কোন দলের কারা কারা জুলাই সনদে সই করল, তা দেখাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয় কোন দলের কারা কারা জুলাই সনদে সই করল, তা দেখাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

জুলাই সনদে মোটামুটি সব দলই স্বাক্ষর করেছে।

শুধু যেসব তরুণকে শান্ত করতে ইউনূস সরকার সংস্কার ও সনদ শুরু করেছিল, তাঁরাই স্বাক্ষর করেননি। তাঁরা এখন পর্যন্ত ‘অশান্তই’ রয়ে গেলেন। তবু স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর মোটামুটি এখন সবারই জন্য স্বস্তি। নির্বাচনে যেতে এখন আর বাধা নেই।

গত এক বছরে জুলাই সনদ নিয়ে কম কসরত হয়নি। মনে হচ্ছিল, এই ‘ম্যাগনাকার্টা’ করতে না পারলে আমাদের নির্বাচন, সরকার, রাজনীতি সব অচল হয়ে যাবে।

আমরা যাঁরা সাধারণ মানুষ, তাদের জন্য সনদের এতসব ধারা–উপধারা, কে কোনটি মানল, কোনটি কখন বাদ গেল, আবার কখন কোনটি সংশোধন করা হলো—এসবের হদিস রাখা কঠিন হয়ে উঠেছিল। তবে সংবাদমাধ্যমগুলো সংক্ষেপে আমাদের সামনে যা তুলে ধরেছে , তার থেকে সনদের কার্যক্রমের তিনটি অধ্যায় আমাদের সবার নজরে এসেছে—

১. সনদে কী লেখা হবে তা নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা ও ডিসেন্ট।

২. সনদ কীভাবে গৃহীত হবে তা নিয়ে মত-মতান্তর।

৩. সনদে কে স্বাক্ষর দেবেন কিংবা কে স্বাক্ষর দেবেন না, তা নিয়ে টালবাহানা।

তিনটি পর্বই বেশ উপভোগ্য ছিল। আজ যিনি পক্ষে, কাল চলে গেলেন বিপক্ষে; আবার তাঁকে বুঝিয়ে নিমরাজি করানো হলো।

বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, সনদ করবে জনগণের পার্লামেন্ট, এই সরকার সনদ করার কে? তাঁরা লাল কালিতে কিছু ‘ডিসেন্ট’ দিয়ে, কালো কালিতে স্বাক্ষর দিয়ে দিয়েছেন।

ইসলামি দলগুলো এত দিন বেঁকে বসেছিল—পিআর ছাড়া সনদ নয়, তাঁরাও স্বাক্ষর দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু এনসিপিকে নিয়ে বিপদ। তারা একদম কলমে তালা দিয়ে আছে। তাদের স্বাক্ষরের জন্য সনদে জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে, যেকোনো সময় তারা স্বাক্ষর দিয়ে দিতে পারে।

রাজনীতিবিদেরা সনদকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে গিয়ে সেটিকে বেশ রুগ্‌ণ করে ফেলেছেন। কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এসেছে, যার কোনটি কী বিরাট উপকারে আসবে তা বোঝা মুশকিল।

যেমন উচ্চ পরিষদ সংসদকে ভারী করা ছাড়া দেশের কোনো কাজে লাগবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানও একই কথা বলেছেন সিপিডির এক সভায়। এখানে একটি প্রশ্ন কি করা যায়—সংস্কার কমিশন সনদ লেখার আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করল না কেন?

অবশ্যই কিছু ভালো জিনিস রয়েছে সনদে। অন্তত এগুলোর শিরোনাম শুনতেও ভালো লাগে। যেমন নিরপেক্ষ সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন; কিন্তু সনদের ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের ‘রেসিপি’ কতটুকু নিরপেক্ষ হবে? ইংরেজিতে একটি কথা বলে, ‘ডেভিলস ইন ডিটেলস’। বাংলায় বলা যায় ‘শয়তান লুকিয়ে থাকে বিস্তারিতর মধ্যেই।’

১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন ওয়াল্টার মনডেল। তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে ব্যঙ্গ করে একটি হ্যামবার্গার কোম্পানির বিজ্ঞাপন থেকে ধার নিয়ে বলেছিলেন, ‘হয়্যার ইজ দ্য বিফ?’ শুধু তো রুটি, মাংস কোথায়?

এরপর প্রতিটি নির্বাচনে কথাটা কোনো না কোনোভাবে চলে আসে। আমাদের সনদের দেশে আবার সনদ হচ্ছে; কিন্তু সনদের ভেতর কী আছে? সত্যি কি কোনো ‘মাংস’ আছে? ‘হয়্যার ইজ দ্য বিফ?’

আমরা একটু বুঝতে চেষ্টা করব, সনদ মেনে কতটুকু নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার হবে!

