শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ৮, অগাস্ট ২০২৪

মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ এবং প্রজন্মের নতুন বাংলাদেশ

Share on:

৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের রাত। পাড়ার দুই শ্রমজীবী মানুষের আড্ডার সংলাপ কানে এলো, ‘তুই তো দেশের মাটিত কবর হওয়ার সুযোগটাও একেবারে হারালু রে। তুই দ্যাশ ছাড়লু ক্যা?’ এমন ভাষা দেশবাসী শুনেছিল বীর আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পরে। এরা যেন সেই একই মায়ের ছাও, যে মা বলেছিল, ‘হামার ব্যাটাক মারলু ক্যানে।’


আমাদের ছেলেদের মারলে কেন ফরিয়াদ থেকে শেখ হাসিনা স্বৈরাচারের পতন হয়। পতন এরশাদ স্বৈরাচারেরও হয়েছিল। সেই স্বৈরাচার কিন্তু দেশ ছাড়েনি। ইনি ছেড়েছেন। কারণ নিজের অপরাধের ভয়াবহতা তিনি জানতেন। মানুষ তাঁকে কোনোভাবেই ক্ষমা করত না, করবেও না। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যেখানে গেলেন, সেই ঠিকানা তাঁর রাজনৈতিক মৃত্যু নিশ্চিত করে দিল। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন ঠিকই বলেছেন, পালিয়ে গিয়ে তিনি তাঁর দলের সর্বনাশ করে গেলেন।

২০০৬ সালে খালেদা জিয়াও সেনা সমর্থিত সরকারের পথ করে দিতে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু গণভিত্তি ছিল বলে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়নি। তিনি জেলবাস করেছেন। বিদেশে নির্বাসন নিতে অস্বীকার করেছেন। শেখ হাসিনাও জেলে গিয়েছিলেন জরুরি অবস্থার সময়। আবার আপসের মাধ্যমে ক্ষমতায়ও বসে গেছেন।

খালেদা জিয়ার দেশের মাটিতে জেলবাস ছিল সাহসের ব্যাপার। ঘটনাটা তাঁর অনুসারীদের এই বার্তা দিয়েছিল যে, আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি। তোমাদের যা হবে আমারও তা-ই হবে। তিনি দেশে ছিলেন বলেই বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা সফল হয়নি। এদিকে শেখ হাসিনা নিজের পাপে দলের সব পুঁজি-পাট্টা খেয়ে ফেললেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রহসনের পরে বলেছিলাম, আওয়ামী লীগের মুসলিম লীগে পরিণত হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। কথাটা সত্য প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হওয়ার সময় মুসলিম লীগ ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রিয় দল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দলটিকে পাকিস্তানের স্বাধীনতার নেতৃত্বের গৌরব দিয়েছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন সেই পাকিস্তানের জাতির পিতা। সেই দলটিই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কারণে তৎকালীন বাংলাদেশে অজনপ্রিয় হয়ে পড়ল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে দলটার রাজনৈতিক কবর খোঁড়া হয়ে গেল। বিপুল জনপ্রিয়তা থেকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মুসলিম লীগের ঔরসে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগও মুসলিম লীগের পরিণতি পাচ্ছে।

পরপর তিনটি অবৈধ ‘নির্বাচন’ করে আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। একের পর এক বিপজ্জনক ষড়যন্ত্র, লাগাতার লুটপাট, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ হাসিনা দলটিকে লুটেরা ও খুনিদের আখড়া বানিয়ে ফেলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতার দলটি চলে গিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেরও বিপক্ষে।

তথ্যভিত্তিক গবেষণা দেখায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে সহিংস দলটি হলো আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুল ইসলাম। গবেষণাপত্রটি দেখিয়েছে, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংঘটিত মোট রাজনৈতিক সহিংসতার ৩০.২ শতাংশ ঘটনায় আওয়ামী লীগ জড়িত ছিল। ৩৭.৭ শতাংশ লোক এসব সহিংসতায় আহত হয়েছেন। একইভাবে মোট প্রাণহানির ২২.৩ শতাংশ হয় আওয়ামী সহিংসতায়। অন্যদিকে বিএনপির ভাগ ছিল কম, ২৫.২ শতাংশ। তাদের কারণে আহত ও নিহতের অনুপাতও কম, যথাক্রমে ৩৪.৩ ও ১৫.৬ শতাংশ (দেখুন, প্রতিচিন্তা, জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা, ২০২২)।

এই পরিসংখ্যান কেবল প্রকাশিত ও সরকারস্বীকৃত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত। পিলখানায় সেনা অফিসার হত্যা, শাপলা চত্বরে চালানো হত্যাকাণ্ড এবং আয়নাঘরের বীভৎসতা পুরোপুরি জানা গেলে, ক্রসফায়ার ও গুমের হিসাব যোগ করলে আওয়ামী লীগের সহিংসতার ভয়াবহ মাত্রাটা ধরা পড়বে। গত এক মাসে ছাত্রজনতার ওপর যে বর্বর হত্যালীলা চালানো হয়েছে, উঠতি তরুণরা কি কোনো দিন তা ভুলতে পারবে? ঘরের শিশুদের মনে পর্যন্ত ট্রমা তৈরি করেছে তারা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই জুলাই বিপ্লবের স্মৃতি ও শেখ হাসিনার নৃশংসতা মনে রাখবে।

দুই.

