নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে স্বাগত জানাতে লালগালিচা বিছিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের দেশে চীনা নেতার সঙ্গে নদীর তীরে দোলনায় বসে গল্প করেছিলেন এই আশায় যে চীনের মতো ভারতও একদিন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করবে।

কিন্তু মোদি ও চিন পিংয়ের সেই দোলনাঝুলনের পরপরই সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে ভয়ংকর উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সংঘাত হয়েছিল। সেই সংঘাতের সময় চীন ভারতের অনেকখানি ভূমি দখল করে নিয়েছিল।

ওই ঘটনা মোদিকে বিব্রত করে এবং হিমালয় অঞ্চলের উচ্চভূমিতে কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার ভারতীয় সেনা মোতায়েন রাখতে বাধ্য করে। এটি ভারতের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে।

ওই ঘটনার পর মোদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকলেন। শীতল যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ধীরে ধীরে উষ্ণ হতে থাকা সম্পর্ককে দ্রুত এগিয়ে নিতে মোদি নিজের রাজনৈতিক পুঁজি খরচ করলেন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেই তাঁর সঙ্গে মোদির এমন সম্পর্ক গড়ে উঠল যে তিনি প্রটোকল ভেঙে হিউস্টনের স্টেডিয়ামে ভরা জনসমাবেশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ভারতীয় মার্কিন ভোটারদের কাছে ভোট চেয়ে বসলেন।

সেবার ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর জো বাইডেন এলেন। বাইডেন প্রশাসন দলীয় রাজনীতি উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ককে চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অংশীদারি হিসেবে আরও সম্প্রসারণ করতে লাগল। মোদি এক যৌথ অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘“এ. আই” মানে “আমেরিকা অ্যান্ড ইন্ডিয়া”।’

কিন্তু হঠাৎ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে মোদির জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ভারতকে নিশানা করে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, কারণ, ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনছে। ট্রাম্প ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি চলতি বছরের শুরুতে পাকিস্তানের নেতৃত্বকে ভারতের সমান মর্যাদা দিয়েছেন; যদিও এর আগে তিনি পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক বলেছিলেন। কিছুদিন আগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই বেঁধে যায় এবং কয়েক দিন পর দুই দেশ অস্ত্রবিরতিতে যায়। ট্রাম্প দাবি করেছেন, তাঁর মধ্যস্থতায়ই ভারত-পাকিস্তান বিরোধ মিটেছে।

ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর ট্রাম্প ও মোদির সম্পর্কের বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে

ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর ট্রাম্প ও মোদির সম্পর্কের বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছেফাইল ছবি

এসব ঘটনা ভারতের জন্য এক আত্মসমালোচনার মুহূর্ত তৈরি করেছে। কারণ দেখা যাচ্ছে, আকারে বিশাল ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান হলেও ভারতের বিশ্বমঞ্চে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মোদি স্বীকার করেছেন, এই বাণিজ্যবিরোধের কারণে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে।

এখন কিছুটা উষ্ণতা ফেরানোর জন্য চীনের সঙ্গে আবার ভারত যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। সাত বছর পর চলতি মাসের শেষে মোদির চীন সফরের কথা রয়েছে। তবে সীমান্ত সংঘাত ও পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতায় চীনের প্রকাশ্য সমর্থন সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়িয়ে রেখেছে। পাশাপাশি চীন ভারতকে বিকল্প উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে সন্দেহের চোখে দেখছে।

