একটি রাষ্ট্রের সবচাইতে শক্তি আর কিছু নহে-তাহা হইল জাতীয় ঐকমত্য। বহু বৎসর পূর্বে এই ব্যাপারে আব্রাহাম লিংকন বলিয়া গিয়াছিলেন- 'একটি গৃহ যদি নিজের ভিতরেই বিভক্ত হয়, তাহা হইলে তাহা স্থায়ী হইতে পারে না।' পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সংঘাত-সহিংসতা থাকে, একটি দলের সহিত অন্য দলের মতাদর্শও মিলে না। ইহা স্বাভাবিক বিষয়; কিন্তু প্রতিটি দেশের মধ্যে কিছু মৌলিক বিষয় থাকে- যেইখানে সকলের মধ্যেই ঐক্য থাকে। রাষ্ট্রের বৃহত্তর কোনো ইস্যু লইয়া দলমতনির্বিশেষে তাহারা একমত থাকেন; কিন্তু এমন কিছু রাষ্ট্র রহিয়াছে, যাহাদের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতা যেমন রহিয়াছে, তেমনি রহিয়াছে দেশের প্রশ্নে অনৈক্য। দেশের প্রশ্নে এই ঐক্য না থাকাটা যে কোনো দেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, জাতীয় প্রশ্নে ঐক্য না থাকিলে সেই দেশে কখনোই স্থিতিশীলতা ও শান্তি আসে না। এই জন্য বলা হয়, একটি রাষ্ট্রের ভাঙন ঘটে মূলত তখনই, যখন উহার অভ্যন্তরীণ অনৈক্য ও বিদ্বেষ লাগামহীনভাবে বাড়িয়া যায়। সেই রাষ্ট্র তখন কেবল রাজনৈতিকভাবেই বিভক্ত নহে, অস্তিত্বগতভাবে ভঙ্গুর হইয়া পড়ে। বিশ্বে বহু উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এমন সংকটের সম্মুখীন হইয়াছে। আফ্রিকার হর্ন অব আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র-সোমালিয়া উদাহরণস্বরূপ উল্লিখিত হইতে পারে।
সোমালিয়া দীর্ঘকাল রাজনৈতিক গৃহবিবাদে জর্জরিত। ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের পতনের পর দেশটি কার্যত বিভক্ত হইয়া পড়ে-নানা আঞ্চলিক গোষ্ঠী, গোত্র ও যুদ্ধবাজ নেতা আপন নিজস্ব ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করিতে থাকে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী মিশন, বহু সম্মেলন ও কূটনৈতিক উদ্যোগ সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত সোমালিয়ার মূলধারার রাজনৈতিক শক্তিসমূহ 'জাতীয় রাষ্ট্র' ধারণার উপর ঐকমত্যে পৌঁছাইতে পারে নাই। তাহারা ঐক্য গড়িতে ব্যর্থ, কারণ তাহারা রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণের চাইতেও নিজ নিজ মতবাদকে উচ্চতর মনে করিয়া থাকে। ফলে দেশের সাধারণ নাগরিক বঞ্চিত হইয়াছে ন্যূনতম নিরাপত্তা, শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্যসেবার অধিকার হইতে।
আবার এশিয়ার একটি ভূখণ্ডীয় রাষ্ট্র-মিয়ানমার রাজনৈতিক অনৈক্যের আর একটি দৃষ্টান্ত। সামরিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরিয়া চলমান বিরোধের ফলে দেশটি নাগরিক যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে পতিত হইয়াছে। ইউরোপেও এমন নজির একেবারে অনুপস্থিত নহে। বসনিয়া ও হারজেগোভিনা-যাহা ১৯৯০ দশকে যুগোস্লাভিয়া ভাঙনের পর স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়-আজও একটি খণ্ডিত রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে টিকিয়া রহিয়াছে। দেশটিতে বসনিয়াক, সার্ব এবং ক্রোয়াট-এই তিনটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এমন গভীর অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বিরাজমান যে, জাতীয় নির্বাচনেও তিনটি আলাদা প্রেসিডেন্সি পরিচালিত হয়। যুদ্ধ থামিয়াছে; কিন্তু 'রাষ্ট্র' গঠনের প্রকৃত অর্থ সেইখানে বাস্তবায়িত হয় নাই।
সুতরাং জাতিগত বিভাজনকে রাজনৈতিক বিভক্তিরূপে পোষণ করিলে, রাষ্ট্র কখনো ফাংশনাল হইতে পারে না। এই সকল উদাহরণের ভিতরে একটি অভিন্ন বিষয় লক্ষ করা যায়। তাহা হইল, যেইখানে রাজনৈতিক দলসমূহ জাতির মৌলিক স্বার্থে একমত হইতে ব্যর্থ হয়, সেইখানেই রাষ্ট্র হইয়া পড়ে নেতৃত্বহীন, দিশাহীন ও জনবিচ্ছিন্ন। রাজনীতির উদ্দেশ্য তখন আর রাষ্ট্রগঠন নহে, বরং প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করাই হয় মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত হইতে উপলব্ধি করা যায়, এই অনৈক্য দীর্ঘ দিন ধরিয়া চলিলে একটি রাষ্ট্রকে ভাঙিয়াও ফেলিতে পারে। ইহা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, রাষ্ট্র মানে কেবল ভৌগোলিক সীমারেখা নহে, রাষ্ট্র একটি চেতনা-যাহা দাঁড়াইয়াই থাকে জাতীয় ঐকমত্যের উপর। সেই চেতনাকে যদি প্রতিদিন রাজনীতির প্রতিহিংসায় ক্ষতবিক্ষত করা হয়, তাহা হইলে সেই রাষ্ট্রে কখনোই স্থিতিশীলতা আসে না। অন্যদিকে যেই দেশে দলমতের ঊর্ধ্বে 'রাষ্ট্র' নামক বোধটি সম্মানিত হয়, সেই দেশই আন্তর্জাতিক পরিসরে মর্যাদার আসনে উপবিষ্ট হইতে পারে। এই জন্য যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলিয়া গিয়াছিলেন, 'আমাদের অবশ্যই ভ্রাতৃপ্রতিম হইয়া একসঙ্গে বাস করিবার শিক্ষা লইতে হইবে, নচেৎ আমরা একসঙ্গে ধ্বংস হইব মূর্খের মতো।'