অপরাধ দমনে প্রযুক্তির ভূমিকা এখন অপরিহার্য। তবে প্রযুক্তি কেবল একটি উপকরণ এর সঠিক ও নৈতিক ব্যবহার, দক্ষ মানবসম্পদ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগই পারে অপরাধ দমন কার্যক্রমকে সফল করে তুলতে। আমরা যদি প্রযুক্তিকে অপরাধের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তবে একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন আর দুঃস্বপ্ন নয়। আমাদের এই দেশ এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে।
বর্তমান বিশ্বের অপরাধের ধরন যেমন পরিবর্তিত হচ্ছে, তেমনি অপরাধ দমনের পদ্ধতিতেও ঘটছে পরিবর্তন। একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির উন্নয়ন আমাদের সমাজব্যবস্থার প্রতিটি খাতে যেমন প্রভাব ফেলেছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ দমনেও এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আজকের দিনে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালানো কল্পনাতীত।
আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি সিসিটিভি ক্যামেরা বর্তমানে অপরাধ দমনে অন্যতম কার্যকর প্রযুক্তি। বিশেষ করে নগর এলাকায় সিসিটিভির নেটওয়ার্ক অপরাধের চিহ্নিতকরণ, অপরাধীর গতিবিধি অনুসরণ এবং দ্রুত তদন্তে পুলিশকে অনেক সহায়তা করে। কিছুদিন আগে রাজধানীতে কয়েক যুবকের হাতে নির্মমভাবে খুন হন ব্যবসায়ী সোহাগ মিয়া, সিসিটিভির কল্যাণে ধরা পড়ে সন্ত্রাসীরা। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহর ও বিভিন্ন জেলা শহরে সিসিটিভির প্রসার ঘটেছে, যা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়েন্দা নজরদারিতে গতি এসেছে। ডিজিটাল গোয়েন্দা কার্যক্রম এখন অপরাধ দমনের মূল অস্ত্র। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন মোবাইল ফোন, ইমেইল, অনলাইনে লেনদেন এসব জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অনেক অপরাধের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়েছে।
কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটার সাথে সাথে নিহতের নম্বর কব্জায় নেয়া হয়। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ এবং সেখানে অবস্থানরতদের ফোন নম্বর যাচাই-বাছাই করে সন্দেহভাজনদের দিয়ে তৈরি হয় অপরাধীর তালিকা। অন্যান্য জটিল অপরাধ শনাক্তেও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ ঘটামাত্রই খোঁজা হয় সংশ্লিষ্ট এলাকায় কোনো সিসি ক্যামেরা আছে কি না। এরপর অপরাধ শনাক্তে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়। কোথাও ক্যামেরা না থাকলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী সন্দেহভাজন ব্যক্তির চেহারা এঁকে ফেলার প্রযুক্তিও অনেক আগে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে রয়েছে। আধুনিক সাইবার মনিটরিং টুলস ব্যবহার করে সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালান, অর্থপাচার ইত্যাদি অপরাধ দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি এখন অপরাধ বিশ্লেষণে ব্যবহার হচ্ছে। অপরাধের ধরন, সময়, স্থান ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে কোথায় কী ধরনের অপরাধ ঘটতে পারে, তা আগাম ধারণা দিয়ে থাকে এই প্রযুক্তি। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে Predictive Policing টুল ব্যবহারে পুলিশের টহল কার্যক্রম আরো কার্যকর ও সময়োপযোগী হয়েছে। এ দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ যন্ত্রপাতির সাথে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক রোবট। দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটগুলো বোমা খোঁজা ও নিষ্ক্রিয় করার কাজও করছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের দিন শেষ। এখন প্রযুক্তি কঠিন কাজও সহজ করে দিয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, এন্ট্রি টেররিজম ইউনিট, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা অপরাধ তদন্তে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে।
ফরেনসিক প্রযুক্তির উন্নয়ন, ডিএনএ বিশ্লেষণ, ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যান, ডিজিটাল ফরেনসিক এগুলো অপরাধ প্রমাণে ও অপরাধী চিহ্নিতকরণে আজ অপরিহার্য। আমাদের দেশে ক্রমাগত ফরেনসিক ল্যাবরেটরির উন্নয়ন ঘটছে, যা বিচারপ্রক্রিয়াকে আরো কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য করে তুলছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ডোমের সহযোগী হিসেবে কাজ করত মুন্না। রাতে লাশ পাহারা দেয়ার সুযোগে তরুণীদের মৃতদেহের সাথে শারীরিক সংস্পর্শে লিপ্ত হতো। একে একে ছয় তরুণীর লাশের ডিএনএ পরীক্ষায় যখন একই অপরাধীর ডিএনএর মিল পাওয়ায় সিআইডি তদন্তে নামে। পরে কৌশলে মুন্নার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করলে মিলে যায়। এরপর মুন্নাকে গ্রেফতার করলে সে তার অপরাধ স্বীকার করে। ফরেনসিক ওয়ার্কস্টেশনে (অত্যাধুনিক ল্যাপটপ) বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে যেকোনো ল্যাপটপ থেকে যেকোনো তথ্য বের করে আনা হয়।