বাংলাদেশ দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়েছে। প্রথমবার যাদের নেতৃত্বে জয় এসেছিল, দ্বিতীয়বার তা হওয়ার নয়। পুরোনো বন্ধু এখন শত্রুর ভূমিকায়। পুরোনো বাংলাদেশকেও বদলে দিচ্ছে ছাত্র-তরুণরা। দ্বিদলীয় নাগরদোলার বাইরে নতুন রাজনৈতিক গন্তব্য তৈরি হচ্ছে। পরিবারতন্ত্রের বাইরে আসতে চায় এই বাংলাদেশ। তরুণরা শুধু শেখ হাসিনার বিদায়ই চায়নি, তারা চেয়েছে ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ’। যাতে আর কেউ রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণের প্রভু সেজে বসতে না পারে, দেশটাকে বিক্রি করে দিতে না পারে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কী হবে। পুরোনো রাজনৈতিক ধারার লোকেরা এবং এমনকি আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া লোকেরা তিন মাসের বেশি সময় দিতে চায় না। এর পরে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হলেও তারা খুশি। ২০০৬ সাল থেকে বিএনপি কোণঠাসা ও নির্যাতিত। দলটির অনেক নেতাই নিহত কিংবা বয়োবৃদ্ধ। বিএনপির হারানো স্বাস্থ্য ও মেজাজ ফিরে পেতে সময় লাগবে। এই দল ভোটে জিততে পারলেও, অপুষ্ট ও দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ। কেননা বিতাড়িত শক্তির মাথাটা বিদেশে থাকলেও লেজ দেশের ভেতরে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই রয়ে গেছে। তাদের হাতে এখনও বিপুল অস্ত্র এবং লুটপাটে অর্জিত পাহাড়প্রমাণ সম্পদ রয়েছে। এর সঙ্গে বিদেশি মদদও রয়েছে। সব মিলিয়ে দুর্বল সরকারকে তারা সহসাই কাবু করে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারতেও পারে। বুদ্ধিমানের কাজ হবে, সময় নিয়ে দল ও চিন্তাভাবনা গুছিয়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হওয়া। প্রিম্যাচিউর বেবির অনেক জটিলতা হয়ে থাকে। বিপ্লবের শিশুকে প্রিম্যাচিউর অবস্থায় ভূমিষ্ঠ করানো হবে চরম অদূরদর্শিতা।

ফ্যাসিবাদের অবশেষ পরিষ্কার করার জন্য, রাষ্ট্র মেরামতের জন্য এবং বিভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে ঠিক লক্ষ্যে ফেরানোর জন্য সময় প্রয়োজন। সময় প্রয়োজন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্যও। বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক তৈরির জন্যও সময় দরকার। যে ছাত্রসমাজ এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়েছে, সময় পেলে তারা আরও বিকশিত হবে। নতুন প্রশাসনেও তাদের অনেকে মেধার ভিত্তিতে স্থান পাবে। সংবাদমাধ্যমকে দলদাসের ভূমিকা থেকে স্বাধীন ভূমিকায় আনতে হবে। এই সব কিছুর জন্য সময় প্রয়োজন।

গতকালের চাইতে আজ পরিস্থিতি অনেক ভালো হয়েছে অনেক দিকেই। বিজয়ের উদ্বেলতার মধ্যে এবং তার সুযোগে কিছু খারাপ জিনিস ঘটেছে। এগুলি দেখা যায়। কিন্তু দেখার আড়ালে অনেক কিছু ঘটছে। সংগ্রাম ও ষড়যন্ত্র থেমে নাই। আশার কথা হলো, এক দিনেই পরিস্থিতির উন্নতি দৃশ্যমান হয়েছে। সন্দেহবাদীদের ছদ্মবেশে রেজিমের ছারপোকাদের কূটচাল শাহীনের মতো ধরে ফেলতে পারতে হবে। রাজপথ ছাড়ার সময় তাই আসেনি।

বিএনপি বহুদিন পর রাজপথে নিজেদের হাজিরানার জানান দিচ্ছে। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে তাদের ত্যাগস্বীকার যতটা, সফলতা ততটা নাই। আজকের সফলতা কেবল এক দিন বা এক মাসের সংগ্রামের ফল না। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ১৫-১৬ বছরের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে দেশের অনেকেই শামিল ছিল, শুধু বিএনপি নয়। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি রাজপথ দখলে রেখে, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বজায় রেখে, ক্ষমতার দণ্ডটাকে নিজের হাতে আনতে চায়, সেই তড়িঘড়ির ফল তাদের জন্যও ভালো হবে না, দেশের জন্যও না। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কায়দা আর বাংলাদেশ নেবে না।

যেনতেন সরকার না, ছাত্রজনতার বিপ্লবের বিশ্বস্ত অভিভাবক হবে, কঠিন কাজগুলি দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবে; তেমন অন্তর্বর্তী সরকার আমরা চাই। রাষ্ট্র মেরামত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার জন্য ন্যূনতম দীর্ঘ সময় এবং সকল দেশপ্রেমী অংশের সমঝোতার মাধ্যমে একে শক্তিশালী ম্যান্ডেট দিতে হবে। আবার জনগণের কাছে জবাবদিহিও নিশ্চিত করার উপায় থাকা লাগবে। আলাপ-আলোচনা ও জনগণের মুক্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে। সেই সংবিধান যেন হয় গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, মানবিক মর্যাদা ও জাতীয় স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। তার অধীনেই কেবল একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাতে যদি মুসলিম লীগে পরিণত হওয়া আওয়ামী লীগও অংশ নিতে চায়, নেবে। আমরা কোনো দলকেই নিষিদ্ধের পক্ষপাতী হতে পারি না।

দৈনিক সমকাল