বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন যখন শুরু হলো, তখন থেকেই কিছু প্রশ্ন দেশে-বিদেশে ঘুরেফিরে শোনা যেত। একটা দেশ আর্থসামাজিক সূচকে এগিয়ে গেলেও রাজনীতিতে কোনো অগ্রগতি নেই কেন। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এ দেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হতে পারেনি। এ পরিস্থিতিকে কেউ কেউ ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ২০২০ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যারি ব্লেয়ার ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ নামে দীর্ঘ নিবন্ধও লিখেছেন।
অন্য গবেষণায় দেখা যায়, আবদ্ধ ও উন্মুক্ত—দুই ধরনের চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। আর এখানে এসব চুক্তির একটা শৃঙ্খলা রয়েছে, অর্থাৎ চুক্তি সচরাচর ভঙ্গ হয় না। এটাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূলমন্ত্র।
তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল না ঘটার পেছনে এখানকার গোত্রভিত্তিক রাজনীতির কথা শোনা যায়। এটা বহুলাংশে সত্য। গোত্রভিত্তিক রাজনীতির পরিণতি শেষ পর্যন্ত মক্কেলতন্ত্রে গিয়েই ঠেকে। রাজনৈতিক এ সংস্কৃতির সঙ্গে কর্মসংস্থানের ধরনের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে।
কর্মসংস্থানের ধরন ও শক্তিশালী সমাজ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত মে মাসে প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে ২৭ লাখের বেশি মানুষ বেকার। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাতও হয়েছিল বেকার সমস্যা থেকে সৃষ্ট হতাশা। যার পরিণতি ছিল কোটা আন্দোলনে তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও সংহতি।
প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের এমন সংকটের কারণে এ দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এ খাতের কর্মীরা সাধারণত কম মজুরি পায় এবং তাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। এ ছাড়া তাদের সামাজিক সুরক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
অনানুষ্ঠানিক খাত মানে যার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই, অর্থাৎ এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সরকারি নিবন্ধন নেই। তাই এগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণের যেমন বাইরে, তেমনি সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। যেমন ফুটপাতের ব্যবসা, মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে শ্রম, গৃহস্থালির কাজ, বাস-ট্রাক-রিকশা চালানোর পেশা, কৃষি শ্রম ইত্যাদি। এসব কাজ পাওয়া না–পাওয়া নির্ভর করে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। অলিখিতভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক কাজ পেতেও ‘সম্পর্ক’ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
এমন পরিস্থিতিই মক্কেলতন্ত্রের জন্ম দেয়, অর্থাৎ যার কাছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে, সে নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে কর্মসংস্থান বা অন্য সুবিধা দিয়ে আনুগত্য কিনে নিতে পারে। আর এমন অনেক মানুষের সম্মিলনে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে উঠেছে। ফলে উচ্চশিক্ষিত, তুলনামূলক ভালো প্রার্থীর যদি পৃষ্ঠপোষকতা বা সুবিধা দেওয়ার সক্ষমতা না থাকে, তাহলে তাঁর পেছনে কেউ হাঁটে না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এ চিত্র পাল্টাতে হলে প্রয়োজন জনগণকে নাগরিক করে তোলা, আইনের শাসন এবং রাষ্ট্রের মাধ্যমে মানুষের পজিটিভ লিবার্টি বা মৌলিক চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা থাকা। এগুলো সময়সাপেক্ষ। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে নজর দিতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে
দুর্বল রাষ্ট্রে মক্কেলতন্ত্র
