মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ৩, অগাস্ট ২০২৪

চিকিৎসা সেবাও নাগালের বাইরে!

Share on:

চিকিৎসা সেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ অধিকার সবার ভাগ্যে জুটছে না। যাদের অর্থ বিত্ত আছে তারাই কেবল চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে। আর যাদের অর্থ-কড়ি নেই, তারা হাসপাতাল তো দূরের কথা; বারান্দায়ও ঠাঁই পাচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষ অর্থের অভাবে চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে পারছে না। নিত্যপণের সাথে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে।


কিছুতেই লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। নিত্যপণ্য কাটছাঁট করা গেলেও চিকিৎসা ব্যয় কাটছাঁট করা যায় না। জীবনের তাগিদে এ ব্যয় যোগাড় করতেই হয়। নিজের কাছে না থাকলে ধার-কর্জ করেও চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হয়। এককথায় চিকিৎসা ব্যয়ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। চলতি বছরের প্রথম দিকে লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্ট এর এক জরিপে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা, আন্তরিকতার অভাব, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভুল চিকিৎসার দুর্বলতার চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ছয়টি অঞ্চলের ৪০টি দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্নে। অথচ উন্নয়ন বেশুমার। এ কেমন উন্নয়ন? তা সংশ্লিষ্টমহলের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

আমরা বড্ড কঠিন সময় অতিক্রম করছি। কোথাও যেন এতটুকু জায়গা নেই যেখানে একটু স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলা যায়। সর্বত্র হাহাকার আর বুকফাটা কান্নার আওয়াজ হাওয়ায় ভাসছে। কিছুতেই কষ্টের দাগ মুছছে না। চিকিৎসার খরচ যোগাড় করতে না পেরে বহু মানুষের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হচ্ছে। কিছুতেই থামছে না চিকিৎসা ব্যয়। দিন দিন আকাশচুম্বী হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন পোলাও কাচ্চি খেতে চাই না। আমরা সাধারণ খাবারের নিশ্চয়তা চাই। আমরা চিকিৎসার নিশ্চয়তা চাই। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় সবচেয়ে বেশি। ১৯৯৭ সালে চিকিৎসা ব্যয় ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল সেখানে ২০২০ সালে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে তা বেড়ে ৭৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে দেশের ৩.৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় ৬১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার জন্য দেশের মানুষকে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় ৭৩ শতাংশ ব্যয় মানুষের পকেট থেকে দিতে হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় একটি পরিবারের একজন সদস্য হাসপাতালে ভর্তি হলে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয়ে ৫৪ শতাংশ, সার্জারিতে ২৩ শতাংশ, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১৭ শতাংশ, বেড ভাড়া ১৬ শতাংশ, চিকিৎসকের ভিজিট ৫ শতাংশ ও অন্যান্য ১৪ শতাংশ। আর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশের প্রায় ৬১ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা সেবা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছেন। ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ মানুষকে ঋণ করে চিকিৎসা ব্যয় সংগ্রহ করতে হয়েছে। অপরদিকে নিয়মিত আয় থেকে মাত্র ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতে পেরেছেন।

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান কেমন তা বুঝার জন্য মেডিকেল সাইন্সের বই পড়ার প্রয়োজন নেই। পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই উত্তর পাওয়া যাবে। কদিন আগে ভুল চিকিৎসার সিরিজ খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে। চিকিৎসা ভুল নাকি ভুল না তা আমরা বলতে পারব না। চিকিৎসাশাস্ত্রের পন্ডিতরাই ভালো বলতে পারবেন কোনটা ভুল আর কোনটা অবহেলা। তবে মাঝে-মধ্যে ভুল রোগ নির্ণয়, ভুল ওষুধ প্রয়োগ, নিম্নমানের ওষুধ, ভেজাল ওষুধ, ভুল অস্ত্রোপচারের ঘটনাগুলো পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানী শহর পর্যন্ত ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। ভুল চিকিৎসায় জন্ম নেওয়া শিশুটি তার গর্ভধারিণী মাকে হারাচ্ছেন। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ উঠছে। পরিবারের একমাত্র অভিভাবককে হারিয়ে পুরো পরিবার পথে বসার দ্বারপ্রান্তে। অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে দিনপাত করছে। চিকিৎসক আর রোগীর মধ্যে আস্থার সংকট দিন দিন বাড়ছে। চিকিৎসকের প্রতি রোগীদের আস্থা না থাকায় রোগীরা বিদেশমুখী হচ্ছে। দেশের চিকিৎসা সেবা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। রোগীরা বিদেশেমুখী হওয়া দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। তবে চিকিৎসা সেবা খাতে বিশ^াসের জায়গাটি ধরে রাখা প্রয়োজন। তা না হলে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা কমবে না। আমাদের দেশের রোগীরা সাধারণত ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে চিকিৎসা সেবা নিতে যায়। অথচ সেখানকার চাইতেও আমাদের দেশে ভালো মানের চিকিৎসক রয়েছেন। দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, আস্থার সংকট ও প্রতারণার ফাঁদ রোগীদের বিদেশমুখী করে তোলছে, এ প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। নতুবা দেশের চিকিৎসা সেবা মুখ থুবড়ে পড়বে। নিকট অতীতে মহামান্য হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছে- উন্নত ও সুচিকিৎসা কেবল দেশের ধনী ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমিত।

