সম্প্রতি সংসদের উভয় কক্ষে তুমুল বিতর্কের পর ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিল পাস হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এটিকে সামাজিক ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এক ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে কংগ্রেস এই বিলকে সংবিধানের মূলনীতি, ধারা ও চর্চার ওপর আঘাত বলে নিন্দা করেছে। সেই সঙ্গে তারা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই বিল পাস হতো না, যদি না তথাকথিত মুসলিম-সমর্থক রাজনীতিবিদ চন্দ্রবাবু নাইডু, নীতীশ কুমার ও জয়ন্ত চৌধুরীর মতো নেতারা সমর্থন দিতেন। ফলে এটা স্পষ্ট, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে মুসলমানরা আজ পুরোপুরি রাজনৈতিকভাবে অনাথ। বিচার চাওয়ার মতো আর কোনো নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি তাদের পাশে নেই।

যেসব দল নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে দাবি করে, তারাও অনেক সময় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে পরোক্ষভাবে এগিয়ে দিয়েছে। এর ফলে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যকে আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার পথ সুগম হয়েছে। এটি ভারতের সংবিধানিক অভিযাত্রার পথে এক অন্ধকার অধ্যায়।

ওয়াক্‌ফ হলো ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী একটি ধর্মীয় দানব্যবস্থা। কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি দরিদ্রদের কল্যাণে দান করেন। এরপর সেটি আর ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকে না। সেই সম্পত্তি আল্লাহর নামে দান করা হয়। এই সম্পত্তির মাধ্যমে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি পরিচালিত হয়। ১৯৯৫ সালের ওয়াক্ফ আইন অনুযায়ী এগুলো চলে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের ওয়াক্‌ফ বোর্ডের মাধ্যমে এগুলোর তদারকি হয়। রাজ্য সরকারগুলো এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো সমস্যা হলে তা ওয়াক্‌ফ ট্রাইব্যুনালে ওঠে।

যাঁরা ভারতীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের এক হয়ে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই এখন জরুরি। মুসলমানরাও তাঁদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। গণতান্ত্রিক চেতনায় দৃঢ় কোনো নেতৃত্ব মুসলিম সমাজে এখন চোখে পড়ে না। এই দুর্বল নেতৃত্বই পুরো সম্প্রদায়ের এক বড় সমস্যা।

স্বীকার করতে হবে, অনেক ওয়াক্‌ফ বোর্ডই দুর্নীতিগ্রস্ত বা অকার্যকর। অনেক জায়গায় বেসরকারি দখলদারি বা জমি জবরদখলের অভিযোগও রয়েছে। তবে এ রকম সমস্যা ভারতের সাধারণ জমি, জলাশয় বা বনভূমিতেও দেখা যায়। এই দখলদারির কারণে দরিদ্রদের পক্ষে ওয়াক্‌ফের সুবিধা পাওয়া কঠিন করে তোলে। ফলে ওয়াক্‌ফের মূল উদ্দেশ্যটাই বাধাগ্রস্ত হয়। তাই একটা সার্বিক সংস্কার দরকার। এই সংস্কার ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে দাবি করেছেন অনেক সচেতন নাগরিক ও সংগঠন।

কিন্তু বর্তমান সরকার হঠাৎ মুসলমানদের কল্যাণের কথা বলে এত বড় উদ্যোগ নিচ্ছে—এটা সন্দেহজনক। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার মুসলিম সমাজকে না জানিয়ে, আলোচনায় না বসেই করা হলে, সেটাকে নিছক হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু এর আড়ালে আরও গভীর শঙ্কা লুকিয়ে আছে। বাস্তবতা হলো, গত দশ বছরে সরকারের কোনো কার্যকলাপে মুসলমানদের প্রতি আন্তরিকতা দেখা যায়নি; বরং প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঘৃণা, বিদ্বেষ আর বিভাজনের রাজনীতি।

গরু রক্ষার নামে গণপিটুনি, লাভ জিহাদ বা করোনা জিহাদের মতো কাল্পনিক ধোঁয়া তুলে মুসলমানদের হয়রানি করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সরকার বরাবর নীরব থেকেছে। উত্তর প্রদেশে বুলডোজার এখন সরকারিভাবে শাস্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে। মসজিদের নিচে মন্দির খোঁজার নামে হিন্দুত্ববাদী বাহিনীরা প্রশাসনের প্রশ্রয়ে যা খুশি তা–ই করছে। নির্বাচনের সময় মুসলিমবিদ্বেষী ভাষা ব্যবহার এখন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার।

