ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে হোয়াইট হাউসে হওয়া সাম্প্রতিক বৈঠকে একটি দৃশ্য সবার নজর কেড়েছে। সেখানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিজলুট ডেস্কের পেছনে বসে আছেন। আর ইউরোপীয় নেতারা তাঁকে ঘিরে ‘স্কুলছাত্রদের মতো’ দাঁড়িয়ে আছেন। এই একটি ছবি হাজারো কূটনৈতিক বিবৃতির চেয়েও স্পষ্টভাবে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির চরিত্র বুঝিয়ে দিয়েছে।

এ ছবির বার্তা বোঝা দরকার। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য উপেক্ষা করে ট্রাম্প শুধু কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গই করেননি, তিনি রাশিয়া ও চীনকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইউরোপসংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য তাঁর সঙ্গেই আলোচনায় বসতে হবে।

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাত মাসের মাথায় ট্রাম্প যেন বিশ্ব চালাচ্ছেন নিজের একেবারে ব্যক্তিগত করপোরেশনের মতো। সেখানে প্রচলিত নিয়মকানুন বা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কোনো গুরুত্ব নেই। ওভাল অফিস এখন যেন একটি কোম্পানির নির্বাহী কক্ষ। ট্রাম্প যেন সেখানকার সিইও আর অন্যান্য বিশ্বনেতারা যেন কর্মচারী।

শতাব্দীপ্রাচীন কূটনৈতিক রীতিগুলো এখানে নিছক আনুষ্ঠানিকতামাত্র।

ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা, যা সহযোগিতার ওপর নয় বরং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার ওপর দাঁড়াবে। বৈঠকে ইউরোপীয় নেতাদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, ট্রাম্প তাঁর লক্ষ্যে বেশ এগিয়ে গেছেন। উইনস্টন চার্চিল, শার্ল দ্য গল কিংবা এমনকি আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো নেতারা ট্রাম্পের এমন ঔদ্ধত্য মেনে নিতেন, এটা কল্পনারও অতীত।

কিন্তু আজকের ইউরোপ জনতুষ্টিবাদে বিভক্ত হয়ে আছে। নেতৃত্বে পিছিয়ে গেছে। বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার মতো সক্ষমতা এখন তার নেই।

ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিও একই ধাঁচের। তিনি ন্যাটোকে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক একটি কৌশলগত হাতিয়ারে পরিণত করতে চাইছেন। তাঁর এই সর্বনাশা চাওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ে বিশেষভাবে বিপজ্জনক। আগে ন্যাটো-রাশিয়া কাউন্সিল এবং ন্যাটো-ইউক্রেন কমিশনের (যা ২০২৩ সালে ন্যাটো-ইউক্রেন কাউন্সিল দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়) মাধ্যমে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের সঙ্গেই ন্যাটো সমান্তরালভাবে যোগাযোগ রাখত। এই সমান্তরাল চ্যানেলগুলো সংলাপ ও প্রতিরোধের মধ্যে একটি নাজুক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। সেই ভারসাম্য এখন ট্রাম্পের নীতির কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে যে দেশগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়েছে, সেই তুরস্ক, পোল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন এবং কৃষ্ণসাগর ও বাল্টিক অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো হোয়াইট হাউসের সাম্প্রতিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিল না। তাদের অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এই ফ্রন্টলাইন দেশগুলোকে বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ন্যাটোর মূলনীতিকে, অর্থাৎ সমষ্টিগত নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এটি ন্যাটো জোটের কৌশলগত ঐক্যকে নষ্ট করছে।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পকে ঘিরে ইউরোপীয় নেতাদের সেই ছবি নিছক একটি ‘ফটো-অপ’ নয়। এটি ইউরোপের নেতৃত্বহীনতা, ন্যাটোর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং তুরস্কের গুরুত্ব হ্রাসের প্রতীক। ইউরোপ ও তুরস্কের নীতিনির্ধারকদের এখনই সতর্ক হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা শুধু তাদের বাইরে রেখেই গড়ে উঠবে না, বরং তা তাদের স্বার্থকে আঘাত করে গড়ে উঠবে।

তুরস্কের জন্য এ অবস্থা আরও গুরুতর প্রভাব বয়ে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পর ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী থাকার পরও এবং কৃষ্ণসাগর, ককেশাস ও ইউরেশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরও তুরস্ক এখন ন্যাটোর কেবল প্রান্তিক পর্যবেক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে এখন একটি কৌশলগত অংশীদার না ভেবে কেবল মাঝেমধ্যে বৈঠক আয়োজনের জন্য ‘সুবিধাজনক হোস্ট’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউক্রেন সম্মেলনে তুরস্ককে বাদ দেওয়ার বিষয়ে কোনো রাখঢাক করা হয়নি।

একেবারে খুল্লামখুল্লাভাবেই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প সম্মেলনের আগে বা পরে তুরস্ককে সরাসরি কোনো তথ্য দেননি, বরং ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আঙ্কারাকে সম্মেলনের বিষয়ে জানানো হয়। এমনকি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া–সম্পর্কিত সাম্প্রতিক বৈঠক থেকেও তুরস্ককে বাদ দেওয়া হয়।

