মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: সোমবার ১২, অগাস্ট ২০২৪

সমাজ ও অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নে বিভাজনের দেয়াল টপকাতে হবে

Share on:

মতৈক্য আর মতানৈক্যের মাঝখানে বিভেদের যে দেয়াল সে দেয়াল ভালো ও মন্দ উভয়েরই জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করে। ভালোকে ভালো থাকতে না দেয়া আর মন্দকে আরো মন্দ হতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে এই সঙ্কটের সুনাম সুবিদিত।


উভয় সঙ্কটে পড়ে শুভ চিন্তারা শুভ উদ্যোগের পাড়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়েন। আর নানান ধরনের অশুভ আচার-আচরণ পাড়া মাত করে ফেরে। ষোল শতকের ব্রিটিশ বণিক ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা স্যার টমাস গ্রেশাম (১৫১৯-১৫৭৯) অনেক বুঝেশুনে এই অবস্থাকে ইধফ সড়হবু ফৎরাব ধধিু মড়ড়ফ সড়হবু ভৎড়স ঃযব সধৎশবঃ বলে বর্ণনা করেছেন। ভালো আর মন্দকে একসাথে এক পাড়ায় বসবাস করতে দিয়ে ভালোর আলোয় মন্দকে কলুষমুক্ত হতে সাহায্য করা যেখানে উচিত; সেখানে ভালোকে পত্রপাঠ মাঠ থেকে সাজঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ওয়াকওভারের পরিবেশ সৃষ্টি করা আর্থসামাজিক উন্নয়ন সঙ্কট সৃষ্টির উপাদেয় উপায়।

সমাজ ও অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন এবং অগ্রগতির অভীপ্সা আকাঙ্খাক্ষায় সব পক্ষ ও অনুষঙ্গকে নিরবচ্ছিন্ন নিঃশর্ত ঐকমত্যে পৌঁছানোর তাগিদে সবাইকে বিচ্যুতির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তির অবয়বে আসার অবকাশ রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়ন ভাবনায় সমন্বিত উদ্যোগের প্রেরণা ও মতবাদ হিসেবে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি (Financial inclusion) তথা সার্বিক সামাজিক অন্তর্ভুক্তির (Social Integration) দর্শন যার বাঞ্ছিত বিকাশের জন্যই রাজনীতির মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এই নিরিখে স্থান-কাল-পাত্রের পর্যায় ও অবস্থান ভেদে উন্নয়ন এবং উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করার প্রেরণা হিসেবে অন্তর্ভুক্তিকরণ এর দর্শন। অনেক উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় নেতৃত্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে অন্তর্ভুক্তির চেতনা গোটা দেশবাসীকে ভাববন্ধনে আবদ্ধকরণের উপায় ও উপলক্ষ হিসেবে দেখাতে চাইছেন। দারিদ্র্য নিরসন থেকে শুরু করে সমাজে সম্পদের বণ্টন বৈষম্য দূরীকরণ এবং এমনকি সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সবাইকে দল-মত-ধর্ম-লিঙ্গ অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে এক সামিয়ানার নিচে সামিল করতে অন্তর্ভুক্তিকরণকে মন্ত্র হিসেবে মানতে ও মানাতে আগ্রহ উদ্যোগের অভাব থাকতে নেই।

এ কথা বলা বাহুল্য যে, জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস-প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে থাকা চাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান। অপচয় অপব্যয় রোধ ও দুর্নীতি দমন, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এ জন্য সবার মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ ও সর্বোপরি সুশাসন, সদাচারের প্রতি একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলব্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে উঠে যে নিষ্ঠা ও আকাক্সক্ষা, তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন ত্যাগ স্বীকারের। নেতিবাচক মনোভাবের দ্বারা এবং দায়-দায়িত্ব পালন ছাড়া গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতা মাত্র। ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ কথাটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য এ জন্য যে, উৎপাদনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেই ফসলের অধিক অধিকার প্রত্যাশী হওয়াটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কর্ম ও ধর্ম নয়। কোনো কিছু অর্জনে বর্জন বা ত্যাগ স্বীকার যেমন জরুরি, তেমনি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বাস্তবতা এ জানান দেয় যে, ‘বিনা দুঃখে সুখ লাভ হয় কি মহিতে?’ ন্যায়নীতিনির্ভর, নিরপেক্ষ কাণ্ডজ্ঞানের বিকাশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অর্থবহ ও কার্যকর উপস্থিতির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।

