বিপ্লবের বীজধান এবং শহীদদের আত্মকথা!
Share on:
বাংলাদেশের মাটি উর্বর। কারণ শত শত বছর ধরে এখানে বারবার গণহত্যা হয়েছে। দুর্ভিক্ষেও মারা গেছে কোটি কোটি লোক। সেইসব অগণিত লাশ মাটিতে মিশে গিয়ে মাতৃভূমির বুকে নাইট্রোজেনের জোগান বাড়িয়ে গেছে। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধে ইউরোপের বিভিন্ন ময়দানে হাজারো মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। পরে দেখা গেছে, ওইসব যুদ্ধের মাঠের মাটি ব্যাপক উর্বর। কী মর্মান্তিক এ উর্বরতা!
এই দেশে জীবিত মানুষ গুম হয়েছে। এই দেশে নাম-ঠিকানা-ওয়ারিশঅলা মানুষেরা গণকবরে গুম হয়ে আছে। তাহলে কী বদলালাম আমরা? একাত্তরে ভ্যানের ওপর স্তূপ করা লাশ আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে শুনিনি। কিন্তু ২০২৪-এর দীর্ঘ জুলাইয়ে সেই ভয়াবহতা ঘটেছে। একাত্তরেও গণকবরে চাপা দিয়ে বেওয়ারিশ করে দেওয়া হয়েছিল অনেক মানুষকে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে পারিনি; কিন্তু বেওয়ারিশ করে দেওয়া তো ঠেকাতে পারি এখনও। এখনও লাশগুলো তুলে ডিএনএ টেস্ট করে পরিবারের হাতে ফিরিয়ে দিতে পারি। যাতে একটা কবর হয়, যাতে তাদের মা-বাবা-ভাই-বোন কবরটার পাশে বসে বুকের খাঁ খাঁ শূন্যতা শোক দিয়ে হলেও ভরাতে পারে। না হলে আমৃত্যু বুকের ভেতর শহীদ স্বজনের কবর বয়ে বেড়াতে হবে। সে বড় দুঃসহ। অন্যরা হয়তো মানে, কিন্তু যার যায় সে-ই শুধু জানে।
আমরা তো মুক্ত হয়েছি। আমরা তো আর স্বজনের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পাব না। তাহলে কেন পত্রিকার শিরোনাম হয় ‘পরিচয়হীন ১০৪ অভাগা!’ এই সংখ্যা আসলে কত, তা-ও জানার সুযোগ দিনকে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে অনেক দিক সামলাতে হচ্ছে। ঘরের শত্রু বিভীষণ, জাতির শত্রু মীর জাফরদের ছল ও ছুতার কারবার খেয়াল রাখতে হচ্ছে। কিন্তু যদি বেওয়ারিশদের স্মৃতির ওয়ারিশান আমরা না হই, তাহলে বিবেকের কাছে কী জবাব দেব? কী শপথ তাহলে আমরা করলাম, যদি এখনও আন্দোলনে গুলি খাওয়া স্বামীর চিকিৎসার টাকা জোগাতে সন্তানকে বিক্রি করে দিতে হয় কোনো মাকে– দেশের মুখ ছোটো হয়ে যায় না? লাখো ছাত্রছাত্রীর মধ্যে অনেকেই এখনও হাসপাতালে, অনেকে পঙ্গু। দৃষ্টি হারিয়েছে চারশতেরও বেশি মানুষ। ১৮ হাজার আহত মানুষের বেশির অংশটাই তো শ্রমজীবী।
এবং এই আন্দোলন কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল না। রংপুরের গ্রামের ছেলে আবু সাঈদের মৃত্যু যেভাবে সারাদেশকে জাগিয়ে দিয়েছিল, আর কোনো মফস্বলি প্রতিরোধ এভাবে জাতির হৃদয়ের মণিকোঠাকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল কি? সারাদেশের রিকশাচালকেরা যেভাবে সহযোগী বাহিনী হয়ে উঠেছিল, সেটা কি বিদ্রোহী ব্যাকরণের শক্তিধর এক সূত্র আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয় না?
