মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ১৫, অগাস্ট ২০২৪

আওয়ামী লীগের ‘সংখ্যালঘু’ খেলা কবে বন্ধ হবে?

Share on:

৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণজাগরণ শুধু বাংলাদেশ নয়; গোটা বিশ্ববাসী দেখেছে। এ গণজাগরণের বাধার মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পদত্যাগ করার কয়েকদিন আগেও তিনি বলেছিলেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন না।


কিন্তু তিনি তার কথা রাখতে পারলেন না। দলীয় নেতাকর্মীদেরকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়ে তিনি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন। এ কেমন রাজনীতি? শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর গোটা দেশ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। চারদিকে শুরু হয় বিজয় মিছিল। এদেশের অকুতোভয় ছাত্র সমাজের এ ত্যাগ ও কুরবানী যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শাসকদলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তারা বিজয় নিশান উড়িয়েছে।

এ বিজয় কোন রাজনৈতিক দলের নয়; এ বিজয় ছাত্র জনতার। যাক ৫ আগস্টের ঘটনা লিখা আমার উদ্দেশ্য নয়! উদ্দেশ্য হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিপদের সময় তাদের পাশে কারা দাঁড়িয়েছেন সে বিষয়টি তুলে ধরা। ইতিহাসের পাতায় পড়েছিলাম ছাত্র আন্দোলন কখনোই বিফল হয়নি। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯ এর গণঅভুত্থান ও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র জনতার বিজয় হয়। কিন্তু সে বিজয়গুলোতে এত রক্ত, এত প্রাণহানি হয়নি। অথচ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিজয় ছিনিয়ে আনতে শিশু, কিশোর, তরুণরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। ৫ আগস্টের কথা হয়ত আমরা ভুলে যাব। আমরা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ও ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের কথাও ভুলে গেছি। কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছেন তারা ভুলবেন কীভাবে? তাদেরকে এ ক্ষত আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কারণ যার যায় সে বুঝে বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা।

৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা, অভিভাবক ও সমাজের নানা শ্রেণী পেশার মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশ সদস্যরা জীবন বাঁচাতে থানা ছাড়তে বাধ্য হন। সব পুলিশ সদস্যরা খারাপ তা আমরা বলছি না। কিন্তু অধিকাংশ সদস্যদের নিষ্ঠুরতা হিটলার মুসোলিনীর নিষ্ঠুরতাকেও হার মানিয়েছে। তবে নিষ্ঠুরতার প্রতিশোধ নিষ্ঠুরতা দিয়ে দিতে হবে বিষয়টি এমনও নয়।

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে জুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষগুলোর চোখের পানি আর শহীদ হওয়া শিক্ষার্থীদের মায়ের চোখের পানি নিশ্চয় আল্লাহতায়ালার আরশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে আল্লাহতায়ালা নিজ কুদরাতে স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত করেছেন। আওয়ামী সরকারের পতন হওয়ার পর পরই আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে কিছু জায়গাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। এটা কোন ধর্মীয় চেতনা থেকে হামলা নয়; বরং আওয়ামী লীগ করেন এমন কিছু হিন্দু নেতাদের না পেয়ে তাদের বাসা বাড়ীতে হামলা হয়।

কোন হামলাই গ্রহণযোগ্য নয়। মন্দির ভাংচুর বিষয়ে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোবিন্দ প্রামাণিক এক সাক্ষাৎকালে বলেন- শেখ হাসিনার পালানোর পরে এদেশের হিন্দু সমাজ মনে করছিল যে তাদের ওপর হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটবে। কিন্তু জামায়াত ও বিএনপির নেতারা তাদের সব নেতাকর্মীদের হিন্দুদের বাড়িতে হামলা-লুটপাট যাতে না হয় সে জন্য মন্দিরে পাহারা দিয়েছেন। বিক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ীতেও হামলা চালিয়েছে। আমরা কোনভাবেই হামলাকে সমর্থন করি না। কারণ প্রতিশোধ কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না; বরং পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।

উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যত লেখা, যত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে এত প্রপাগান্ডা এত মিথ্যাচার কখনো হয়নি। ১৯৪১ সালে দার্শনিক সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ ভারতের পাকিস্তান অংশে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমালোচনা আর বিষোদগার নিন্দুকেরা করেছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তায় চিড় ধরাতে পারেনি; বরং জামায়াতে ইসলামী সকল যড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে দ্বীনের কাজ করে যাচ্ছে। জামায়াত তার সাধ্যমত হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কে মুসলিম, কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান, কে সাঁওতাল তারা তা বিবেচনা করেনি; যার সাক্ষী পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে মর্মান্তিক নৌদুর্ঘটনায় নিহত ৭০ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবার। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় মাড়েয়া বাজার এলাকার আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ একটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকা দিয়ে বদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিল।

কিন্তু ঘাট থেকে নৌকাটি কিছু দূর যাওয়ার পরই ডুবে যায়। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিবারকে জামায়াতের পক্ষ থেকে সমবেদনা ও আর্থিক সহযোগিতা বাবদ ২১ লাখ টাকার অনুদান প্রদান করা হয়। এ ঘটনাটি সোস্যাল মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। বিশেষ করে ফেসবুকে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে জামায়াতের প্রশংসা করেছেন। দলটি বন্যা, অগ্নিকান্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, নৌদুর্ঘটনা, গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসাসহ সামাজিক জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। যখনই কোন মানুষ বিপদে পড়ছেন তখনই জামায়াতে ইসলামী সাধ্যমত সহযোগিতার চেষ্টা করেছেন।

