মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২১, সেপ্টেম্বর ২০২৪

ষড়ন্ত্রের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে দেশের ‘পোশাক শিল্প’

Share on:

৫ আগস্ট স্বৈরশাসক পতন হওয়ার পর নতুন সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পরই দাবি আদায়ের হিড়িক দেখা যায়। সবাই নিজ নিজ দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে পড়ে। যারা বিগত ১৫ বছর স্বৈরশাসকের শাসনামলে কোন দাবি উত্থাপন করেননি, তারাও এখন দাবি উত্থাপন করছেন।


কারও ন্যায্য অধিকার দাবি করা অন্যায় কিছু না। কিন্তু স্বৈরশাসকের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্যে দেশের ওষুধ ও পোশাক শিল্পের শ্রমিকদেরকে সংঘাতের পথে ঠেলে দেয়া ষড়যন্ত্রেরই অংশ।

পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য এর আগেও দেশী ও বিদেশী গোষ্ঠীরা ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। এবার আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়ে ওষুধ ও পোশাক শিল্প খাতের রপ্তানির আদেশ যেন ব্যাহত হয়, অন্যদেশে যেন চলে যায় সে জন্য পরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালাচ্ছে। অথচ তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির পক্ষে যে কেউ কথা বলতো তাকে দেশদ্রোহী কিংবা দেশ বিরোধী অপশক্তির তকমা দেয়া হতো। শ্রমিকেরা ন্যায্য অধিকারটুকু দাবি করতে পারতো না। কথা বললেই গলা চেপে ধরত। এখন সময় এসেছে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করার। মানুষে মানুষের বৈষম্য বিতাড়িত করে ইনসাফ জাগ্রত করার। আমরা আশা করবো নতুন সরকার দেশের সকল মানুষের চাওয়া ও পাওয়াকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাধান্য দিবেন, যেন ১৫ বছর ধরে যারা জুলুম নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তারা যেন অপরাধীর বিচার দেখে স্তস্তির নিঃশ্বাসটুকু ফেলতে পারে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী সরকার বিদায় নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস দেশের স্বার্থে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১৫ বছরের অন্যায় জুলুম আর নিপীড়নের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের পোশাক খাতকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে অকার্যকর ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য শ্রমিকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রমিকদের ভূমিকা কোন অংশেই কম নয়। তারা মজুরির বিনিময়ে কাজ করলেও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার স্বার্থে দিন রাত পরিশ্রম করে। অথচ তাদের ভাগ্যে ন্যায্য মজুরিটুকু জোটে না। যখনই তারা ন্যায্য মজুরির দাবিতে সোচ্চায় হয় তখনই তাদের উপর নিপীড়নের খড়গ নেমে আসতো। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হতো। আওয়ামী সরকারের শাসনামলে ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের (বিজিআইডব্লিউএফ) গাজীপুর শাখার সভাপতি শহিদুল ইসলাম পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন আদায়ের চেষ্টা করলে হামলায় নিহত হন। একই বছরে অক্টোবর-নবেম্বরে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলনের সময় আরও অন্তত চারজন পোশাকশ্রমিক নিহত হন। (সূত্র : প্রথম আলো ১ মে ২০২৩) আমরা প্রতিটি হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই। কিন্তু এখন দাবি আদায়ের নামে যা হচ্ছে তার সিংহভাগই ষড়যন্ত্রের ফসল। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাটের গুরুদের বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা করতে না পারলে দেশের পুরো পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়। দেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তু সংঘাত সহিংসতা বিরাজ করলে অর্থনীতির বারোটা বেজে যায়। ওষুধ ও পোশাক শিল্পের শ্রমিক ভাই-বোনদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে সবাই। কিন্তু ন্যায্যতার কথা বলে, দাবি আদায়ের কথা বলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া অপরাধ। দেশের ওষুধ ও পোশাক শিল্প কেবল অর্থনীতির মেরুদন্ডই নয়; লাখ লাখ পরিবারের জীবনরেখা। হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর মানুষ কথা বলা শুরু করেছে। এর আগে স্বাধীনভাবে মানুষ কথা বলতেও ভয় পেত। মিথ্যা কথা বলা রীতিতে পরিণত হয়েছিল। সত্য কথা বলা অপরাধ ছিল। ফলে ১৬ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ মানুষ প্রকাশ করছে। এ ক্ষোভ যেন দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস না করে দেয়। মালিকপক্ষ ধুয়া তুলসিপাতা। আর শ্রমিকরা সবাই খারাপ তা কিন্তু না; মালিক-শ্রমিক একে অপরের পরিপূরক। শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনার দায়িত্ব মালিকপক্ষের। মালিকপক্ষ এতদিন কেন এই বৈষম্য জিইয়ে রেখেছিল তাও রাষ্ট্রের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। স্বৈরশাসক পালিয়ে যাওয়ার পর অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে হঠাৎ করে কেন গন্ডগোল দেখা দিল তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। হাসিনা সরকার পতনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে সাভারের আশুলিয়ায় শিল্পাঞ্চলে ২১৯টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, টিফিন বিল