এই দেশের রিকশাচালক থেকে শ্রমিক-কৃষকেরা অদ্ভুত এক প্রজাতির মানুষ। নিজের ছেলেমেয়েকে পড়াতে পারছেন কিনা তার ঠিক নাই, অথচ ছাত্রদের বুকে গুলি লাগলে তারা সহ্য করতে পারেন না। দীনহীন রোগাভোগা মানুষদের মধ্যে তখন যেন ঘুমন্ত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার জেগে ওঠে। তারা তখন প্রতিশোধ নেন। ১৯৫২ থেকে ২০২৪ এটাই দেখেছি আমরা। ২০০৬ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লা খনিবিরোধী আন্দোলনে ৩ কিশোর নিহত হয়েছিল। নিজের চোখে দেখেছি সেই দৃশ্য। একটা কৃষক জনপদ, একটা ধানের রাজধানী কী যে বিপুল তেজস্ক্রিয় আবেগে বিস্ফোরিত হয়েছিল! বেশ কিছুদিন প্রশাসন ওই এলাকায় ঢুকবার সাহস পায়নি। আর এখন আনুমানিক ১৬শ মানুষকে হত্যা করা হলো– হয়তো আরও গায়েব করা লাশের শুমার করা বাকি আছে– বাংলাদেশ ফেটে পড়ল। তারপরও সব আহত চিকিৎসা পেল না, সব বেওয়ারিশ যথাযোগ্য জানাজা ও সৎকার পেল না, পেল না কবর কিংবা দাহ হওয়ার সুযোগ।
যদি এটাই হয়, তাহলে এক মায়ের বেওয়ারিশ ছেলেটার ভাইয়ের হাহাকারই সত্য হবে। এটা একটা স্লোভেনীয় কবি দানে জাইছের কবিতা। সেই দেশেও যুদ্ধ হয়েছিল, সেই দেশেও বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার হচ্ছিল অনেক অনেক দিন পরে! ছেলেটা বলছিল, ‘তোরে মনে পড়ে ভাই!’
তোরে মনে পড়ে ভাই
মায়ে কয়, আমি তার সুন্দর শাদা দাঁত দেইখা
মাথার খুলিটা চিনবার পারছি।
সুন্দর শাদা দাঁত
মাটিতে কামড় দিয়া আছে,
সুন্দর খয়েরি চোখগুলাও
ভইরা ছিল মাটিতে,
মজবুত শাদা হাড়গুলি
আগে তো হাতই আছিল,
যেই হাত দিয়া অয়ে কোনো মাইয়ারে আদর করে নাই।
এখন মাটিরে আদর করতাছে
অর মজবুত শাদা হাড়গুলি।
হের নূরের মতো কচি দাঁতগুলি
মাটির ভিতরে পোঁতা।
বসন্তে নবান্ন আনে এই জমিন।
এই পাষাণ কঠিন মাটি
তার আন্ধার চোয়ালে সবাইরে গিল্যা নেয়।
বুইড়া মাইনষের মরণ বেজায় কঠিন।
আরও কঠিন ওই সুন্দর চোখগুলির
ফসল গজানোর নবান্নের দিন,
চোখগুলা কোনো দিন উদাম মেয়েলোক দ্যাখে নাই।
কোনো মাইয়াও কোনোদিন
ফিশফিশায়ে চুমু খাইতে খাইতে অরে কয় নাই:
আমি তোমার
(ওই চোখ আসলে কিছুই দ্যাখে নাই)
ওই চোখ থাইকা কি গজাইব কিছু
নিষ্ফলা নবান্নের কালে এই পাষাণ মাটিতে?
তোরে মনে পড়ে, ভাই।
আমাগো মা তোর শাদা দাঁত চিনছিল
তোর দামাল সুন্দর দাঁত,
এই বাঁজা পৃথিবীর নবান্ন ফসল।
গুলিতে মারা যাওয়া এত মানুষের লাশগুলো মাটিতে মিশে যাবে। মানুষের দেহের নাইট্রোজেন মাটিকে উর্বর করবে। মৃত্যুগুলো বৃথা যাবে না। মরদেহগুলো মাটিকে উর্বর করতে থাকবে–এই কি আমাদের একটুখানি সুখ?
