মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ২২, অগাস্ট ২০২৪

আগে অর্থনীতির ধস ঠেকানো দরকার, রাজনীতি পরে হোক

Share on:

শহীদের রক্তের দাগ শুকায় নাই, কিন্তু আপনারা রাস্তা অচল করছেন, সচিবালয় ঘিরেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনেও চলে গেছেন। অথচ আমাদের এখন দেশে প্রশাসন চালু করা দরকার, লুটপাটে ছিবড়া হওয়া অর্থনীতির ধস ঠেকানো দরকার।


পরিবর্তন ইনস্ট্যান্ট নুডলস নয়

এরই মধ্যে ভারত বাঁধ খুলে দেওয়ায় চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিশাল এলাকা ভেসে গেছে। ক্ষয়ক্ষতি বেশুমার। মানুষের কষ্টের দিকে নজর নাই, আপনারা হক না-হক ‘বঞ্চিত’রা চটজলদি প্রতিকার চান। পেশাজীবীদের কেউ কেউ এখন ঘেরাও-অনশনের হুমকিও দিচ্ছেন। ১৫ বছরের জঞ্জাল ১৫ দিনে সাফ করা কোনো মহাপুরুষের পক্ষেও অসম্ভব। তাহলে এত হইচই কেন?

ঢাকা শহরে রাতের ডাকাতের হুমকি ছিল একটা চক্রান্ত; এখন দাবিদাওয়ার মিছিলকেও অনেকে সন্দেহ করছেন। প্রশ্ন আসে, গত ১৫ বছর যদি ধৈর্য ধরতে পারেন, তাহলে ১২ দিন বয়সী সরকারের বেলায় কেন এত অস্থিরতা! ন্যায়বিচার সবারই প্রাপ্য। কিন্তু সরকারের তো কিছু অগ্রাধিকার আছে। এখনও শত শত ছেলেমেয়েসহ শ্রমজীবী মানুষ পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পড়ে আছেন হাসপাতালে। অনেক বেওয়ারিশ মানুষের নাম-ধাম শনাক্ত হয়নি। এখনও আহতদের থেকে মৃত্যুর খবর আসছে। অন্ধ হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন শত শত ছাত্র-জনতা। সুতরাং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা জনগণ ভালো চোখে দেখবে না। এই লোকগুলি এতদিন কোথায় ছিলেন? হঠাৎ এখনই বা কেন এত হইচই ? গণমাধ্যমের উচিত গোড়াটা খতিয়ে দেখা।

পরিবর্তন ইনস্ট্যান্ট নুডলস নয় যে, আন্দোলনের উত্তাপের সঙ্গে মিশিয়ে নিলেই খাবার রেডি! পরিবর্তন কষ্টসাধ্য ব্যাপার, ধৈর্যের ব্যাপার, ত্যাগের ব্যাপার। দাবিদাওয়া পার্টির কাছে ত্যাগ না হোক, কিছুটা ধৈর্য ও উদারতা তো চাইতেই পারি। শিশুরা কোনো কিছু চাইলে তক্ষুনি চায়, না হলে কান্নাকাটি করে। এসব শিশুসুলভ আচরণ বন্ধ হোক। এদিকে সময় নাই হাতে। যা করার দ্রুতই করতে হবে। সরকারের প্রতিটা সঠিক পদক্ষেপ মানুষকে ভরসা দেবে, তেমনি সরকারের মেয়াদও বাড়িয়ে দেবে। অ্যাকশন হলো ঔষধ, তত্ত্বকথা না।

দাবিদাওয়া পার্টি ও চাওয়ার দীনতা

দাবিদাওয়ার অস্থিরতার পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির আলামত। কিছু মানুষ নেমে পড়েছেন এখনই একটা বিপ্লবী সরকার গড়তে হবে। মানুষ কী চায়? মানুষ চায় জরুরি পদক্ষেপ। মানুষ চায় লুটেরাদের ক্ষমতাকাঠামো ভাঙা হোক, মাঠের বাস্তবতা বদলাক, জীবনে সুখ না হোক স্বস্তি আসুক। আর কাকে বলব বিপ্লবী সরকার? কেউ চান ইসলামী সরকার, কেউ চান বামপন্থি সরকার। যেন রাষ্ট্রের মাথায় সরকারের কপালে বিপ্লবের সাইনবোর্ড লাগালেই অর্থনীতি ঠিক হয়ে যাবে, প্রশাসন ঠিক হয়ে যাবে, বিদেশি চাপতাপ কমে আসবে ইত্যাদি।

আসলে তো অস্থির হওয়ার কথা ছিল বিএনপির। এই দলটি ১৫ বছর ধরে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছে। ভয়ংকর নির্যাতিত হয়েছে। অনেকে গুম হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারাসহ লাখো কর্মী মিথ্যা মামলায় নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাইছেন। অনেকে ঘরবাড়িতে থাকতে পারেননি। বিদেশে নির্বাসন কিংবা স্বদেশে বিবাগীর মতো পালিয়ে থেকেছেন। ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন, এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপিই জয়ী হবে। তারপরও কিন্তু বিএনপি ক্ষমতার জন্য অস্থির নয়। সেই বিএনপি বলেছে, ‘রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেবে বিএনপি।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়া প্রয়োজন…বিএনপি এই সরকারকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে।’

আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীস্বার্থে কিছু চাইছে না, নির্যাতিত বিএনপি কিছু চাইছে না, তাহলে খুচরা দাবিদাওয়া পার্টি এত অস্থির হলো কেন? কবি জীবনানন্দের ভাষায় বলা দরকার, আপনাদের কি ‘চাওয়ার দীনতা ছাড়া আর কিছু নাই?’

