দেশে যে খাতে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে তার অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায়, এসব নিয়ে লেখালেখির রুচিও চলে গিয়েছিল। লিখলেই বা কী? কে শোনে কার কথা!
এখন নাকি অবস্থার একটু উন্নতি হয়েছে। তাই কিছুটা লিখে রাখছি। পাদটীকা হিসেবে জানিয়ে রাখি, এর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সুবিধার সুযোগ নেই। আমি সরকারের কোনো প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, ভবিষ্যতেও থাকার ইচ্ছা নেই। তাই নির্মোহভাবে লেখাটি পড়ে অ্যাকশন নিলে দেশের কিছুটা কাজে লাগলেও লাগতে পারে!
২.
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর দুটি বিষয়ে অনুরোধ করেছিলাম।
ক. তথ্যপ্রযুক্তি খাতের দুর্নীতির শ্বেতপত্র বের করা। বিভিন্ন সময়ে শুনতে পাই, এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। যেহেতু এখনও সেটা হয়নি, বিষয়টা দাঁড়াল– ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’! ধরে নিচ্ছি, এটা করার মতো ক্যাপাসিটি সরকারের নেই। সরকারের সব ধরনের ক্যাপাসিটি থাকবে, তা তো নয়!
খ. ফ্রিল্যান্সারদের ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া। সরকার এটা করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। বুঝতে পারলাম, সরকারে তথ্যপ্রযুক্তি বোঝা লোকজন তেমন নেই। যে সাবজেক্ট কেউ বোঝে না, তাকে কতটা বোঝানো যেতে পারে! তাদের তো সেটা বোঝার মতো সক্ষমতা থাকতে হবে। ছোটবেলায় পদার্থবিদ্যার শিক্ষক শিখিয়েছিলেন, কাঠের টেবিলের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় না! পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারি, তিনি ঠিক কী শিখিয়েছিলেন।
তাই ধরেই নিয়েছি, এখন যে বিষয়গুলো নিয়ে লিখছি, সেটাও বুঝতে পারার মতো মানুষ সরকারে নেই। কাজের কাজ কিছুই হবে না। যেহেতু বিষয়গুলো জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই নিজের লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে অনুরোধটুকু করছি।
৩.
বুয়েটের কয়েকজন খ্যাতনামা অধ্যাপক দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বড় বড় প্রকল্পের বড় ধরনের ভুল, অনিয়ম ও কোটি কোটি টাকা নষ্টের কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন। তেমন একটি মিটিংয়ে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম। তাদের কিছু তথ্য দেখে চোখ ছানাবড়া!
প্রকল্পগুলোর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তারা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। আমি পুনরায় একই বিষয়ের অবতারণা করলাম না। অধ্যাপক সবাই আমার বিভাগের, আমার অনেক পরের ব্যাচ। তারা দেশের জন্য কিছু করতে চাইছেন। তাদের কথা শুনে মনটা খারাপ হলো। তাই লিখতে বসেছি।
সেই সভায় পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছিলাম। প্রকল্পগুলোর সঙ্গে যেহেতু দেশের মানুষের টাকা সরাসরি যুক্ত, কাজগুলো করতে পারলে কিছু প্রকল্প হয়তো সঠিকভাবে হবে এবং দেশের কাজে লাগবে।
জাতীয় কমিটি গঠন
তথ্যপ্রযুক্তি জটিল জ্ঞাননির্ভর খাত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলে আসার পর এটি আরও বেশি ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে। আগে যে কাজ করতে এক বছর লাগত, এখন সেই কাজ করতে এক মাসও লাগছে না। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশকে সামনে নিতে হলে চৌকস বিশেষজ্ঞ লাগবে। হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে লুটপাট হবে, আসল কাজটা হবে না। তাই দ্রুত একটি জাতীয় টাস্কফোর্স কিংবা ‘ভেটিং কমিটি’ করে দিতে পারে, যাদের দায়িত্ব হবে বড় প্রকল্পগুলো একনেকে যাওয়ার আগেই ভেটিং করে অনুমোদনের জন্য পাঠানো। ৭ থেকে ১১ জনের এ কমিটিতে যারা নিয়মিত সময় দিতে পারবেন, তাদেরকেই নেওয়া যেতে পারে।
পাবলিক ভেটিং
জাতীয় কমিটি বড় প্রকল্পগুলোকে পাবলিক ভেটিংয়ে দিতে পারে। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা মতামত দিতে পারেন। তাতে প্রতিটি প্রকল্পে ট্রান্সপারেন্সি থাকবে।
তথ্যপ্রযুক্তি এখন এমন দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে একজন মানুষের পক্ষে একটার বেশি দুটোতে দক্ষতা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যিনি সফটওয়্যার আর্কিটেকচার জানেন, তিনি হয়তো নেটওয়ার্কিং জানেন না। আবার যিনি সাইবার সিকিউরিটি জানেন, তিনি হয়তো ডেটা সেন্টার বোঝেন না। আবার যিনি এআই বোঝেন, তিনি হয়তো ইউজার ইন্টারফেস বোঝেন না কিংবা সেই বিষয়ে জ্ঞান নেই। এটিই স্বাভাবিক! তাই প্রথাগত সবজান্তা কনসালট্যান্টদের পাশাপাশি পাবলিক ভেটিং খুবই কাজের হবে। এখানে কেউ নামহীন মন্তব্য করবে না। তারা নিজের অ্যাকাউন্ট খুলে, নিজের পরিচয় দিয়ে প্রফেশনাল মতামত দেবেন। পাশাপাশি দেশের মানুষের ক্যাপাসিটি তৈরি হবে। তারা জানবে, ভবিষ্যতে কোন কোন প্রকল্প আসতে যাচ্ছে এবং তার সঙ্গে তারা কীভাবে যুক্ত হতে পারে। অনেক সমাধান দেশের ছেলেমেয়েরাই করে ফেলবে। ইন্টারনেটের যুগে এটা করা কোনো বিষয়ই নয়!
