উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক অর্থনীতির নীলনকশা
Share on:
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে সুবা বাংলায় ব্যবসায় ও বসতি স্থাপনের সুযোগে ব্রিটিশরা স্থানীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে নানা ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় এবং ফলত ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাবকে পরাজিত করে। অতঃপর বাংলার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কার্যত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়। দেওয়ানি অধিকারের ফলে কোম্পানি রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা অর্জন করে।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন ভারতের সমগ্র এলাকায় প্রশাসনকে মোটামুটি একটি একক কাঠামোর আওতায় আসে। ব্রিটিশ রাজের শাসনের শুরুতে অংশত রাজনৈতিক, অংশত প্রশাসনিক কারণে অনেকগুলো আঞ্চলিক ও সীমানাগত পরিবর্তন ঘটান হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল প্রশাসনিক সংস্কারের নামে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভের মুখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদে বাধ্য হয়। এ পর্যায়ে প্রধানত বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রদেশ, আসামকে একটি পৃথক প্রদেশ করা হয় এবং বিহার ও উড়িষ্যা বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলার পশ্চিম অংশে হিন্দুদের এবং পূর্ব অংশে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে বাংলা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকেই যায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের এক আপাত সমাপ্তি ঘটে। এই ভাগাভাগিতে রাজনৈতিক অর্থনীতির অভিনব প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের প্রাক্কালে ভারতের কোন কোন অঞ্চল কার ভাগে পড়বে বা বণ্টিত হবে এ নিয়ে যে দরকষাকষি তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেদবুদ্ধি, আর্থসামাজিক ও ব্যবসায়-বাণিজ্য স্বার্থবাদিতার সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। যার ফলে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর ভাগ্যে ভারত ভাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা শেষমেশ ভয়াবহতম দাঙ্গা, মানবিক বিপর্যয় ও সহস্র বছরের সম্প্রীতি সৌহার্দ্য সম্পর্ক বিনষ্টের হেতুতে পরিণত হয়েছিল এবং বলাবাহুল্য এখনো তা সংক্রামক ব্যাধির মতো নানান আঙ্গিক ও অবয়বে বিদ্যমান। সুদূর লন্ডনে বসে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল (১৮৭৪-১৯৬৫) রাজনৈতিক অর্থনীতির কূটকৌশল হিসেবে ভারত ভাগের নীলনকশা এঁকেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রতি তার ছিল নিদারুণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী। [মধুশ্রী মুখার্জ্জি, Churchills Secret War, The Britsh Empire and the Ravaging of India during second world war , Basic Books, New York , 2011]
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে তিনি যে ফন্দি এঁটেছিলেন তার ভেতরেই নিহিত ছিল ভারতবাসীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক শোষণ বণ্টন বৈষম্যের বাদ বিসম্বাদ দ্বন্দ্ব কলহ সৃষ্টির উপাদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) ব্রিটিশরাজের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বল ক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে ভারতের ক্ষমতা দ্রুত হস্তান্তরের টার্গেট নিয়ে ক্রিপস মিশন এবং র্যাডক্লিফ আসেন চার্চিলের সেই ব্লু-প্রিন্ট অনুসারে বাউন্ডারি বিভাজনে। ভারতবর্ষের সবচেয়ে উর্বর, ফলনশীল (শুধু খাদ্যশস্যে নয়, মেধা, মানবসম্পদ, নেতা, যোদ্ধা, সাহিত্য সংস্কৃতিতেও) দুই অঞ্চলকে (বাংলা ও পাঞ্জাব) দুইভাগ করে ডিভাইড অ্যান্ড রুল তত্ত্বে সৃষ্ট চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা এবং ভূস্বর্গ কাশ্মিরকে উভয়ের মাঝখানে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হিসেবে রেখে দেয়া হয়। সে বিভাজনে এমন আন্তঃকোন্দলের বীজ রোপিত ছিল যা এখনো বিষবৃক্ষের ফল ভক্ষণের মতো প্রায় ২০০ কোটি মানুষের জীবন যেন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র পরিস্থিতিতে বিদ্যমান। যার জন্য পাকিস্তানের সংসার ২৪ বছরের বেশি টেকেনি, যার জন্য ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যার কবলে পড়ে বহু মানুষের জীবনপাত ঘটেছে পাকিস্তানের সংসার থেকে বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসতে। আবার স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশের ছাত্র ও আমজনতাকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেমে নিজেদের হাতে নিজেদের প্রাণ দিতে হয়েছে জুলাই বিপ্লবে।
ভারতবর্ষের ভূরাজনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির মাঠে এমন একটি আত্মদহনের হতাশাজনক অবস্থার বীজ বপন করা হয়েছিল তা এখনো এখানে-সেখানে স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন দেখা থেকে নিষ্কৃতি মিলছে না। ভারত ভাগের সময় রাজনৈতিক উৎকোচ, বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক স্বার্থের রশি টানাটানির উপাখ্যানে [Alex Von Tunzelmann, ‘INDIAN SUMMER the Secret History of the End of An Empire, Picador, New York, 2007] ভারত ভাগ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ পর্ব গোপনীয় ও ক্লাসিফাইড তথ্য-উপাত্তের পরীক্ষা পর্যালোচনা পাওয়া যায়। সেখানে চট্টগ্রামকে তদানীন্তন পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যে দরকষাকষি হয়েছিল তার তথ্য ও উপাত্তভিত্তিক বিবরণ রয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারত ভাগের সময় সমৃদ্ধ পাঞ্জাব এবং সম্পদশালী বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করাই ছিল ব্রিটিশ রাজের প্রধান কূটকৌশল। ব্রিটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি-দর্শনের আলোকে ধর্মাবলম্বীর প্রাধান্যের বিচার বিবেচনায় বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। গণভোট নিয়ে সাব্যস্ত হয় সিলেট কোন অংশে যাবে।