মানবসম্পদ সৃষ্টি, গণ সুস্বাস্থ্যতা আর আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার সরোবরে উন্নয়ন অর্থনীতির ফুল বিকশিত হয়। যে সমাজে রাজনীতি, শিক্ষকতা, চিকিৎসা আর আইন ব্যবসায় মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ দিনে দিনে তিরোহিত হয়, সে সমাজে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও সমাজসেবার আদর্শ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেখানে সামাজিক সুবিচার ও গণকল্যাণ আকাক্সক্ষায় চিড় ধরতে বাধ্য। সুশাসন ও জবাবদিহিতার পরিবেশ পয়মাল হতে হতে সমূহ সর্বনাশ এবং সহনশীল হয়ে ওঠে।

পরীক্ষায় উত্তরণ-নির্ভর বিদ্যাচর্চায় বাস্তব শিক্ষার লেশমাত্র যে থাকে না সে উপলব্ধি করতে রূঢ় বাস্তবের মোকাবেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়লেই দেশে শিক্ষার উন্নতিসহ জনসম্পদ বৃদ্ধি ঘটে না; বরং তাতে স্বল্পশিক্ষিত বেকারের বিকারজনিত সমস্যারই উদ্ভব ঘটে। অসম্পন্ন শিক্ষা সমাধান আনে না; বরং সমস্যা বাড়ায়। শিক্ষা খাতে জিডিপির সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ মিললেও শিক্ষা জনসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে কি না, দেশের অধিকাংশ অধিবাস যে পল্লীতে সেই পল্লীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে শহরের হাইব্রিড বিদ্যাচর্চার ব্যবধান বাড়ছে কি না সে বিচার-বিবেচনা আবশ্যক।

যে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের করের টাকায় বেতন পান, তার বিনিময়ে তার যে দায়িত্ব পালনের কথা তা পালন না করে; বরং তার শিক্ষকতার পরিচয়কে পুঁজি করে অত্যধিক পারিশ্রমিকে কোচিং ব্যবসার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারই শুধু করেন না, গণশিক্ষার ব্যয় বাড়িয়ে চলেন। সমাজের কাছে যে সম্মান ও সমীহ তার প্রাপ্য তা তার এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে দ্রবীভূত হয়ে যায়। অথচ এই একই সমাজে এই কিছুদিন আগেও এমনকি ঔপনিবেশিক পরাধীন পরিবেশেও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে (তখন সরকারি অনুদান ছিল যৎসামান্য) শিক্ষাদান ছিল নিঃস্বার্থ জ্ঞানদানের বিষয় এবং আত্মত্যাগের আদর্শে ভাস্বর।

আর সে সুবাদে শিক্ষক পেতেন সমাজের সর্বোচ্চ সমীহ ও সম্মান। শিক্ষক দায়িত্ববোধের আদর্শ হতেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালানোকে ব্রত মনে করতেন শিক্ষকরা। আর আজ শিক্ষকের মনের দৈন্যতা অধিক অর্থ উপার্জনের অভীপ্সায় অন্তর্লীন। বিভেদ-বিভাজনে রাজনীতিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, পেশাজীবী এমনকি নির্বাহী ও বিচার বিভাগ ব্যাধিগ্রস্ত হলে সুষম উন্নয়ন অর্থবহ হয় না, হতে পারে না।