স্বাধীনতার পর এদেশে সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর কারা বেশি নিপীড়ন চালিয়েছে, কারা তাদের ঘরবাড়ি, জমি দখল করেছে সে ইতিহাসটা খতিয়ে দেখা দরকার। ভিনদেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এদেশীয় একশ্রেণীর এজেন্টরা সব দোষ জামায়াতের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীকে হিন্দুবিরোধী বলে তকমা দেয়া হয়। জামায়াত কখনো হিন্দুদের বিরুদ্ধে ছিল না। বরং জামায়াত সবসময়ই হিন্দুদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। সংখ্যালঘুদের বাসা বাড়ীতে কোন হামলার ঘটনা ঘটলেই একশ্রেণীর দলদাস মিডিয়া মনের মাধুরী মিশিয়ে জামাত-শিবিরকে দায়ী করে সংবাদ প্রচার করে। অথচ জামায়াতে ইসলামের সাবেক নায়েবে আমীর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসিরে কুরআন মরহুম আল্লাম্মা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব একাধিকবার হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। একশ্রেণীর মিডিয়া জামায়াতে ইসলামীর ইতিবাচক খবর কোনোদিন তাদের পত্রিকা কিংবা মিডিয়াতে প্রকাশ করেনি। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে জামায়াতের কোন দোষ খুঁজে না পেলেও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। অথচ ৫ আগস্টের পর পরই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর দেশবাসী ও দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন- সারা দেশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির বা উপাসনালয়ে যে কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যেন আক্রমণ না করতে পারে সে জন্য তিনি জামাত-শিবিরকে পাহারা দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।

তার এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং এর সহযোগী সংগঠনের হিন্দু কর্মীরা উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যাতে ষোড়শ শতাব্দীর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে তখনও বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী হিন্দুদের মন্দির পাহারা দিয়েছিল। যার একটি ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেও। সেসময় কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর সাংবাদিক একে এম রুহুল আমীন জীবন বাজি রেখে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে রাত জেগে কটিয়াদী শহরের মন্দিরগুলোকে পাহারা দিয়েছিলেন।

একটি গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে জনগণের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের কল্যাণে কাজ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য অদ্যাবধি পর্যন্ত কোন সরকারই ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে জনগণের কল্যাণের কথা বলে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের অধিকারের কথা ভুলে যায়। অথচ জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না থেকেও জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। নিকট অতীতে করতোয়া নদীর তীরে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া স্বজনদের উদ্দেশে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছিলেন- ‘‘আপনাদের মায়ার টানে এসেছি। আপনজন হারানোর বেদনা অপূরণীয়। জামায়াত স্বজনহারাদের পাশে থাকার চেষ্টা করবে। সব কিছুর ওপর মানবতা। জামায়াত যে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে তা সামান্য। নৌকাডুবিতে মৃত্যু ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষের কষ্ট। তা লাঘবে রাজনৈতিক দলসহ সবার এগিয়ে আসা উচিত। তিনি আরো বলেন- নৌকাডুবির ঘটনা একটি বড় মানবিক বিপর্যয়। এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু দেশের ইতিহাসে বিরল। নিহতরা সবাই হিন্দু ধর্মের হলেও আমরা বিষয়টি সেভাবে দেখছি না। আমরা দেখেছি মানুষ। আর মানুষ বিপদে পড়েছে, আমরা পাশে দাঁড়িয়েছি। এই সহযাগিতা আমাদের দয়া কিংবা অনুগ্রহ নয়; বরং দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সামাজিক দায়িত্ব।

তাছাড়া দুঃখের সময় পাশে দাঁড়ানো এক প্রকার সৌভাগ্য।’’ (সূত্র ঃ ২৮ সেপ্টেম্বর ২২,সমকাল)। ৮ আগস্ট রাজধানী ঢাকেশ^রী মন্দির পরিদর্শনকালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান কত চমৎকার কথাই না বলেছেন-শুধু মন্দির নয়, কোন ব্যক্তিও যদি নিরাপত্তাহীন মনে করেন, তার পাশেও যেন জামাত-শিবির দাঁড়ায়। আমরা কোন হিংস্রতা সৃষ্টি করতে দিবো না। বাংলাদেশে কোন সংকট তৈরি হলে দুষ্কৃতকারীরা অপকর্ম করে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। সংকটকালে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা কাপুরুষতা মাত্র। তবে যারা অপরাধের সাথে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কারো বাহবা নেয়া বা রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য আমরা আপনাদের পাশে দাঁড়াইনি। মানুষ হিসেবে, নাগরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে আমাদের কেউ কিছু করলে আমরা ব্যবস্থা নিবো। এ ধরনের ঘটনাকে দূরতম প্রশ্রয় দিবো না। বাংলাদেশে যারা জন্মগ্রহণ করেছে তারা সবাই দেশের গর্বিত নাগরিক। নাগরিক সুবিধা পেতে ধর্ম কোন বাধা হতে পারে না। কারো ধর্ম কারো উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। যে যেই দলই করুক না কেন, সবাই নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। এই দেশ আমাদের সকলের। আমরা সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু মানি না। এরকম আচরণ প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের প্রধানদের কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশা করি। আশা করি যারাই ক্ষমতার চেয়ারে বসবেন তারাই দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের বিপদে এগিয়ে আসবেন, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যশা।

দৈনিক সংগ্রাম