স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময় নানা সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল, কিন্তু কোনোটি পর্যাপ্ত পরিমাণে সফল হতে পারেনি। সংস্কার প্রণয়নের সময় দৃশ্যপটের বাইরের অনেক উপাদানকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। ফলে সংস্কার উদ্যোগগুলো বাংলাদেশে ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের কর্তৃত্ববাদবিরোধী অঙ্গীকার আশা দেখালেও বাস্তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে ‘সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ (সংশোধিত), ২০২৫’ নিয়ে সচিবালয় অবরোধ কর্মসূচি। বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। অনুসরণের পরিবর্তে পৃথিবীর বিভিন্ন সফল প্রতিষ্ঠান এবং সংস্কারের প্রতি অনুকরণপ্রিয়তা আমাদের উদ্যোগগুলোকে আইসোমরফিক মিমিক্রিতে পরিণত করেছে। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে দেখতে চমকপ্রদ হলেও এসবের কার্যকারিতা ঠিক বিপরীত। অনেক সময় বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠান, যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতির চাপেও আমরা এ ধরনের সংস্কার গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সিভিক কালচারের অনুপস্থিতি প্রকট। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি এবং আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র ঔপনিবেশিক শাসন সুসংহত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এ কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি। ১৯৯১ সালের পরও সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতিকীকরণ দেখা গেছে। বাংলাদেশের চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোতে (আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, সরকারি কর্মচারী, এনজিও প্রভৃতি) রাজনৈতিক বিভাজন খুবই প্রকট এবং শক্তিশালী। বিগত সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল এবং বৈধতা অর্জনের জন্য সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ব্যবহার করেছে। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টা করেছে। এ অবস্থায় শুধু আইন দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে এ আইনের অপব্যবহার হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে।
সরকারি চাকরিতে পদন্নোতি, বদলিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের পরিবর্তে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ও রাজনৈতিক পরিচয় বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। দেখা গেছে, যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পুরস্কার পেয়েছেন, পরবর্তী সময়ে তাঁরা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার অনেকে শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন। কেননা তাঁরা পদোন্নতিবঞ্চিত। অর্থাৎ কাজের দক্ষতা ও সততা পেশাগত অগ্রগতির জন্য পর্যাপ্ত নয়। এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার আশঙ্কা রয়েই যায়। অধ্যাদেশে আপিল করার সুযোগ থাকলেও বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে অনাস্থা সৃষ্টি করেছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি অনেকটা কমলেও সময়ের পরিক্রমায় দিন দিন তা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার দুর্নীতির বিভিন্ন নেটওয়ার্ক ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এসব সংস্কারের প্রতি পূর্ণ আস্থা অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে ২০২৪ সালের ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী বাংলাদেশের রাজনীতি জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে বলে ধারণা করা যায়। ক্ষমতায় যে রাজনৈতিক দলই থাকুক না কেন, তারা সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ অনুভব করবে বলে আশা রাখা যায়।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, সচিবদের একটি বড় অংশ এবং উপদেষ্টাদেরও কিছু অংশ অধ্যাদেশটি জারির বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু কয়েকজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার চাপে এটি জারি করা হয় বলে দাবি করা হয়েছে। এখানে উদ্দেশ্য মহান থাকলেও কৌশলগত ভুল রয়েছে। পর্যাপ্ত আলোচনা, বিতর্ক ও পরিস্থিতি বুঝে পরিমার্জন না করেই এটি জারি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। এখানে প্রকৃতপক্ষে অন্তর্ভুক্তিমূলক সুশাসনচর্চা অনুপস্থিত ছিল। ফলে এ অধ্যাদেশ যারা জারি করবে (যাদের আমরা এজেন্ট বলি), তারা এটি অনিচ্ছা সত্ত্বে আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে মেনে নিয়েছে এবং বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করেছে। ফলে প্রিন্সিপাল বা নীতি প্রণয়নকারীদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এজেন্টের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষণীয়। এই ধারাবাহিকতায় অধ্যাদেশটির বিরোধিতা করে প্রথমে সচিবালয়ে আমরা অবাধ্যতা দেখতে পাই। সচিবালয়ের বিভিন্ন কক্ষে তালা মেরে দেওয়া হয় এবং প্রায় সব সেবা প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি মেনে না নেওয়া হলে এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।