মোদি বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন। তিনি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা (যিনি নিজেও ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্যবিরোধে আছেন) এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন। উভয় পক্ষই ‘ভারত-রাশিয়া বিশেষ ও সুবিধাজনক কৌশলগত অংশীদারত্ব’ আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পুতিনের নয়াদিল্লি সফরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে মস্কো গেছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, সমস্যার মূল কারণ হলো এখন দুই দেশের সম্পর্ক রাষ্ট্রের বদলে দুই নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। ট্রাম্প আর মোদি দুজনই খুব ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও অহংকারী স্বভাবের। তাই সম্পর্কের ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা ভারতের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বপ্নে কিছুটা ধাক্কা দিয়েছে। দুই পরাশক্তি—যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে আটকে পড়েছে ভারত। এরা প্রয়োজনে ভারতকে চাপে রাখতে পিছপা হয় না। তাই ভারত আবার সেই পুরোনো নীতি ‘কৌশলগত স্বনির্ভরতা’য় ফিরতে চাইছে। মানে, কোনো বড় জোটে বেশি জড়িয়ে না পড়ে নিজের মতো করে চলতে চাইছে।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক নিরুপমা রাও বলেছেন, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত দুই দশক ধরে গড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্বের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাই ভারত এখন বাস্তবতা মেনে কৌশল বদলাবে, যাতে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা যায়।

ট্রাম্প যে অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক ভারতের ওপর চাপিয়ে দিলেন, সেটি হয়তো ভারতের ওপর চাপ তৈরি করার কৌশল। ভারত যাতে নতুন বাণিজ্যচুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মানতে বাধ্য হয়, সে কারণেই সম্ভবত এই নতুন শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এটি রাশিয়াকেও চাপ দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে, যেন তারা ইউক্রেন ইস্যুতে ছাড় দেয়।

রাশিয়ার তেলের ব্যাপারটি আলোচনায় আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যঘাটতি কমানো নিয়ে অগ্রগতি হচ্ছিল। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে রাজি হয়েছিল। কয়েক দফা আলোচনার পর দুই দেশের মধ্যে প্রথম ধাপের চুক্তি প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ভারত নিজের দীর্ঘদিনের সুরক্ষিত কৃষিবাজারও আংশিকভাবে খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

সাবেক জি-২০ দূত অমিতাভ কান্ত বলেছেন, ট্রাম্প অন্য মিত্রদেশগুলোর সঙ্গেও একই কৌশল ব্যবহার করেছেন। তাই এখনো একটি পারস্পরিক লাভজনক চুক্তির সম্ভাবনা আছে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, বাণিজ্য সমস্যা মিটলেও পারস্পরিক বিশ্বাস পুরোপুরি ফিরবে না।

চীনের আগ্রাসনের ঘটনায় দেখা গেছে, মোদি প্রকাশ্যে তেমন হইচই না করে শান্তভাবে সংকট সমাধানের চেষ্টা করেছেন। সীমান্তে চীনের হামলার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও নৌবাহিনীর সহযোগিতা বাড়ালেও সরাসরি চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার হয়ে কাজ করা থেকে বিরত থেকেছেন। এ কারণে গত অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ট্রাম্প যখন ভারতের ওপর বেশি শুল্ক বসালেন, তখন মোদি স্পষ্টভাবে বললেন, ভারত তার কৃষক, জেলে ও দুগ্ধশিল্পীদের স্বার্থে কোনো আপস করবে না। তিনি জানেন, এর জন্য তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে বড় রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে। তবু তিনি প্রস্তুত।

আসলে রাশিয়ার তেল কেনা নিয়ে বিরোধ শুরু হওয়ার আগেই সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল। বছরের শুরুতে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তে গোলাগুলির পর ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি দুই দেশকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছেন।

পাকিস্তান এ দাবিকে স্বাগত জানায়, এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পকে মনোনীত করে। কিন্তু ভারত এ দাবি সরাসরি অস্বীকার করে এবং দেখাতে চায়, মোদিই সামরিক শক্তি দিয়ে পাকিস্তানকে পিছু হটতে বাধ্য করেছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, সমস্যার মূল কারণ হলো এখন দুই দেশের সম্পর্ক রাষ্ট্রের বদলে দুই নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। ট্রাম্প আর মোদি দুজনই খুব ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও অহংকারী স্বভাবের। তাই সম্পর্কের ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

মুজিব মেশাল দ্য টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোর প্রধান ও হরি কুমার দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো