গত ১৬ জুন ইউক্রেন সরকার দেশটির লিথিয়াম খনির ভান্ডারের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু করে। আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে রোনাল্ড এস লডারের সঙ্গে যুক্ত একটি কনসোর্টিয়ামও। রোনাল্ড এস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়।
এই দরপত্র এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি খনিজ চুক্তির অংশ হিসেবে আহ্বান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ওপর প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। কয়েক মাসের আলোচনা শেষে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়।
চূড়ান্ত চুক্তি করার পর ইউক্রেনীয়রা বলেছেন যে আগের খসড়াগুলোর তুলনায় এর শর্তাবলি ইউক্রেনের পক্ষেই থাকবে। এই চুক্তি ইউক্রেনে খনি ও জ্বালানি খাতে মার্কিন বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করেছে। বিনিয়োগসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন যৌথভাবে গ্রহণ করবে। এখানে যে মুনাফা হবে, তাতে কোনো কর আরোপ করা হবে না এবং মার্কিন কোম্পানিগুলো টেন্ডার ও নিলামে অগ্রাধিকার পাবে।
ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে ট্রাম্পের প্রবেশাধিকারের দাবিকে অনেকেই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইউক্রেন যখন যুদ্ধরত এবং সেই যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল, সে সময় এই দাবিকে তাঁরা শোষণমূলক আচরণ বলে মনে করেছেন। কিন্তু ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের সম্পর্কের ইতিহাসে এটা কোনো ব্যতিক্রম ঘটনা নয়। এক দশকের বেশি সময় ধরে কিয়েভকে পশ্চিমা চাপের মুখে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যেগুলো ইউক্রেনের জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সম্ভবত ইউক্রেনে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের সবচেয়ে পরিচিত অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ২০১৪ সালের মে মাসে তিনি ইউক্রেনের প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি বুরিসমার বোর্ড সদস্য হন। ইউক্রেনের রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার তিন মাস পরের ঘটনা এটি।
এসব ঘটনার আলোকে, ট্রাম্পের খনিজ সম্পদবিষয়ক চুক্তিটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং ইউক্রেন–সংক্রান্ত পশ্চিমা নীতির ধারাবাহিকতা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ভিন্ন যেটা করেছেন সেটা হলো, তিনি প্রকাশ্যে দেখিয়েছেন, পশ্চিমা নেতারা কীভাবে নিজেদের ইচ্ছেমতো সুবিধা আদায়ের জন্য ইউক্রেন সরকারকে চাপ দিলেন। অন্যরা সেটা করেন সাধারণত পর্দার আড়ালে।
সে সময় জো বাইডেন শুধু বারাক ওবামার প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্টই নন, যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সম্পর্কের মূল দায়িত্বেও ছিলেন। পাঁচ বছর ধরে বোর্ড সদস্য হিসেবে হান্টার বাইডেন প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত আয় করেছিলেন। সুস্পষ্ট স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংঘাত থাকায় এ ঘটনায় তখন ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররাও অস্বস্তিতে পড়েছিল।
কিন্তু জো বাইডেন হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে আরও অনেক দূর ছাড়িয়েছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি প্রকাশ্যে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কোকে হুমকি দিয়েছিলেন যে যদি তিনি ইউক্রেনের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে (যাঁকে ওয়াশিংটন অপছন্দ করত) বরখাস্ত না করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এক বিলিয়ন ডলারের সহায়তা বন্ধ করে দেবে।
বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর প্রশাসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে চাপ দেন যেন ইউক্রেনের আদালতের বিচারক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিদেশি ‘বিশেষজ্ঞরা’একটি মূল ভূমিকায় থাকেন। ফলে ইউক্রেনের হাই কাউন্সিল অব জাস্টিসের এথিকস কাউন্সিলের (উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের যাচাই-বাছাই কমিটি) ছয় সদস্যের মধ্যে তিনজনই আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য।
এই সংস্কারের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে তীব্র বিরোধিতা তৈরি হয়েছিল। এমনকি জেলেনস্কির নিজের রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকেও বিরোধিতা এসেছিল। তা সত্ত্বেও তিনি এই সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