তুরস্কের এই মর্যাদাহানি একটি বড় কৌশলগত ভুলের প্রতিফলন। ওয়াশিংটন সম্মেলনের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকা হবে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। প্রথমে এটি প্রশংসার মতো শোনালেও আসলে এটি শীতলযুদ্ধ-পূর্ব যুগের সেই মানসিকতার পুনরুজ্জীবনকে বোঝায়, যেখানে তুরস্ককে তার কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিয়ে বিচার না করে কেবল তার সেনাবাহিনীর আকার দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়।

এভাবে তুরস্ককে ১৯৫০-এর দশকের কোরিয়া যুদ্ধের সময়কার ভূমিকায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেখানে তুরস্ক সামনের সারির নিরাপত্তারক্ষক, কিন্তু ভবিষ্যৎ নির্ধারণী আলোচনায় উপেক্ষিত। আজও তুরস্কের একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তুরস্ককে বাদ দিয়ে জাতীয় স্বার্থের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছে, অথচ সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তাকে। অর্থাৎ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের প্রশ্নে তুরস্ককে আলোচনা থেকে বাদ রেখে তাকে দিয়েই এমন সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করা হচ্ছে, যেগুলোতে তুরস্কের কোনো মতামতই নেওয়া হয়নি।

২০০১ সালে প্রকাশিত আমার বই ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ’-এ আমি এই পুরোনো মানসিকতার সমালোচনা করেছি। পরে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও আমি এ নিয়ে কথা বলেছি। এটি আসলে মার্কিন ও ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকদের একধরনের দীর্ঘস্থায়ী কৌশলগত অন্ধত্বের পরিচায়ক। এটিকে কোনো তুর্কি নেতারই স্বাভাবিক বা সহনীয় বলে মেনে নেওয়া উচিত নয়।

পশ্চিমা দেশগুলোকে বুঝতে হবে, তুরস্ক কোনো ‘ছেলেছোকরা’ ধরনের দেশ নয় যে একটু প্রশংসাসূচক কথা বলে বা পৃষ্ঠপোষকতার মতো করে পিঠচাপড়ানি দিয়ে তার মর্যাদাহানিজনিত ক্ষোভ মিটিয়ে ফেলা যাবে। তুরস্ক শতাব্দীপ্রাচীন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ একটি দেশ। এটি কৌশলগতভাবে পরিণত একটি আঞ্চলিক শক্তি। এটি একটি সভ্যতার প্রতিনিধি, যা দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপ ও বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। তুরস্ককে শুধু সামরিক সম্পদ হিসেবে দেখা মানে তার প্রকৃত কৌশলগত পরিচয়কে ভুল বোঝা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মহাদেশজুড়ে ক্ষমতার পালাবদল সামলে যে কূটনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, তুরস্ক তারই ধারক।

ট্রাম্প যা করছেন, তাতে তুরস্ক আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। তাকে পাশ কাটিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে তাকে নতুন কৌশলগত সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রথম ধাপে তাকে তিনটি জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রথমত, তুরস্ককে ন্যাটোর ভেতরে সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে একটি ব্লক গঠন করতে হবে। এর জন্য তাকে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত ইউক্রেন সম্মেলন থেকে বাদ পড়া দেশগুলোর (যেমন পোল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো) সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। এভাবে একটি বিকল্প কৌশলগত সমন্বয় মঞ্চ গড়ে তোলা গেলে ন্যাটোর ভেতরের শক্তির ভারসাম্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব হবে।

দ্বিতীয়ত, তুরস্কের উচিত কৃষ্ণসাগর উপকূলবর্তী দেশগুলোকে (যেমন রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, জর্জিয়া ও মলদোভা) একত্র করে একটি পরামর্শমূলক কাঠামো তৈরি করার নেতৃত্ব দেওয়া। পাশাপাশি ইউক্রেন ও রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আরও জোরদার করা। শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী স্থিতিশীলতার মূলভিত্তি হিসেবে একসময় কাজ করা ‘ব্ল্যাক সি নেভাল ফোর্স’ এবং ‘ব্ল্যাক সি ইকোনমিক কো–অপারেশন’-এর মতো উদ্যোগগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করলে রাশিয়া, ইউক্রেনসহ সব আঞ্চলিক পক্ষের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপ শুরু হতে পারে।

তৃতীয়ত, তুরস্ককে তার কৌশলগত কেন্দ্রীয় অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে, তুরস্ক কোনো নিষ্ক্রিয় মধ্যপ্রাচ্যের আউটপোস্ট নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরেশীয় শক্তি। এ জন্য আরও দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী কূটনৈতিক অবস্থান গ্রহণ জরুরি।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পকে ঘিরে ইউরোপীয় নেতাদের সেই ছবি নিছক একটি ‘ফটো-অপ’ নয়। এটি ইউরোপের নেতৃত্বহীনতা, ন্যাটোর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং তুরস্কের গুরুত্ব হ্রাসের প্রতীক। ইউরোপ ও তুরস্কের নীতিনির্ধারকদের এখনই সতর্ক হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা শুধু তাদের বাইরে রেখেই গড়ে উঠবে না, বরং তা তাদের স্বার্থকে আঘাত করে গড়ে উঠবে।

আহমেত দাভুতোগলু তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী (২০১৪-২০১৬) ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী (২০০৯-২০১৪)

সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সূত্র, প্রথম আলো