওরে আঁরাও কম না’। ভাবখানা এই- খোকা বোতল ভেঙেছে সুতরাং ‘বোতল ভাঙার গানকে জাতীয়করণ করো- খোকা অধিকতর উদ্যমে বোতল ভাঙিতে উদ্বুদ্ধ হইবে।’
প্রায় শতবর্ষ আগে রবিবাবু নামে মশহুর এক কবি ভেবেছিলেন ‘অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে’। তার শতবর্ষ পরে বাবু মশায় বেঁচে থাকলে ঠিক দেখতে পেতেন এখন দোষীকে দিগম্বর করা নয়; বরং আঁচলের তলায় রেখে গরুর খাঁটি দুধ ও দেশী কলা খাওয়ানো হচ্ছে। চৌর্যবৃত্তিতে পটুরা মাশতুতো বা খালাতো ভাই কিংবা ফাস্ট কাজিনের মতো আত্মীয়তা পাতিয়ে “মুই এর বাড়ি বরিশাল তোমার বাড়ি ঘোড়াশাল আমাদের মধ্যে কত মিল- জাতীয় হেঁয়ালি সঙ্গীত লাফাইয়া দাপাইয়া ঘাঁটাইয়া মাঠাইয়া চলছে।’ শুধু ভালোবাসাবিহীন ‘সত্য’ জানালা দিয়া নহে, ‘ভদ্রতা’ও বিনা টিকিটে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া নদী সাগর পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে অমুক তমুকের দেশে। মাথায় বিস্তর টাক নিয়ে চুল সংরক্ষণের ফতোয়া দিচ্ছেন বাঁশের চেয়েও প্রলম্বিত ‘প্রতি’ ভাবানরা। ‘উপ’দের উপদেশে আসলদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। বর্ণচোরাদের বন্যায় ত্যাগী ও নিবেদিতরা হালে পানি পাচ্ছেন না। পানি ও তেল, দুধ ও ঘি এক দেহে লীন হয়ে একে অপরকে টেক্কা মেরে বহালতবিয়তে থাকছে। থাকার উপায়-উপলক্ষের অভাব নেই, কাজির খাতাতেও হিসাব অফিসের খাতায় হিসাব রাখার বালাই নেই; একের মাশোহারা অন্যরা লইয়া যাইতেছে এবং দফতরবিহীনদের মিছিল লম্বা হইতেছে। মুহূর্তের মধ্যে অজানা বস্তায় কাঁঠাল গজাইতেছে। বায়োস্কোপের মতো একটির পর একটি ঘটনা ও রটনা আসিয়া চাল ডাল হইতেছে, গাছ মাছ হইতেছে, নদী খাল হইতেছে, ভবন সদন হইতেছে’।
চৌরাস্তায় গোলাপ মিয়া দাঘিয়ে দাঁত মাজছিল, হঠাৎ সাদা সরদার এসে বলল, ‘আমাদের বৈঠকখানায় আসিও পিড়া দিব বসিতে’ ও পাড়ার মেয়ে নীল নীলাঞ্জনা এসে বলল, ‘দাদা আমাদের দহলিজে আসিয়া চিড়ামুড়ি খাইবেন’। নিরপেক্ষ বেচারা গোলাপ মিয়া। কারো ডাকে তার সাড়া দেযার ইচ্ছা নেই। কিন্তু ইচ্ছা তাকে করতে হবে নইলে তাকে উভয়পক্ষের বাদি-বিবাদির মালা পরিয়ে সন্ন্যাসী সাজানো হবে, বানানো হবে ‘অজ্ঞাত সংখ্যক’দের একজন। গোলাপ মিয়াদের সুদিন সুখ্যাতি এখন সাদা-কালোর সুতায় প্যাঁচাইয়া, আকাশের যত তারা তত ধারায় লটকিয়ে কাশিমবাজার কুঠি থেকে কাশিমপুরে পাঠাবার প্রজ্ঞাপন হচ্ছে হরহামেশা। কালো সাদাকে পেটে পুরে, গোলাপকে আত্মসাৎ করে বেমালুম সগৌরবে সবার সামনে দিয়ে চলাচল করছে। গুণকীর্তনে বাদ সাধা হচ্ছে বলে রাধারা আর কাউকে নাচতেও দিচ্ছে না। কেউ অন্ন চাইলে কলা চুরির কেচ্ছা শুনিয়ে, সঙ্গীত সন্ধ্যা সকালের আমন্ত্রণে চালানো হচ্ছে। এটি যেন বিকালে ভোরের ফুল সাদা-কালোর মালতী মাধুরীর পথে যাত্রা। শোক সামলিয়ে সত্য যথা তথায় সমাহিত হচ্ছে।