পশ্চিমাদের চাপের মুখে ইউক্রেন সরকার আরও কিছু অজনপ্রিয় আইন পাস করেছে। ২০২০ সালে ব্যক্তি খাতের কৃষিজমি বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিল পাস হয়েছে। দেশটির সংসদে বিলটি উত্থাপন করেছিলেন জেলেনস্কি। যদিও জনমত জরিপে ধারাবাহিকভাবে দেখা গেছে যে ইউক্রেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এ ধরনের পদক্ষেপের বিরোধী ছিল। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের চাপের মুখে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের হাতে তেমন কোনো বিকল্প ছিল না।
এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হলেও কোভিড-১৯ মহামারির বিধিনিষেধ দিয়ে সেটা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ইউক্রেনের কৃষি খাত আরও বড় খামারি ও রপ্তানিমুখী বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে ইউক্রেনের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর ব্যাপক হুমকি তৈরি হয়।
ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ এতটাই প্রকাশ্য যে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি জনসাধারণের আস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০২১ সালের এক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৪০ শতাংশ ইউক্রেনীয় বিশ্বাস করেন না যে তাঁদের দেশ পুরোপুরি স্বাধীন।
ইউক্রেনের শাসনব্যবস্থায় বিদেশি হস্তক্ষেপের সঙ্গে দেশটির অর্থনীতিকেও বিদেশি চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে। ২০১৬ সালে ইউক্রেনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জিওফ্রি পায়াট দেশটিকে ‘কৃষির সুপারপাওয়ার’ হওয়ার আহ্বান জানান। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে যে ইউক্রেন সে পথেই এগিয়েছে। বিশিল্পায়নের প্রক্রিয়া ইউক্রেনে চলমান রয়েছে।
২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ইউক্রেনের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্প খাতের হিস্যা ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে কৃষি খাতের হিস্যা ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে।
এটা ইউক্রেনের জনগণের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ ইউক্রেনীয় ‘মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়’ ভুগেছে। ২০২২ সালে সেটা বেড়ে ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় এ হার দ্বিগুণের বেশি।
এর কারণ হলো, কৃষির সম্প্রসারণ হয়েছে মূলত রপ্তানিমুখী ফসল (একই জমিতে একই ধরনের ফসলের চাষ) যেমন সূর্যমুখী, ভুট্টা ও সয়াবিন চাষে। ২০১৯ সালে ইউক্রেন সূর্যমুখী তেলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে একই জমিতে একই ধরনের ফসলের চাষের ফলে দেশটির ৪০ শতাংশ কৃষিজমি উর্বরতা হারানোর ঝুঁকির মধ্যে ছিল।
২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ইউক্রেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছিল। এ চুক্তি কমদামি পণ্য রপ্তানিকেও উৎসাহিত করেছিল। চুক্তির কঠোর বিধিনিষেধের কারণে ইউক্রেনীয় পণ্য ইউরোপীয় বাজারে পৌঁছাতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় উৎপাদকদের পণ্যে ইউক্রেনের বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ২০২১ সালে ইইউয়ের সঙ্গে ইউক্রেনের বাণিজ্যঘাটতির পরিমাণ ছিল চার বিলিয়ন ইউরো। ইউক্রেন মূলত কাঁচামাল রপ্তানি করেছে। এর পরিবর্তে ইউরোপ থেকে প্রক্রিয়াজাত পণ্য ও যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে।
রপ্তানি বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া, পশ্চিমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং দেশের ভেতরে নয়া–উদারবাদী অর্থনীতির নীতির চাপে ইউক্রেনের শিল্প খাতের উৎপাদনে ধস নামে। ইউক্রেনের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে মোটরগাড়ি উৎপাদন ৩১ শতাংশ কমে যায়। একই সময়ে ট্রেনের ওয়াগন উৎপাদন ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ, যন্ত্রপাতি উৎপাদন ৬৮ দশমিক ২ শতাংশ, ধাতব শিল্প উৎপাদন ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে।
২০২০ সালে নবনির্বাচিত জেলেনস্কি সরকার শিল্প খাতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে। তারা ইউক্রেনীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য নতুন একটি আইন প্রস্তাব করে। কিন্তু খুব দ্রুতই সেই বিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী এনজিওগুলোর সমালোচনার মুখে পড়ে। শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু সংশোধনী এনে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন কোম্পানিকে বিশেষ ছাড় দিয়ে বিলটি পাস হয়।
এসব ঘটনার আলোকে, ট্রাম্পের খনিজ সম্পদবিষয়ক চুক্তিটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং ইউক্রেন–সংক্রান্ত পশ্চিমা নীতির ধারাবাহিকতা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ভিন্ন যেটা করেছেন সেটা হলো, তিনি প্রকাশ্যে দেখিয়েছেন, পশ্চিমা নেতারা কীভাবে নিজেদের ইচ্ছেমতো সুবিধা আদায়ের জন্য ইউক্রেন সরকারকে চাপ দিলেন। অন্যরা সেটা করেন সাধারণত পর্দার আড়ালে।
পিটার করোতায়েভ স্বাধীন সাংবাদিক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত