বাছ-বিচারহীন মামলায়, ন্যায়বিচার যেন ব্যাহত না হয়!
Share on:
রাজনৈতিক বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ, সামাজিক বিরোধ কিংবা অন্য কোন বিরোধে মানুষের হয়রানি হওয়ার ঘটনা নতুন না; বরং খুবই পুরাতন। তবে যে কোন ধরনের মামলা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই আইনের চাহিদা অনুসারে মামলা করতে হবে। যেন ন্যায়বিচার ব্যাহত না হয়।
ন্যায়বিচার ব্যাহত হলে আইনের শাসন ভূণ্টুণ্টিত হয় তখন হাজারো অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার এর শাসনামলে দীর্ঘ ১৬ বছর যারা ন্যায়বিচার পাননি তারা ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছেন। কিন্তু নতুন সরকার গঠন হওয়ার পর ঢালাওভাবে মামলা দেয়ার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, যা আইনের শাসনের অন্তরায়। আইনের সুশাসন ফিরিয়ে আনার স্বার্থে যে কোন মামলা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই যাচাই বাছাই করা দরকার। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
অপরাধীর কোন দল নেই। নেই কোন মানবিক মূল্যবোধ। আওয়ামী সরকারের শাসনামলে যারা হত্যা, গুম ও আয়নাঘর সৃষ্টি করেছেন, সেসব নরঘাতকদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ঢালাওভাবে আসামী করা থেকে বিরত থাকা। অথচ দেশের কিছু কিছু জায়গায় ঢালাওভাবে নিরপরাধ মানুষকে মামলার আসামী করায় বাদীরা মামলা তুলে নিচ্ছে- এমন খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাদির অজ্ঞতসারে আওয়ামী স্টাইলে নিরপরাধ মানুষকে আসামীর তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেমন মেহেরপুরে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রীসহ ১৬৮ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বাদি হাসনাত জামান তুলে নিয়েছেন। কারণ বাদি যাদের নামে মামলা করেছিলেন তার বাইরেও কিছু নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করায় বাদি মামলা তুলে নিয়েছেন। দেশের যেসব জায়গায় এরকম ঘটনা ঘটেছে প্রতিটি ঘটনা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রতিটি মামলা দায়ের করার আগে কেন ভালো করে যাচাই করা হয়নি তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অভিযোগ আমলে নিলে যেমন ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না তেমনিভাবে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পায় না। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিলে ভুক্তভোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ন্যায়বিচার ভূলুন্ঠিত হয়। অপরাধীর সুবিধা হয়।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর ঢালাওভাবে মামলা করার ব্যাপারে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে হয়রানিমূলক মামলা না করতে বার বার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ভবিষ্যতে যারা দেশ পরিচালনায় দায়িত্বে আসবেন তারা যেন জালিমের ভূমিকায় অবর্তীণ না হয়। মানুষের সঙ্গে জুলুম করলে কী পরিণতি হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন থেকে এ শিক্ষা সকলেরই নেয়া উচিত। শুধু আওয়ামী লীগকে নয়, এই শিক্ষা জামায়াতকেও নিতে হবে, বিএনপিকেও নিতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে রাজধানীর জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) গিয়ে তিনি এসব কথা বলেছেন। (সূত্র ঃ ১৯ আগস্ট ২০২৪, সমকাল) যে কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে শাস্তি পাবে, সাজা ভোগ করবে, এটাই আইনের গোড়ার কথা। কিন্তু যখন দেখি নিরপরাধী ব্যক্তিকে মামলার আসামী করা হয় তখন সত্যিকারের অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গাতে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নিরপরাধ কিছু মানুষকে আসামী করার খবর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় মুদ্রিত হচ্ছে। এটা দুঃখজনক।