রিভিউয়ে পর্যাপ্ত বরাদ্দ
এখন যাবতীয় প্রকল্প রিভিউ করে বুয়েটসহ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তারা এটাকে মূলত কনসালট্যান্সি হিসেবে নেয়। যদি বাইরে থেকে কেউ ভালো রিভিউ দেয়, তাকেও সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা ওই কনসাল্টিংয়ের মতো একই মানের টাকা দিতে দিন। তাতে অনেক অভিজ্ঞ মানুষ তাদের জ্ঞান দিয়ে সহযোগিতা করতে পারবে। এগুলো সিরিয়াস কাজ। মানুষ নিজের কাজ ফেলে কেউ হয়তো রিভিউ লিখতে চাইবে না। কিন্তু ওয়েবসাইটে যদি সরাসরি রিভিউ নেওয়া হয় এবং সেটা
যদি দেশের কাজে লাগে, তাহলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ফি দিতে সমস্যা কোথায়?
যা অখাদ্য দেশি-বিদেশি কনসালট্যান্ট রাখা হয়, তাতে তো কোটি কোটি টাকা এমনিতেই নষ্ট হচ্ছে। পাবলিক কনসালটেশন নিলে এবং তার বিনিময়ে ফি দিলে তখন অনেক সিরিয়াস লেভেলের আউটপুট পাওয়া যাবে। একেকটি মানুষ একেক দিকে জ্ঞান রাখে। এটা এত দ্রুত পরিবর্তনশীল যে নতুন বিষয়টি না নিতে পারলে পুরোনো বিষয়ে সমাধান কাজে নাও লাগতে পারে।
এনআরবি যুক্ত করা হোক
বাংলাদেশ গত ৩০ বছরে যত তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তৈরি করেছে, তাদের প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে চলে গেছে, এখনও যাচ্ছে। বুয়েট প্রতিবছর যে গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে, তার ৯০ শতাংশই চলে যায় দেশ ছেড়ে। তাতে দেশের লাভটা হলো কী? কিন্তু এরা পৃথিবীর সব নামকরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। তাদের বিভিন্ন এরিয়াতে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তাদের কাজে লাগাতে না পারাটাই আমাদের চরম ব্যর্থতা। প্রতিটি প্রকল্পে প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করুন। তাদের ফি দিন। দেখবেন, তারা দারুণ সব সমাধান বাতলে দেবে, অনেক কম খরচে দুর্দান্ত সব প্রকল্প নামিয়ে দেবে। সরকারের ধারণাই নেই, আমাদের ছেলেমেয়েরা কী চমৎকার কাজ করতে পারে।
মাইন্ডসেট বদল
বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিষয় হলো কম্পিউটার সায়েন্স। এটি অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। অন্য সাবজেক্টগুলো এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে না। এআই আসার পর দ্রুততর হয়ে উঠেছে। তাই আপনারা যারা এই লাইনের নন, অন্য এরিয়াতে লেখাপড়া করছেন, আপনাদের পক্ষে এটা বুঝতে না পারাটাই স্বাভাবিক। আপনি হয়তো মনে করছেন, আরে, এটা আর এমন কী!
কিন্তু আমি লিখে দিচ্ছি, আপনি ওটার কিছুই বোঝেননি। যেসব মানুষ দিনরাত ওটার ভেতর আছে, তারাই বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে; আর যারা এর আশপাশে থেকেই মনে করে ফেলছেন, সব বুঝে ফেলছেন– এটাই হলো চরম নির্বুদ্ধিতা। একজন বুদ্ধিমান মানুষ প্রথমেই বলবে, ওহ, এটা তো আমার সাবজেক্ট নয়; আমি এটা বুঝি না– আমাকে একটু হেল্প করো, প্লিজ। তখনই পরিবর্তন আসতে শুরু করবে।
চেঞ্জ ইউর মাইন্ডসেট, বিফোর ইউ ক্যান চেঞ্জ দ্য কাউন্ট্রি!
আর যদি সেটা না পারেন, বুঝতে হবে দেশটার কপালই খারাপ! এভাবেই ধুঁকে ধুঁকে এই জাতিকে বেঁচে থাকতে হবে। এ দেশের জন্য এত লোক প্রাণ দিয়েছে, তাতে কী হয়েছে! ভবিষ্যতেও এভাবেই চলবে! পরিবর্তন আগে নিজের ব্রেন থেকে শুরু করেন!
জাকারিয়া স্বপন: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
বিষয় : গণঅভ্যুত্থান