মক্কেলতন্ত্র সৃষ্টির আরেকটা বড় কারণ হলো, দেশে আইনের শাসন না থাকা এবং মৌলিক চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। রাজনৈতিক বা অন্য অনেক ভুয়া মামলায় এখানে মানুষ গ্রেপ্তার হয়। আবার যথাযথ অপরাধেও অনেকের সাজা হয় না। অতিসাধারণ মৌলিক চাহিদা, যেমন সরকারি চিকিৎসাসেবা, সেটা পেতেও এখানে ক্ষমতাসীনদের দ্বারস্থ হতে হয়। এই যে অসম ব্যবস্থা, এখানে ক্ষমতাবানেরাই সুবিধাপ্রাপ্ত। তাদের কাছে থাকা এসব সুবিধা পাওয়ার আশায় সাধারণ অনেক মানুষ তাদের প্রতি অনুগত থাকে। দেশে আইনের শাসন থাকলে এটা হতো না। ফলে উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু মক্কেলদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে ব্যর্থ প্রার্থীর পক্ষে ভোটে জেতা কঠিন। এ ধরনের ‘নেটওয়ার্কড’ সমাজে রাষ্ট্র যখন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তখন মক্কেলতন্ত্রকে মানুষ নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্র আরও দুর্বল হতে থাকে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জুয়েল মিগডাল তাঁর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘স্ট্রং সোসাইটিজ অ্যান্ড উইক স্টেটস’ বইয়ে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার যে ধারণা দিয়েছেন, সেই ধারণার আলোকে বলা যায়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রের বিপরীতে সমাজ বেশি শক্তিশালী।
বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, শক্তিশালী রাষ্ট্র মানে যেই রাষ্ট্র আন্দোলন দমন করতে পারে বা বল প্রয়োগ করতে পারে। এটা সম্পূর্ণ ভুল একটা ধারণা; বরং যে রাষ্ট্র যত বেশি দুর্বল, সে ততই সহিংসতার আশ্রয় নেয়। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স বেবার ‘পলিটিকস অ্যাজ আ ভোকেশন’ গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, আধুনিক রাষ্ট্রের সহিংসতার একাধিপত্য রয়েছে। সামন্ত প্রভুদেরও নিজেদের পেটুয়া বাহিনী ছিল। কিন্তু পুলিশ-সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র সেই ক্ষমতা অনেক বেশি সংহত করেছে। কিন্তু সহিংসতার একাধিপত্যের এ ব্যবহার সাধারণত রাষ্ট্রের দুর্বলতা প্রকাশ করে। আর পৃথিবীতে যাদের আমরা ভঙ্গুর রাষ্ট্র বলি, তারা তো টিকেই থাকে সহিংসতার এ একাধিপত্যের জোরে।
শক্তিশালী রাষ্ট্র কোনগুলো
অন্তত দুটো বিষয় থেকে এটা বোঝা যায় সহজেই। যে দেশে নাগরিকেরা স্বেচ্ছায় সরকারকে কর দেয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনকানুন মেনে চলে, তাকে আমরা শক্তিশালী রাষ্ট্র বলতে পারি। এ বিচারে বাংলাদেশের অবস্থা নাজুক। এটি বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের দেশ। প্রায় ১৭ কোটির বেশি মানুষের দেশে করজালের আওতায় আছেন মাত্র ১ কোটি ১৪ লাখের কিছু বেশি মানুষ। এটা এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য। তবে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা এত হলেও উল্লিখিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার। এর মধ্যে অনেকে আবার করযোগ্য আয় সীমার বাইরে।
সরকারকে কর দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের প্রণোদনা না থাকার একটা কারণ হলো, সরকারি সেবা না পাওয়া। মানুষ যদি বুঝতে পারে তার করের টাকার সুফল সে পাচ্ছে, বিশেষ করে মৌলিক চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে, তাহলে কর দেওয়ার প্রণোদনা বাড়ে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা। এ দেশে যে সরকারই ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতি-লুটপাটের অভিযোগ দেখা যায়। ফলে মানুষের মনে ধারণা আছে যে তার করের টাকা শেষমেষ লুটপাটই হবে। এমন পরিস্থিতি দুর্বল রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
দুর্বল রাষ্ট্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, স্বেচ্ছায় মানুষ এখানে আইন মানে না। করোনাকালে আমরা দেখেছিলাম, সরকার বিধিনিষেধ বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি। জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক হুমকি থাকাও সত্ত্বেও অর্থনৈতিক যুক্তিতে সরকার বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার নীতি নিয়েছিল। এখান থেকে দুর্বল রাষ্ট্র-শক্তিশালী সমাজের চিত্র পাওয়া যায়। অথচ তখন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে কর্তৃত্বপরায়ণ ও স্বৈরাচারী সরকার হিসেবেই মানুষ জানত।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এ চিত্র পাল্টাতে হলে প্রয়োজন জনগণকে নাগরিক করে তোলা, আইনের শাসন এবং রাষ্ট্রের মাধ্যমে মানুষের পজিটিভ লিবার্টি বা মৌলিক চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা থাকা। এগুলো সময়সাপেক্ষ। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে নজর দিতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক খাতগুলোকে মোটামুটি একধরনের রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি ও সুযোগ-সুবিধার আওতায় এনে নিরাপত্তা দেওয়া দরকার। এসব চ্যালেঞ্জ দূর না হলে এখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল দুরূহ বলেই মনে হয়।
খলিলউল্লাহ্ প্রথম আলোর জলবায়ু প্রকল্প ব্যবস্থাপক