ফরেনসিক ইমার্জিং সিস্টেম টিডিথ্রি সরঞ্জাম ব্যবহার করে যেকোনো হার্ডডিস্ক থেকে তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব। পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্ন দিয়ে বন্ধ করে রাখা মোবাইলের ওপর বিশেষ ক্যামেরা ধরলেই বেরিয়ে আসে ওই পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্ন। সার্ভার ও কম্পিউটারের সংরক্ষিত অসংখ্য তথ্যের মধ্যে কাক্সিক্ষত তথ্য খুঁজে দেয় ডাটা রিকভারি স্টিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যদি কেউ অশ্লীল কিছু ছড়িয়ে দেয়, পরে নিজের মোবাইল ফোন থেকে তা মুছে ফেলে তাহলেও ডিজিটাল ময়নাতদন্তে সেটিও বের করে আনতে পারে ল্যাবটি। ফরেনসিক প্রযুক্তির সেবাগুলো জেলাপর্যায়ে নিয়ে আসতে পারলে অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করা যেত। আগে অধিকাংশ মামলাই শনাক্ত হতো সোর্সের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে। বর্তমানে ৯০ শতাংশের বেশি মামলার তদন্ত করা হয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
বাংলাদেশ পুলিশ বর্তমানে ‘স্মার্ট পুলিশিং’ ধারণা বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর কাছে এখন রয়েছে বডি ক্যামেরা, জিপিএসযুক্ত গাড়ি, মোবাইল অ্যাপস এবং রিয়েল-টাইম রিপোর্টিং সিস্টেম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরুরি সেবা ৯৯৯ এবং বিশেষ কিছু অ্যাপের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে জনগণের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটি) ইউনিটের অ্যাপ ‘Hellow City’ এবং ‘Report to Rab’ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে তথ্য পেয়ে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ধরা সহজ হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া যেমন- ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকর্তাকে অপরাধ সম্পর্কে তথ্য দিয়ে থাকেন সাধারণ মানুষ। এসব প্রযুক্তি পুলিশের কাজের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি নাগরিকদের আস্থা অর্জনে ভূমিকা রাখছে। আগে অধিকাংশ মামলাই শনাক্ত হতো সোর্সের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে। বিভিন্ন সময় সোর্সরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে থাকত। সোর্সরা বিভিন্ন অপরাধসহ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া অপরাধগুলোর মধ্যে সাইবার অপরাধ অন্যতম। হ্যাকিং, অনলাইন প্রতারণা, সামাজিক মাধ্যমে হয়রানি- ইত্যাদি প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ দমনে এখন প্রয়োজন সাইবার ইউনিটের দক্ষতা ও পরিসর বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশে ‘সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ’ ইতোমধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জটিল সাইবার অপরাধের সফল তদন্ত করেছে।
অপরাধ দমনে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন সুফল বয়ে আনছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এক দিকে যেমন অপরাধীরাও প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিন দিন চতুর হচ্ছে, তারা অপরাধের ধরন পরিবর্তন করছে। দক্ষ, প্রশিক্ষিত প্রযুক্তির জনবল তৈরি করতে না পারলে অপরাধের মাত্রা জ্যামিতিকহারে বেড়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অন্য দিকে প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব এ সব বিষয় প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ দমন ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। এ ছাড়াও প্রযুক্তির ব্যবহার যেন নাগরিকদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন না করে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। প্রযুক্তিকে হতে হবে আইন ও নৈতিকতার সীমার মধ্যে। নাগরিকদেরও সচেতনতা, তথ্য নিরাপত্তা জ্ঞান এবং প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার অপরাধ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামগ্রিকভাবে বললে, অপরাধ দমনে প্রযুক্তির ভূমিকা এখন অপরিহার্য। তবে প্রযুক্তি কেবল একটি উপকরণ এর সঠিক ও নৈতিক ব্যবহার, দক্ষ মানবসম্পদ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগই পারে অপরাধ দমন কার্যক্রমকে সফল করে তুলতে। আমরা যদি প্রযুক্তিকে অপরাধের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তবে একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন আর দুঃস্বপ্ন নয়। আমাদের এই দেশ এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে।
লেখক : প্রযুক্তিবিদ