আদালত আরও বলেছেন- মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তসহ দেশের সাধারণ জনগণ বলতে গেলে উন্নত চিকিৎসা ও সুচিকিৎসা হতে বঞ্চিত। কেবল নামমাত্র সামান্য চিকিৎসাসেবা পান তাঁরা। ভেজাল ওষুধ সেবনে ১৯৯১ ও ২০০৯ সালে প্রাণ হারানো মোট ১০৪ জন শিশুর পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা মহামান্য হাইকোর্ট প্রদান করেন। রায়ে আদালত বলেছেন- জনগণের করের টাকায় সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিরাসহ সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিদেশে হামেশাই সরকারি অর্থে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এমনকি চিকিৎসার জন্য প্রায় সব রাজনৈতিক দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের বিদেশে যেতে দেখি। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার মতো ন্যূনতম কোনো সুযোগ নেই। রায়ে আরও বলা হয়- বিনামূল্যে সব চিকিৎসা সুবিধা না পেলে ব্যক্তি তাঁর জীবন তথা বেঁচে থাকার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য। সুতরাং প্রত্যেকের বিনামূল্যে সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া তাঁর সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার তথা বেঁচে থাকার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মালিক এই দেশের প্রতিটি নাগরিক। বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ায় সেই নাগরিকের জীবন হুমকির সম্মুখীন। আদালত বলেছেন, বিনামূল্যে ভেজালমুক্ত তথা নির্ভেজাল ওষুধ পাওয়া নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। (১৬ নভেম্বর ২০২৩)

এমনিতে নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী দামে মানুষ দিশেহারা। চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণ বহু মানুষের চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বহুমানুষ ঝাড়ফুঁকের দিকে ঝুঁকছেন। যা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। এককথায় চিকিৎসার ব্যয় জোগার করতে না পেরে অনেক মানুষ অসুস্থ অবস্থায় দিনপাত করছেন। চিকিৎসা সেবার সামগ্রিক উন্নয়ন জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। এত উন্নয়ন! তবুও গ্রামের চিকিৎসা সেবা বাড়েনি। সামান্য পেট ব্যথা হলে পরে ভরসা শহর কেন্দ্রিক হাসপাতাল। দেশের প্রায় সকল উপজেলায় সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু ভালো মানের চিকিৎসক নেই। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে কড়া হুঁশিয়ারি রয়েছে। তারপরও চিকিৎসকরা গ্রামে যেতে চান না। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর রোগী না হলে জানা যায় না। যারা রোগী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তারা হাড়ে হাড়ে টের পান। চিকিৎসা সেবার ব্যয় কিভাবে কমানো যায় সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধ করার প্রয়াসে মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। কেননা কিছু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যেমন: এ্যাম্বুলেন্স বাণিজ্য থেকে শুরু করে, অহেতুক টেস্ট, আইসিওতে রাখা, অযথা বাড়তি ওষুধ প্রদান, বেশিদিন হাসপাতালে ধরে রাখা, ভূতুড়ে বিল করা, সার্ভিস চার্জের নামে রোগীর পকেট কাটা। এসব ঘটনা প্রায়ই প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকট মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কোন একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সবাই নড়েচড়ে বসে। ওই পর্যন্তই শেষ! আবার দিন কয়েক পার হয়ে গেলে সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসে। চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোর কাক্সিক্ষত মানের সেবা নিশ্চিত করা দরকার। যেন রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালমুখী না হয়। সরকারি হাসপাতালগুলো বেসরকারি হাসপাতালের মতই রোগীদের সার্ভিস দিবে, এমনটিই ছিল সবার প্রত্যাশা। কিন্তু তা হচ্ছে না। কারণ একটি দেশের রাজনীতি যখন পচে যায় তখন সেখানে শান্তির পায়রা উড়ে না; বরং অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ¦লে উঠে। সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার কঠোর হলে সরকারি হাসপাতালেও বেসরকারি হাসপাতালের মতই সেবা দেয়া সম্ভব। জনবল না থাকলে জনবল বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। চিকিৎসার ফি বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। সকল ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা।

দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে চিকিৎসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। যেসব মেডিকেল কলেজ নামস্বর্বস সাইনবোড মাত্র সেগুলোকে বন্ধ করা। ভালো মানের চিকিৎসক নিয়োগ করা। সকল মেডিকেল কলেজগুলোতে সব ধরনের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে টেস্ট এর রেট একই রাখা। টেস্ট বাণিজ্য বন্ধ করা। সরকারি হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা সকল ধরনের টেস্টে করানোর ব্যবস্থা করা। কিছু চিকিৎসক রোগীর কথা না শুনেই প্রেসক্রিপশনে হাতে ধরিয়ে বলেন-অমুক ডায়াগনিস্টিক সেন্টার থেকে টেস্টগুলো করে নিয়ে আসেন। এ টেস্ট রোগীর জন্য প্রযোজ্য কী না তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি অডিট টিম গঠন করা। ব্যবস্থাপত্রে অতিরিক্ত টেস্ট দিলে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা। অধ্যাপক লেভেলের চিকিৎসকের ভিজিট সরকারি ও বেসরকারি সকল পর্যায়ে ৫০০ টাকা বাধ্যতামূলক করা। রিপোর্ট দেখানোর নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধ করা। সরকারি হাসপাতালে সন্ধ্যাকালীন চেম্বার চালু করা এবং বেসরকারি চিকিৎসকদের বসার ব্যবস্থা করা। সবারই মনে রাখা দরকার, চিকিৎসার উদ্দেশ্য ব্যবসা নয়; বরং সেবা। চিকিৎসা ব্যয় কমাতে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

দৈনিক সংগ্রাম