বিভিন্ন গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল এই আন্দোলন ম্যানিপুলেট করতে শুরু করে। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে এক দল সমালোচনা এবং এক দল সমর্থন দিয়ে নিজ নিজ প্রচার শুরু করে এবং রাজনৈতিক চর্চায় বহাল থাকে। এসব গোষ্ঠী এটিকে একটি রাজনৈতিক প্রচারণা হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা আগামীর নির্বাচনে একটি বৃহৎসংখ্যক ভোট পাবে বলে আশা রাখে। এরই ফলে একটি আপসের ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়। সংস্কার প্রস্তাবে বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে অসামঞ্জস্য রয়েছে এবং প্রশাসনিক ক্যাডারদের অতিমাত্রায় প্রাধান্য দেওয়ার মতো সমস্যাগুলো দূর করা হয়নি। উপরন্তু প্রশাসনিক ক্যাডারদের সচিব হওয়ার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ সরকারের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় পরিচয়ভিত্তিক প্রমোশনের হিড়িক পড়েছিল, অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের কাজে ফিরিয়ে আনার মতো প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছে। ফলে আমলাতন্ত্র যে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে, এ বিশ্বাস জনমনে নেই বললেই চলে।
রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাবেই সংস্কার প্রস্তাবে এ ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। ব্রিংকারহফ নামের এক গবেষক রাজনৈতিক ইচ্ছার (স্থানীয় উদ্ভাবন, বিশ্লেষণাত্মক কঠোরতা, স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্তকরণ, বিশ্বাসযোগ্য শাস্তি, ধারাবাহিকতা) যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, তা এখানে অনুপস্থিত ছিল। এখানে সমস্যা সমাধানের স্থানীয় উদ্ভাবন নেই। পশ্চিমা কায়দায় আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফলাফল পাওয়া যাবে বলে ধারণা পোষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ একটি শক্তিশালী আইন থাকলে সবাই এটি মেনে চলবেন এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিস্বার্থ এড়িয়ে চলবেন। প্রকারান্তরে এখানে মাধ্যমকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সমাজে বিদ্যমান অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ভালো ফল প্রত্যাশা করা যেতে পারত।
অংশীজনদের সম্পৃক্তকরণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ওপরের স্তর থেকে নিচের স্তরে এগোনোর প্রক্রিয়া পরিহার করে, নিচ থেকে ওপরের স্তরে এগোনোর প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে সংস্কারের প্রতি অবাধ্যতা মোকাবিলা করা যেত। এ ছাড়া পদমর্যাদায় বড় কর্মকর্তাদের দুর্নীতির দায়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করলে স্বাভাবিকভাবেই অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতিবিমুখতা বাড়ত। অবশ্যই এসব কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে এবং ক্ষমতায় যে–ই আসুক না কেন, একটি কমিটমেন্ট নিশ্চিত করতে পারলে প্রতিটি সংস্কার সফল হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন সংস্কার হাতে নিয়েছে।
তথাপি এ সরকারের স্বল্প মেয়াদ ও অরাজনৈতিক অবস্থান এসব বাস্তবায়নের জন্য একটি বৈধতার সংকট সৃষ্টি করেছে। এ সংস্কারগুলোকে যদি একটি সামাজিক চুক্তি হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে তা বাস্তবায়নের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার লাগবে। যদিও বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুপারিশগুলো পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সামান্যতম বাস্তবায়িত করেছিল। তবে ২০২৪ সালের ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী বাংলাদেশের রাজনীতি জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে বলে ধারণা করা যায়। ক্ষমতায় যে রাজনৈতিক দলই থাকুক না কেন, তারা সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ অনুভব করবে বলে আশা রাখা যায়।
● ড. নুরুল হুদা সাকিব অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও
● সাহাবুদ্দীন আহমেদ প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
* মতামত লেখকদের নিজস্ব