আওয়ামী সরকার যে জুলুম সাধারণ মানুষের উপর করেছে সে একই জুলুম যদি আবার মানুষের উপর চেপে বসে তাহলে নতুন সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে। কোন অবস্থাতেই যাচাই বাছাই না করে কোন মানুষকে মামলার আসামী করা যাবে না। যারা অপরাধী তারা শাস্তি পাবেই। যারা গত ১৬ বছর মানুষের উপর অন্যায় জুলুম ও নিপীড়ন করেছেন, ঢালাওভাবে জামাত শিবির ট্যাগ দিয়ে মামলা দিয়েছেন, জেলে ডুকিয়েছেন, হত্যা করেছেন। একই কায়দায় যদি এখনো হয়রানিমূলক মামলা চলতে থাকে তাহলে সেটি হবে শহীদ ভাইদের রক্তের সাথে বেঈমানি। মামলা করতে হলে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, যেন কারও প্রতি অবিচার না হয়। ভিত্তিহীন অভিযোগ মামলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইদানীং যেসব মামলা হচ্ছে সেগুলোতে কাউকে কাউকে হুকুমের আসামী বা নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। এ ধরনের মামলা তদন্ত পর্যায়ে খারিজ হয়ে যেতে পারে।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোন স্বৈরশাসক বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। যেমনটি পারেনি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভিন্নমত দমনের নামে অসংখ্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল হাজতে পাঠিয়েছিল। অসংখ্য মানুষকে আয়না ঘরে বন্দি করে রেখেছিল। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হয়রানিমূলক মিথ্যা ও গায়েবী মামলা দেয়া হয়েছিল। গায়েবি মামলার সংস্কৃতি আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ চালু করেছিল। আওয়ামী লীগের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গায়েবি মামলা সম্পর্কে বলেছিলেন-গায়েবি মামলা বলে কিছু নেই, ঘটনা ঘটলে মামলা হয়; না ঘটলে মামলা হয় না। এখানে কে বিরোধী দল, কে অন্য দল- এটা পুলিশ দেখে না। এটা পুলিশের নিয়মিত কর্মকান্ড। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ঘটনা যেখানেই ঘটে সেখানেই মামলা হয়। বিএনপির গায়েবি মামলার অভিযোগ ভিত্তিহীন। ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলাগুলো দায়ের করেন। বিএনপি এটাকে গায়েবি মামলা বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। যেগুলো গায়েবি মামলা বলা হচ্ছে সেসব ঘটনা ঘটছে বলেই মামলাগুলো হয়েছে। (সূত্র: ২১ অক্টোবর ২০২৩, যুগান্তর) আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ১০ বছর আগে মারা গেছেন অথবা ২০০৭ সালে মারা গেছেন এমন লোককেও মামলার আসামী করা হয়েছিল। এ রীতি জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক বোদ্ধা থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা না করার পরামর্শ প্রদান করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলায় জড়িয়ে হয়রানি না করতে অনুরোধ করা হয়েছে। ‘‘সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গত সরকারের আমলে যারা অন্যায় করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এটা জনগণের দাবি। তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। গত ১৫ বছরে তিন ধরনের অপরাধ হয়েছে। এগুলো-মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা (সহস্রাধিক ব্যক্তি খুন হয়েছেন) এবং ফৌজদারি অপরাধ। এ ছাড়াও আর্থিক অপরাধ ও অর্থপাচারের অপরাধ করেছে তারা। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে বিচার করে এসব অপরাধের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে, তা না হলে ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি না পেলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। যে প্রক্রিয়ায় মামলা হচ্ছে এতে সত্যিকার অপরাধীরা শাস্তি নাও পেতে পারে। এতে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
আমি মনে করি মামলাগুলো সঠিকভাবে সাজানো দরকার। সত্যিকার অর্থে যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। হয়রানিমূলক মামলা কোনোভাবেই সমর্থন করা যাবে না। তাতে যেই লাউ সেই কদুর মতো অবস্থা হবে।’’ ‘‘টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা করতে হবে, যাতে কারো প্রতি অবিচার করা না হয়। এখন যেসব মামলা হচ্ছে তা কতটুকু ফলপ্রসূ তার যৌক্তিকতা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা যেন ‘মব জাস্টিস’ না হয়ে যায়। যাতে করে এটা হয়রানির পর্যায়ে না যায়।’’ (সূত্র ঃ কালের কন্ঠ ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪) ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। ছাত্র জনতার এ বিজয়কে কোনভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক হবে না। দেশের স্বার্থে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। যেন নিরপরাধ মানুষের নামে মামলা তো দূরের কথা, কোথাও যেন একটি জিডি পর্যন্ত না হয় সে বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিশ্চিত করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।