চিকিৎসা বিদ্যার প্রধান লক্ষ্যই যেখানে হওয়ার কথা দুস্থ পীড়িত জনকে রোগমুক্তির সন্ধান দেয়া সেখানে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কেন মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে এ মহৎ পেশায়। অসুস্থ ব্যক্তির উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়া যেখানে মৌলিক অধিকার সেখানে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা এতই নাজুক ও অবহেলায় ন্যুব্জ যে, ক্লিনিকের কসাইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে অগণিত অসহায় অসুস্থ মানুষকে। এনজিও দ্বারা কমিউনিটি চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে- সেখানে হাসিমুখে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে নবীন-প্রবীণ স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু সরকার পরিচালিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কেন সেবার মান আদৌ উন্নত হবে না, যদিও সেখানে বাজেটের বিপুল বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় দেখানো হয়ে থাকে। জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাজেটে বিপুল ব্যয় বরাদ্দ দেখানো হবে আর সেই সেবা পাওয়ার জন্য আবার বাড়তি ব্যয়ের বোঝা কেন বহন করতে হবে রাষ্ট্রের নাগরিককে।

অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার প্রার্থীর পক্ষাবলম্বনের জন্য আইনজীবী হবেন আসামি বাদি-বিবাদির বন্ধু। আইনের মারপ্যাঁচে নিজের ন্যায্য দাবি যাতে হারিয়ে না যায় সে সহায়তা চেয়েই তো অসহায় অশিক্ষিত মক্কেল আসে আইনজীবীর কাছে। নিজের পেশাগত দায়িত্ব ও মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্রেফ ব্যবসায়িক ও বিভাজিত দৃষ্টিতে বাদি-বিবাদি উভয় পক্ষের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অনুক্ষণ অনুযোগ বিচারপ্রার্থীর বোবাকান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশ ও সমাজের স্বার্থকে থোড়াই কেয়ার করে অনেকে বিদেশী বহুমুখী কোম্পানির অনেক অন্যায্য দাবির সপক্ষে লবিং করেন স্রেফ পেশাগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থে। ‘সেবা পরম ধর্ম’ কিংবা ‘সততা সর্বোত্তম পন্থা’-এ মহাজন বাক্যেরা কি শুধু নীতিকাহিনীতে ঠাঁই পাবে, বাস্তবে তাদের সাক্ষাৎ মিলবে না?

রাষ্ট্রাচারে বিধিবিধান অনুসরণ যেহেতু দায়িত্ব ও কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে সেহেতু রাষ্ট্র্র ও নাগরিক উভয় পক্ষেরই পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক স্বার্থে বিষয়টি অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগের মতো। রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সেবার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করবে এবং এর জন্য নাগরিক রাষ্ট্রকে পাথেয় পরিশোধ করবে। রাষ্ট্র ধারকর্জ করে নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করলে কৃতজ্ঞ নাগরিক পাথেয় পরিশোধ করবে, না নাগরিক আগে পাথেয় পরিশোধ করলে রাষ্ট্র সুযোগ-সুবিধা তৈরিতে হাত দেবে? কোনটি আগে?

যেকোনো ক্ষেত্রেই সৃষ্ট জটিলতা, অসম্পূর্ণতা, অস্বচ্ছতা পুরো পরিবেশটিকে প্রশ্নবোধক করে তুলতে পারে। পাথেয় তথা রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় অনুপ্রেরণা প্রদায়ক সহজ সাবলীল ব্যবস্থা যেমন থাকা দরকার, আবার সে সহজীয় সুযোগের অসদ্ব্যবহার যাতে না হয় তা নিশ্চিতকরণার্থে প্রতিবিধানের ব্যবস্থাও থাকা দরকার। করদাতা যাতে হয়রানির শিকার হয়ে নিরুৎসাহিত না হন এটি দেখাও যেমন জরুরি, তেমনি কর প্রদান এড়িয়ে চলার বা ফাঁকিজুকি দিয়ে পার পাওয়ার প্রতিরোধাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি। জবাবদিহিতার পরিবেশে নাগরিকের সব মৌলিক অধিকার ও দাবি পূরণে রাষ্ট্রের স্বচ্ছতাসুলভ আচরণ ও সেবা সুনিশ্চিত হয়। সেবা প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হলে পাথেয় পরিশোধের পালে বাতাস বইবে- পারস্পরিক বিচ্যুতিতে নয়, বিভেদের দেয়াল টপকিয়ে অন্তর্ভুক্তির সরোবরে ফুটুক সাফল্যের শাপলা।

দৈনিক নয়াদিগন্ত