মোগল, মাছ-মাংস এসব শব্দই এখন মুসলমানদের বিপক্ষে ইঙ্গিত হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য চালু থাকা বৃত্তি প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফুটপাতের মুসলমান ছোট ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। পার্কে শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ পড়লেও পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। এমনকি ঈদের নামাজ রাস্তায় পড়াও অনেক জায়গায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এই বাস্তবতায় সরকার দাবি করছে, ওয়াক্‌ফ আইন সংশোধন করছে মুসলমানদের মঙ্গলের জন্য। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হলো, হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে আরও উসকে দেওয়া। বিলটি পাস করানোর আগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচার চলেছে, মুসলমানরা নাকি হিন্দুদের জমি দখল করে নেবে ওয়াক্‌ফের নামে। এনডিএ জোট এই মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে বিহার নির্বাচনে সুবিধা নিতে চায়। এই বিল জমি ও সম্পত্তির ওপর বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারও হতে পারে। কারণ, এই খাতে ইতিমধ্যেই বড় ধরনের দুর্নীতি বিদ্যমান।

এই ওয়াক্‌ফ সংশোধন বিল সরাসরি সংবিধানের মূল চেতনার ওপর আঘাত করেছে। এটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করে। সংখ্যালঘুদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে, সেটিও এতে খর্ব হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে, ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য রাখতে হবে। এই সিদ্ধান্ত একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে বৈষম্যমূলক হস্তক্ষেপ। সরকার যদি সত্যিই বৈচিত্র্য ও সমান অধিকার চায়, তাহলে তিরুপতি দেবস্থানম বোর্ডে কি মুসলমান, খ্রিষ্টান বা পার্সিদের নিয়োগ করবে? যদি সত্যিই সব ধর্মের জন্য এক আইন দরকার হয়, তাহলে তা হোক ইউনিফর্ম সিভিল কোডের আওতায়। সব ধর্মস্থলের জন্য এক নিয়ম হোক।

নতুন আইন অনুযায়ী, কেউ ওয়াক্‌ফ করতে চাইলে তাঁকে আগে কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে মুসলমান থাকতে হবে। এই বিধান করে ওয়াক্‌ফকে একধরনের বেসরকারি প্রকল্পের মতো সাজানো হয়েছে।

এই বিল আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে আসল লড়াইটা সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে হওয়া দরকার। যাঁরা ভারতীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের এক হয়ে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই এখন জরুরি। মুসলমানরাও তাঁদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। গণতান্ত্রিক চেতনায় দৃঢ় কোনো নেতৃত্ব মুসলিম সমাজে এখন চোখে পড়ে না। এই দুর্বল নেতৃত্বই পুরো সম্প্রদায়ের এক বড় সমস্যা।

অবশ্য দমন-পীড়নের মুখে থাকা একটি জাতিগোষ্ঠীর কাছে সব সময়ে নেতৃত্বের দাবি তোলা অন্যায্যও বটে; কিন্তু পবিত্র কোরআনের বাণী মনে রাখতে হবে—আল্লাহ তাদেরই সাহায্য করেন, যারা নিজেরা নিজেদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ভারতীয় সংবিধান এখনো আমাদের আশার জায়গা, যেখানে একতা ও উন্নতির সুযোগ রয়েছে।

আমাদের দরকার এমন একটি বৃহত্তর গণ–আন্দোলন, যেখানে ধর্মের বিভাজন পেরিয়ে সবাই মিলে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়বে। যেমনটা আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেখেছি। সিএএ-এনআরসি, লাভ জিহাদ আইন, আর এখন এই নতুন ওয়াক্‌ফ আইন—সবই দেখিয়ে দিচ্ছে যে এখন সময় হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে এক শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক চেতনার নেতৃত্ব গড়ে তোলার। নেতৃত্ব হোক মুসলিম, হোক বা অমুসলিম—যাঁরা আমাদের সংবিধান, সাম্য আর সহাবস্থানের পক্ষে কথা বলবেন, তাঁরাই হোক আমাদের ভরসা।

জাকিয়া সোমান সহপ্রতিষ্ঠাতা, ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন

দ্য ওয়্যার থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

সূত্র, প্রথম আলো