জুলাই সনদে স্বাক্ষরের আগে কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা করেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি

সনদের ১৬তম ধারা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এ নিয়ে একটু বিস্তারিত জানার জন্য একদিন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্যকে ফোন করলাম। তিনি অত্যন্ত সজ্জন লোক। আমি শুধু নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম । তিনি বেশ ধৈর্য নিয়ে নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে ঐকমত্য কমিশন কী প্রস্তাব ফাইনাল করতে চাচ্ছে, তা বোঝালেন। তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নিয়েও তিনি স্পষ্ট জানালেন।

আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই ব্যবস্থা কতটুকু নিরপেক্ষ হবে? তিনি সরাসরি উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে একটি রিভিউ পিটিশন আছে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী যদি আপিল কোর্ট পুনর্বহাল করে, তাহলে আগের মতোই সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হবেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। অনেকটা আশ্বস্ত হলাম।

শেখ হাসিনার সময়, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে আদেশ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস করে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পঞ্চদশ সংশোধনীকে আংশিক বাতিল করেছেন। যে অংশটি বাতিল করা হয়েছে, তার ফলে দেশের সংবিধানে আবারও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা (ত্রয়োদশ সংশোধনী) ফিরে আসার পথ তৈরি হয়েছে; কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে যে রিভিউ পিটিশন আছে, সেটিরও মীমাংসা হতে হবে।

রিভিউ পিটিশনটি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। রিভিউ আবেদনটি করেছিলেন সুজনের সাধারণ সম্পাদক। যিনি এখন ঐকমত্য কমিশনের একজনা সদস্য বদিউল আলম মজুমদার। রিভিউ আদেশে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত আবেদনকারীর পক্ষে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে।

এখানে উল্লেখ করা যায়, বাতিল করার আগে নিরপেক্ষ সরকার আইনে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হতেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান।

সংবিধান সংস্কার কমিশন যেভাবে নিরপেক্ষ সরকার নিয়োগপ্রণালি রচনা করেছে, তাতে বলা যায় রাজনীতিকেরাই নির্ধারণ করবেন কে নিরপেক্ষ সরকারে আসবেন। এতে আরও বলা হয়েছে, কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলো এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবে।

সনদের নিরপেক্ষ সরকার

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে সনদের ১৪তম ধারায় বলা হয়েছে, বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যেই নতুন নির্বাচন হবে। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে, যারা ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা’ বাছাই করবে। এই কমিটিতে থাকবেন ১. প্রধানমন্ত্রী, ২. বিরোধীদলীয় নেতা, ৩. স্পিকার, ৪. ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং ৫. সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি।

সংবিধান সংস্কার কমিশন যেভাবে নিরপেক্ষ সরকার নিয়োগপ্রণালি রচনা করেছে, তাতে বলা যায় রাজনীতিকেরাই নির্ধারণ করবেন কে নিরপেক্ষ সরকারে আসবেন।

এতে আরও বলা হয়েছে, কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলো এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবে।

কমিটি একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবে এবং তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।

মনোনয়নের সংক্ষিপ্ত তালিকা নিয়েও অনেক নাটকীয়তা আছে। সরকারি দল পাঁচজনকে মনোনীত করবে, বিরোধী দল তার থেকে একজনকে বেছে নেবে সংক্ষিপ্ত তালিকার জন্য, তেমনি বিরোধী দলের মনোনীত পাঁচজন থেকে সরকারি দল একজনকে বেছে নেবে। শেষ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে কমিটির পাঁচজনের মধ্যে কমপক্ষে চারজন ভোট দিয়ে একজনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করবে।

এতসব জটিলপদ্ধতি উদ্ভাবন করেও কি একজন নিরপেক্ষ সরকারপ্রধান পাওয়া যাবে? নির্বাচিত প্রতিনিধি রাজনীতিবিদদের মনোনীত, তাঁদের কমিটি দ্বারা নির্বাচিত হয়তোবা তাঁদেরই একজন হবেন আমাদের ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের প্রধান।

এই কমিটি যদি প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করতে ব্যর্থ হয়, তবে পরবতী বেশ কয়েকটি বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে সনদে। এই বিকল্প ব্যবস্থাগুলো একটি অন্যটির চেয়ে আরও জটিল। কিন্তু উদ্দেশ্য একই—জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি রাজনীতিকদের হাতে নিরপেক্ষ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সব ক্ষমতা রাখা।

এই পদ্ধতিতে মনোনীত নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান কতটা নিরপেক্ষ হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। অনেকেই প্রার্থনা করবেন—ত্রয়োদশ সংশোধনী কোর্টের রায়ে আবার পুনর্বহাল হোক এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হবেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান।

নির্বাচনকালীন ৯০ দিন রাজনীতিবিদদের হাত থেকে প্রশাসন মুক্ত থাকুক, যেমনটা ছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সময়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সময় যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘দেশ এক দিনের জন্যও অনির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে না এবং দেশ নির্বাচনকালীন সময়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরকার দ্বারাই পরিচালিত হবে।’

আমাদের সনদের প্রণেতা ও স্বাক্ষরকারীরাও এখন গর্ব করে বলতে পারবেন, দেশ নির্বাচনকালীন সময়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মনোনীত সরকারপ্রধান দ্বারাই পরিচালিত হবে। অনেকেই এই দুটিতে বড় মাপের কোনো পার্থক্য দেখবেন না। সনদ কাজে লাগিয়ে রাজনীতিবিদেরাই নির্ধারণ করবেন কারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন এবং সবাই মনোনয়ন দেবেন তাঁদের নিজেদের লোক এবং তার মধ্যেই একজন ‘নিরপেক্ষ’ সরকারপ্রধান হবেন। এ কারণে সনদের পুরো ব্যাপারটিকে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ মনে হচ্ছে।

সূত্র, প্রথম আলো