আদতে মূল প্রশ্নটা যতটাই রাজনৈতিক ততটাই কারিগরি বা বাস্তবিক। জনগণের বিজয় পাহারা দেবার জন্য রাজপথে জমায়েত থাকার প্রয়োজন হবে। কিন্তু রাষ্ট্র চালাতে দরকার রাষ্ট্রনায়ক, দরকার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, দরকার সাহসী ও কঠোর সিদ্ধান্ত। সব সময় সব সঠিক কাজ জনপ্রিয় হয় না, কিন্তু পরে মানুষ বুঝতে পারে যে, কাজটা ঠিকই ছিল।

অর্থনীতি আগে রাজনীতি পরে

৫ আগস্টের আগের সংকট ছিল দানবীয় রাজনৈতিক লুটেরা শক্তির অপসারণ। সেটা অসীম ত্যাগের বিনিময়ে, হাজারো শহীদানের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। এখন দরকার রাষ্ট্র ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের সৃষ্টিশীল কাজ। এই কাজের লিস্টিতে অনেক কিছুই আছে। কিন্তু সিকোয়েন্সিং বা পর্যায়ক্রম ঠিক করাই আসল কথা। আমাদের গাড়িও লাগবে, ঘোড়াও লাগবে। কিন্তু ঘোড়ার আগে গাড়ি লাগালে হবে না। ঘোড়াটা হলো অর্থনীতি, আর গাড়ি হলো রাজনীতি। আমরা অর্থনীতি ঠিক না করে রাজনীতি ঠিক করতে পারব না। চীন আগে অর্থনীতি সবল করেছে, তারপরে রাজনীতি নিয়ে ভাবছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থনীতি ঠিক না করে বিশ্বে বিপ্লব রপ্তানি করতে গিয়ে ভেঙে পড়েছিল। এই তুলনাটা আমাদের বেলাতেও খাটে। পুরোনো শক্তি আইনত ক্ষমতায় নাই, কিন্তু তাদের সংগঠন, অর্থশক্তি, অস্ত্রশক্তি ও দেশি-বিদেশি নেটওয়ার্ক রয়ে গেছে। সেই ক্ষমতা আগে ভাঙতে হবে। এ ব্যাপারে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুশতাক হুসেন খান রাষ্ট্রচিন্তা আয়োজিত ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সংস্কার ও সংবিধান’ শীর্ষক বক্তৃতায় অন্তর্বর্তী সরকারের চারটি জরুরি কর্তব্যের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন, এই চারটি উদ্যোগ গ্রহণ না করলে দেশের অর্থনীতি বড় ধসের মুখে পড়বে। এবং পরিণামে পরিবর্তনও বিরাট হোঁচট খেতে পারে।

জরুরি চার দফা দাবি

দাবি চারটি হলো এই: ১. ব্যাংকিং সেক্টরকে আশু ধস থেকে বাঁচাতে ও বর্তমানের অলিগার্কিক ক্লেপ্টোক্রেসি ভাঙতে সরকারকে ইমার্জেন্সি অর্ডিন্যান্স জারি করে ‘শুধুমাত্র সবচেয়ে বড় ১০টি বিজনেস গ্রুপের’ উৎপাদনশীল ও লাভজনক কোম্পানিগুলোর খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ শেয়ার নিয়ে পাবলিকের কাছে বিক্রি করতে হবে। সেই টাকা দিয়ে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ শোধ হবে। কারণ এরা ঘৃণ্য ঋণগুলো নিয়েছে অন্য ভুয়া কাগুজে কোম্পানির নামে। তাই কাগুজে কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত করলে ব্যাংক তার ঋণ ফিরে পাবে না। পাশাপাশি লাভজনক কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় কোনো হাত দেওয়া যাবে না। হরেদরে সবাইকে ধরলে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হবেন, যার কুফল আমরা ২০০৬-০৮ সালের জরুরি সরকারের সময় দেখেছি।

২. পাওয়ার সেক্টরে অযৌক্তিক ক্যাপাসিটি চার্জ গোনা বন্ধ করতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। পাওয়ার ও এনার্জি সেক্টরে সকল জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে হবে। না হলে মুদ্রাস্ফীতি ঠেকানো যাবে না।

৩. হুন্ডি ও অন্যান্য অন্যায় উপায়ে টাকা পাচারকারীদের ধরতে প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ইউনূসকে ব্যক্তিগতভাবে বৈশ্বিক ইমেজ ও প্রভাব খাটিয়ে ইউরোপ, আমেরিকায় টাকা পাচারকারীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করাতে হবে। যেভাবে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে ইউরোপে রাশিয়ান অলিগার্কদের হিসাব জব্দ করা হয়েছিল।

৪. বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সকল বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে আওয়ামী লীগের করা সকল গোপন ও অন্যায় চুক্তি জনসমক্ষে উন্মুক্ত করতে হবে। তা না করলে তারা প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালিয়ে যাবে এবং এই সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে। গণঅভ্যুত্থান-উত্তর সরকারকে এই কাজটি করতে হবে। যেহেতু এখন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। এসব করলে বাংলাদেশ নিরাপদ হবে। কারণ অপশক্তির গোড়া কাটা পড়বে। বাংলাদেশের সামনে হাজির হওয়া সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে একটু সাবালকত্ব দেখানো দরকার।

দৈনিক সমকাল