এক সময়ের রাজধানী শিল্পনগরী কালকাতা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ও দাবির প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গ বড্ড বেমানান পরিস্থিতিতে পড়ে, কেননা কৃষিপ্রধান পূর্ববঙ্গের কাঁচামাল সহায় সম্পদ দিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন, সেই কলকাতাকে কংগ্রেস ভারতভুক্তকরণে অটল থাকায় পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ ব্যর্থ রাষ্ট্র বা পঙ্গুত্ব বরণ করে টিকবে না (at least one half of Pakistan was set up to fail) এ আশঙ্কা প্রবল হয় । ২৬ এপ্রিল ১৯৪৭ ডি মাউন্ট ব্যাটেন (১৯০০-১৯৭৯) মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে (১৮৭৬-১৯৪৮) এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জিন্নাহ চটজলদি জবাব দেন- কলকাতা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান প্রাপ্তির পক্ষপাতি তিনি নন; বরং মনে করেন দুই বাংলা একত্রে একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হলে ভালো হবে। শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) যুক্ত বাংলার প্রস্তাব তুললে কংগ্রেসের চোখ রাঙানিতে তা উবে যায়। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) স্মরণ করেন, ‘শরৎ বাবু কংগ্রেস নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ, সরদার বল্লভভাই প্যাটেল (১৮৭৫-১৯৫০) তাকে বলেছিলেন, শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই’... মিস্টার প্যাটেল শরৎ বাবুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে এ কথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন এ কথা স্বীকার করেছিলেন।’ সে পরিপ্রেক্ষিতে সোহরাওয়ার্দী এমন প্রস্তাবও দেন যে, কলকাতা ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ নিয়ন্ত্রণে অন্তত ছয় মাস ‘ফ্রি সিটি’ হিসেবে থাকুক। প্যাটেল মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘not even for six hours’।
ঠিক এ পরিস্থতিতে পাকিস্তানকে চট্টগ্রাম দেয়ার পরিকল্পনাতেও কংগ্রেস বাদ সাধে- চট্টগ্রামও ভারতের চাই, যুক্তি- পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার বেশির ভাগ অ-মুসলিম । অ-মুসলমান প্রধান অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানে থাকতে পারে না। ভারত চট্টগ্রামও পাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মাউন্টব্যাটেন দেখলেন বঙ্গভঙ্গের সময়ও আসামসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ববঙ্গের সাথে ছিল, আজ দার্জিলিং হাতছাড়া পাকিস্তানের, উত্তরবঙ্গের সাথে করিডোর রেখে ভুটান ও নেপালে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হচ্ছে। গভর্নর ফ্রেডারিক বারোজ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ‘সে ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গ স্রেফ পল্লী বস্তিতে (rural slum) পরিণত হবে।’ সবার কাছে প্রতীয়মান হলো, পূর্ব পাকিস্তান যাতে টিকতে না পারে তার জন্য এই ব্যবস্থা।
ভারত ভাগের ঠিক দুই দিন আগে সরদার বল্লভভাই প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনকে লেখা পত্রে জোর দাবি তুললেন চট্টগ্রাম ভারতের চাই, পাকিস্তানকে এটা দেয়া হবে চরম অন্যায় (manifestly unjust). মাউন্টব্যাটেন প্যাটেলের এ পত্রে ক্ষেপে গেলেন প্যাটেলের ওপর। প্যাটেলের এই পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে মাউন্টব্যাটেনের মনে হলো কলকাতা বঞ্চিত পূর্ববঙ্গে যাতে নিজেই নিজের দুর্ভোগের শিকার হয় (to fail on its demerits) এবং পূর্ববঙ্গ যাতে নিজেই নিজেকে গড়ে তুলতে অক্ষম হয় এমন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র নির্মাণের (anation deliberately designed to be incapable) ফন্দি আঁটা হয়েছে।
শেষ মুহূর্তে চট্টগ্রামকে নিয়ে কংগ্রেসের এহেন আপত্তির প্রেক্ষাপটে মাউন্টব্যাটেন প্রমাদ গুনলেন, কিভাবে ফিরোজপুর ভারতকে দেয়ার প্রতিদান হিসেবে পাকিস্তানকে চট্টগ্রামপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায় তার পথ খুঁজতে গিয়ে তিনি র্যাডক্লিফের বাটোয়ারা ম্যাপ (রোয়েদাদ) জারি পেছানোর পথ পেয়ে গেলেন। তিনি যত তাড়াতাড়ি নির্বিঘে্ন ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় তত মঙ্গল মনে করলেন। ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফের বাটোয়ারা ম্যাপ জারির দিন সাব্যস্ত হলো। ‘আগে আমি করাচি ও দিল্লির ক্ষমতা হস্তান্তর কাজ নির্বিঘ্নে শেষ করি তারপর ১৭ তারিখ এটি জারি করলে দাঙ্গা ও হাঙ্গামা থেকে আগাম রেহাই মিলবে।’ হলো তাই। ১৭ তারিখ ম্যাপ দেখে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ হতভম্ব, যুগপৎ খুশি আবার অখুশিও। দ্বিখণ্ডিত পাঞ্জাব ও বাংলা চরম দাঙ্গার মধ্যে পড়ে গেল। দেখা গেল প্রথম তিন দিন (১৪-১৬ আগস্ট) সীমান্তবর্তী জেলা খুলনায় ভারতীয় পতাকা উড়লেও খুলনা পাকিস্তানের এবং মালদহে পাকিস্তানি পতাকা উড়লেও মালদহ ভারতের ভাগে পড়েছে।