মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ২০, সেপ্টেম্বর ২০২৪

ফ্রান্সে ডানপন্থীদের অগ্রযাত্রা থামাতে পারবে কি বামপন্থীদের ঐক্য?

Share on:

ফ্রান্সের সাম্প্রতিক নির্বাচন বলছে উগ্র ডানপন্থীরা ক্ষমতার একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছিল। একমাত্র যে বিষয়টি তাদের বিজয় ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে, তা হলো উগ্র বামপন্থীদের ঐক্য। এতে করে উগ্র ডানেরা পরাজিত হয়েছে, মধ্যপন্থী এমানুয়েল মাখোঁর শিবির ৭০টি আসন হারিয়েছে এবং বামেরা সবার শীর্ষ অবস্থানে চলে এসেছে।


এই বিজয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো ও নাগরিকদের বৃহত্তর ঐক্যের ফসল। ফ্রান্সের প্রধান প্রধান ট্রেড ইউনিয়নগুলো লড়াইয়ে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করে এবং একটা পপুলার ফ্রন্ট গঠনের ডাক দেয়। ফ্রান্সের বেশির ভাগ ট্রেড ইউনিয়ন উগ্র ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ও ভোট দেওয়ার আহ্বান জানায়।

ফ্রান্সের শাসকশ্রেণির একটা অংশ যখন উগ্র ডানপন্থীদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য তৈরি হচ্ছিল, সে সময়েই বামপন্থী শক্তিগুলো এভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং উগ্র ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে একটা ফ্রন্ট গঠন করতে সক্ষম হয়। এটা ছিল অতুলনীয় এক বিজয়, যার ধারণা ভোট নিয়ে জরিপ করা সংস্থাগুলো ধারণাই করতে পারেনি। জনপ্রিয় এই অভ্যুত্থান যেন স্বল্পকালীন নিরাময় না হয়ে ওঠে তার জন্য অবশ্যই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

ফ্রান্সের ভোটারদের একটা অংশ উগ্র ডানপন্থীদের ভোট দিয়েছেন। এটা শুধু মধ্যপন্থীদের প্রতি তাদের প্রতিবাদ প্রকাশের ভোট নয়, এটা একটা বিপথে পরিচালিত আশাও। এটাকে পরাজিত করতে হলে বামপন্থীদের অবশ্যই নয়া উদারবাদী নীতির বিকল্প নিয়ে আসতে হবে। কেননা, এই নীতি সামাজিক বৈষম্য বাড়াতে জ্বালানি জুগিয়েছে।

ফ্রান্সের নতুন পপুলার ফ্রন্টের কর্মসূচিটিকে বলা যায় মাখোঁবাদ থেকে বিচ্ছিন্নতা। নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নের সন্ত্রাস, বিশিল্পায়ন, সরকারি খাতের চাকরি সংকুচিত হয়ে যাওয়া, প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়া—এসব বিষয় মানুষের মাঝে একটা শক্তিশালী অনুভূতি জন্ম দিয়েছিল। তারা মনে করতে শুরু করেছিল, আগেই ভালো ছিল। উগ্র ডানপন্থীরা এই শূন্যতার কাঁধেই সওয়ার হয়েছিল এবং বিষয়গুলোকে তাদের ‘মহান প্রতিস্থাপন’ তত্ত্ব দিয়ে সাংস্কৃতিক বিষয়ে পরিণত করেছিল।

উগ্র ডানপন্থীরা নয়া উদারবাদের ধ্বংসলীলাকে উপেক্ষা করে। জীবনমান পড়ে যাওয়ার জন্য তারা অভিবাসীদের দায়ী করে। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নকে রক্ষা করার জন্য উগ্র ডানেরা অর্থনীতি থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়। এই ফাঁদ এড়াতে হলে বামেদের অবশ্যই এমন একটা গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি দরকার হবে, যেটা বহুজাতিক সংস্থা ও পুঁজির ক্ষমতার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

মুক্ত বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের জন্য একটা আনন্দজনক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে যাওয়া আর বেশি দিন সম্ভব নয়। আমরা আর মুক্ত বাণিজ্যের রক্ষক হতে পারি না। এই মুক্ত বাণিজ্য শ্রমিকের মজুরির জন্য বধ্যভূমি এবং পরিবেশ ধ্বংসকারী। সামাজিক ও পরিবেশবিষয়ক ইস্যুগুলোর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটিই উগ্র ডানপন্থীদের উর্বর প্রজননক্ষেত্র। এটা জয় করতে হলে পুঁজিবাদী ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোকে আঘাত করা জরুরি।

ব্লু-কলার বা শ্রমজীবী ভোটারদের ভোট আবার জয় করতে হলে বামেদের পুনঃ শিল্পায়নের একটা শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে কারখানা-শূন্য অর্থনীতির ওপর বামেরা যে অন্ধত্ব দেখিয়েছিল, সেটা ভাঙতে হবে। আমাদের এখন মৌলিকভাবে রূপান্তরিত একটা উৎপাদন মডেল দরকার, যেটা হবে পরিবেশগতভাবে টেকসই। কৃষি ও খাদ্যের ক্ষেত্রেও একই ধরনের মডেল দরকার।

কৃষকেরা তঁাদের কাজের মধ্য দিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার দাবি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের দাবিগুলো শুনতে হবে। আমাদের কৃষি খাতের দানবদের সীমাহীন মুনাফা করার প্রক্রিয়াটাকে আক্রমণ করতে হবে। একই সঙ্গে কৃষি মডেলের পরিবেশগত রূপান্তরের বিষয়টাকে প্রশ্নের মধ্যে আনতে হবে।

সরকারি খাতের কর্মসংস্থান নিয়ে আমাদের একটা পর্যালোচনামূলক মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। কঠোর অর্থনৈতিক নীতি সর্বজনের বিদ্যালয় ও হাসপাতালের সেবা অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছে। বেসরকারি খাতে যাওয়ার সামর্থ্য আছে তারাই ভালো মানের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবা পাচ্ছে। জনগণের সেবা খাতগুলোর এই হতদরিদ্র অবস্থা ‘ট্যাক্স বোল’ সৃষ্টিতে রসদ জোগাচ্ছে। মধ্যবিত্তদের মধ্যে এই অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে যে তারা সরকারের খাতের সেবার জন্য যে কর দিচ্ছে, তা থেকে তারা কোনোই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। আর একই সঙ্গে সবচেয়ে ধনীরা আর কর দিচ্ছে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০ বছর পর এসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে শক্ত দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলো ভেঙে পড়ছে। মাখোঁর রাজনৈতিক কৌশল হলো, তিনি উগ্র ডানপন্থীদের যে ভাষায় আক্রমণ করেন, বামপন্থীদেরও একই ভাষায় আক্রমণ করেন। মাখোঁর এই কৌশল উগ্র ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে নেওয়া আমাদের অবস্থানকে খাটো করে দিচ্ছে।

অতি ডানেরা স্বাভাবিক কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়। ফ্রান্সের ট্রেড ইউনিয়নগুলো কর্মক্ষেত্রে বর্ণবাদ ও সেমেটিকবাদবিরোধী প্রচারণার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা শুরু করার এখনই সময়।