আগে যা হয়েছে তা হতে পারে না। ভাষা আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা দুই আঙুলেই গুনে শেষ করা যায়। নব্বইয়ের শহুরে গণঅভ্যুত্থানের শেষ তিন মাসে নিহতের সংখ্যা ৫০ ছাড়ায় নাই। এমনকি এরশাদ পতনের আগের সপ্তাহে ডা. মিলন ও জেহাদ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আত্মদান ঘটেনি। আর জুলাই মাসের শেষ ১৪ দিন আর আগস্টের প্রথম ৫ দিনে মৃতের সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি, আহত ১৮ হাজার। ভাবা যায়! ভাবা যায় কী দানবকে কী অসম্ভব সাহস আর শহীদানে রুখে দিয়েছিল আমাদের ছেলেমেয়েরা! আগের সব রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে পুলিশের বিরুদ্ধে হাতে কাটা বন্দুক কিংবা ককটেল অন্তত তুলে নিয়েছিল প্রতিবাদকারীরা। কিন্তু এইবারে এরা আবু সাঈদের মতো নিরস্ত্র, মুগ্ধের মতো নিরীহ, রিয়া গোপের মতো নিষ্পাপ, ফারহানের মতো জানবাচ্চা। একটা ছবিতে দেখা যায়, গলির ভেতর তিনটি কিশোর হাতে লাঠি নিয়ে সতর্কভাবে এগোচ্ছে। গলির মাথায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের বন্দুকধারীরা। কিন্তু ওই তিন মুক্তিযোদ্ধা পিছু হটেনি। নিজের মহল্লা, নিজের গলি কিংবা নিজের ক্যাম্পাসকে তারা দানবের হাতে তুলে দেয়নি। মরেছে, তবু এক ইঞ্চি মাটি ছাড়েনি।
এই সব গল্প আমাদের বলে যেতে হবে। এই শ্রাবণ বিপ্লবে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের ১৮ কোটি গল্প বলবার আছে। সেইসব গল্প অবশ্যই শুনতে হবে সরকারকে। শহীদদের কোনোভাবেই ভুলে যেতে দেওয়া যাবে না। গণভবনকে যে শ্রাবণ বিপ্লবের জাদুঘর করার বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত এসেছে। কিন্তু এই জাদুঘর তো নিছক স্মৃতির প্রদর্শনী হতে পারে না, ছবি বা গুলির খোসার গ্যালারি হতে পারে না। এই জাদুঘরকে হতে হবে জীবন্ত ইতিহাস, গণহত্যার অনুসন্ধানী গবেষক, শহীদদের পক্ষের সজাগ পাহারাদার, ইতিহাসের দারোয়ান।
সরকারকে, ছাত্রজনতাকে, গণতন্ত্রের লড়াকু রাজনৈতিক দলগুলোকে বহুভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখা হবে। প্রতিটি গোষ্ঠীর চারপাশে অবিশ্বাসের খাদ খোঁড়া হবে। মূল ইস্যু যে রাষ্ট্র পুনর্গঠন এবং মাফিয়াতন্ত্রের খুঁটি ওপড়ানো, তা থেকে নজর সরানোর জন্য বহু ধোঁয়াশা তৈরি করা হবে। হোক, কিন্তু যখনই পথ হারাবার ভয় আসবে, যখনই বিভেদের ফাঁদে পা আটকে যাবে, যখনই লোভের চোরাবালিতে গতি আটকে যাবে, তখনই যেন মনে পড়ে হাসপাতালে শুয়ে থাকা পা হারানো কিশোরটির কথা, চোখ হারানো ভাইটির কথা, কবরে শুয়ে থাকা বিপ্লবের বীজধানের মতো শহীদদের কথা। ভুল করার সুযোগ নাই, ভুলবার সুযোগ তো একেবারেই নিষিদ্ধ!