বৃদ্ধি, বেতনসহ, সমানুপাতিকহারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে অনির্দিষ্টকালে জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ১৩৩টি কারখানা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। পোশাক শিল্প কারখানা হামলা ভাঙচুর করার পেছনে বিজিএমই, বিকেএমইএতে আওয়ামী ঘরনার নেতারা জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা নতুন না; বহু পুরাতন ঘটনা। নিকট অতীতে যখন শ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছিল তখন আওয়ামী সরকার শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায়নি; উল্টো তাঁদেরকে পুলিশ দিয়ে শায়েস্তা করেছে। দেশের শত্রু হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। আগে যতগুলো শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে অধিকাংশই সুনির্দিষ্ট দাবির প্রেক্ষিতে ছিল। কিন্তু এবার সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাবনা নেই। একেক কারখানার শ্রমিকরা একেক ধরনের দাবি উত্থাপন করছে। অথচ বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে এমন যুক্তিহীন ও পরিকল্পনাহীন দাবি দাওয়া উত্থাপিত হয়নি। এবারের শ্রমিক বিক্ষোভের আন্দোলনে যে রাজনৈতিক ইন্ধন আছে তা পরিষ্কারভাবেই বুঝা যায়। পোশাক শিল্প খাত ব্যতিত দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে ওষুধ ও পোশাকশিল্পখাত কার্যত অচল। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণেও এমটি উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন- প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আমরা এই অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করছি। আমাদের উদ্যোগে সাড়াও পাচ্ছি। ঠিক এই সময়ে আমাদের শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে, অকার্যকর হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত পড়বে। সেটা কিছুতেই কারো কাম্য হতে পারে না। শ্রমিক ভাইবোনদের অনেক দুঃখ আছে। কিন্ত সেই দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে আপনাদের মূল জীবিকাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সেটা ঠিক হবে না। দেশের অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে সেটা ঠিক হবে না। মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের সাথে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান আমরা অবশ্যই করব। আপনারা কারখানা খোলা রাখুন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখুন। দেশের অর্থনীতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিন। আমরা আপনাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান বের করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করব। মালিক পক্ষের কাছে আমাদের আবেদন, আপনারা শ্রমিকদের সাথে বোঝাপড়া করুন। কারখানা সচল রাখুন। ওষুধ শিল্প এবং তৈরি পোশাক শিল্প দেশের গৌরব। এর মাধ্যমে আমাদের শ্রমিক ভাইবোনেরা ও তাদের কর্মকুশলতা বিশ^কে মুগ্ধ করেছে। এর সাফল্য এখন থমকে আছে। আমরা দুই শিল্পকে তাদের সম্ভাব্য শীর্ষে নিয়ে যেতে চায়। দুর্বল করার তো প্রশ্ন উঠেই না। এই দুই শিল্পের কোথায় কোথায় বাধা আাছে, সমস্যা আছে সেগুলো চিহ্নিত করে তাকে বাধামুক্ত করতে চাই। আমরা বিদেশী ক্রেতাদের একত্র করে তাদের সহযোগীতা চাইব যেন বাংলাদেশের এই শিল্প দুটি বিশে^র অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি যোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে পারে। সব কিছুই সম্ভব যদি আমরা শ্রমিক মালিক সর্ম্পকটা একটা নির্ভরযোগ্য ও আনন্দদায়ক করে গড়ে তুলতে পারি। আমাদের সরকারের প্রথম মাস কাটল। দ্বিতীয় মাস থেকে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি হিসেবে নতুন শ্রমিক মালিক সম্পর্কের সূচনা করতে চাই। এটা দেশের সবারই কাম্য।

পোশাক শিল্পের সাথে ওষুধ শিল্পে ও অরাজকতা চলছে। শ্রমিকদের নানা দাবির মুখে কারখানার মালিক ও কর্মকর্তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। আন্দোলন ও ভাঙচুরের ঘটনায় দেশের ওষুধ বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। কারখানার উৎপাদন কাযর্ত ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কোন এক সময় কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের যাত্রা পঞ্চাশের দশকের দিকে। বাংলাদেশ ওষুধের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকার ওষুধ বিশে^র বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। ২০২২ সালে দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ৬ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকার ওষুধপণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু লাগাতর ধর্মঘট ও ভাঙচুর এ খাতকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের ওষুধ শিল্প খাতে গত ৫০ বছরে এ ধরনের কোনো শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়নি। তাহলে হঠাৎ করে এখন কেন অসন্তোষ বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে সব পক্ষের উচিত দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করা। কারখানার মালিক, শ্রমিকপক্ষ-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সরকারের মধ্যে খোলামোলা আলোচনার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র থেকে ওষুধ ও পোশাক শিল্পখাতকে রক্ষা করা প্রয়োজন।

দৈনিক সংগ্রাম