ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি সাবেক এফবিআই পরিচালক জেমস কোমির বিরুদ্ধে মামলা করে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে একপ্রকার ‘আইনি যুদ্ধ’ শুরু করেছেন। এতে তাঁর শাসনব্যবস্থাকে অনেকেই ১৯৩০-এর দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে তুলনা করছেন। কারণ, হিটলারও কিন্তু আইন মেনে ক্ষমতায় এসে পরে সেই আইনের জোরেই একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন।

তবে হিটলারের সঙ্গে ট্রাম্পের পার্থক্যও আছে। হিটলার যুদ্ধের ফ্রন্টে লড়েছিলেন, আহতও হয়েছিলেন দুবার। কিন্তু ট্রাম্প সামরিক দায়িত্ব এড়িয়ে যান, দাবি করেন তাঁর পায়ের হাড়ে সমস্যা আছে। তাঁর চোখে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া মানে ‘বোকা’ বা ‘পরাজিত’ হওয়া।

ট্রাম্পের রাজনীতির আসল কৌশল হলো নিজেকে অবহেলিত জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান সংখ্যাগোষ্ঠীকে ‘অবহেলিত সংখ্যালঘু’ হিসেবে উপস্থাপন করেন।

এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদেরও তিনি ‘শরণার্থী’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগত জানান। কিন্তু এখন তাঁর বক্তৃতাগুলো ক্রমেই অর্থহীন বকবকানিতে পরিণত হয়েছে। হিটলার অন্তত এসব বকবক নিজের ব্যক্তিগত ‘টেবিল টক’-এর মধ্যে রাখতেন, যেখানে তিনি স্পার্টানদের স্যুপ নিয়ে আলোচনা করতেন। ট্রাম্প কিন্তু হাজারো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বাতাসচালিত টারবাইন কীভাবে পাখি ও তিমি মেরে ফেলে—এসব নিয়ে বক্তৃতা দেন।

ট্রাম্প কখনো অপমান ভুলে যান না। সম্প্রতি কোমির পাশাপাশি তাঁর নিশানায় এসেছেন জর্জ সোরোস। তাঁর বিরুদ্ধে তিনি ‘দেশে সন্ত্রাসে অর্থায়নের’ অভিযোগ তুলেছেন। অথচ তাঁরই সাবেক অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বহু বছর সোরোসের কর্মচারী ছিলেন। এমনকি তিনি সেনাপ্রধান মার্ক মিলিকেও মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ভাষা এখন তাঁর মুখে আরও ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে।

ট্রাম্প আসলে বহু বছর ধরেই ‘ল’ফেয়ার’ বা আইনি যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করে আসছেন। ১৯৭৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তিনি ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী, কর কর্তৃপক্ষ, সাংবাদিক বা সমালোচকদের বিরুদ্ধে প্রায় ৪ হাজার মামলা করেছেন। তাঁর কৌশল সহজ: প্রতিপক্ষকে ব্যয়সাপেক্ষ ও দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে ক্লান্ত করে দেওয়া। অনেক আইনজীবীকেও তিনি পরে নিজের পাওনা টাকার জন্য মামলা করতে বাধ্য করেছেন।

এই মামলাবাজি দিয়ে ট্রাম্প ছোট ব্যবসায়ী, কন্ট্রাক্টর, এমনকি রংমিস্ত্রিদেরও ঠকিয়েছেন। অনেক বড় আইন সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়কেও তিনি সরকারি চাপে রেখেছেন। যদি তারা ‘ভুল’ মক্কেলের পক্ষে দাঁড়ায় বা ভিন্নমতাবলম্বী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়, তাহলে তিনি তাদের প্রতি কঠোর পদক্ষেপ নেন। এখন ট্রাম্প নির্বাচিত মেয়র ও গভর্নরদের মত উপেক্ষা করে লস অ্যাঞ্জেলেস, পোর্টল্যান্ড ও মেমফিসে সেনা পাঠাচ্ছেন। মুখোশধারী ফেডারেল এজেন্টরা কৃষি ও মাংসশিল্পে কাজ করা অভিবাসীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)-এর বাজেট এখন বিশ্বের ১৭তম বৃহৎ সামরিক বাহিনীর সমান। তবু ট্রাম্প চান নিয়মিত সেনাবাহিনীও এসব অভিযানে যুক্ত হোক। সম্প্রতি ভার্জিনিয়ার কোয়ান্টিকো ঘাঁটিতে জেনারেলদের সমাবেশে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ তাঁদের বলেন, ‘ওজন কমাও, দাড়ি কামাও, এবং ওয়োক (প্রগতিশীল) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হও।’ তাঁর বেআইনি নির্দেশেই ক্যারিবীয় সাগরে তথাকথিত ‘ড্রাগ বোট’-এর যাত্রীদের হত্যা করা হয়েছে।

এই বেআইনি সংস্কৃতি একধরনের লোভ ও দুর্নীতির দ্বারা চালিত হচ্ছে। হিটলার নিজে সম্পদের লোভে অন্ধ ছিলেন না। কিন্তু ট্রাম্প প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের, তাঁর পরিবারের ও ঘনিষ্ঠদের জন্য অর্থ উপার্জন করছেন।

ট্রাম্পপন্থী ধনকুবের ইলন মাস্ক ও ল্যারি এলিসন সরকারি চুক্তি থেকে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। তাঁর নিযুক্ত বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ উপসাগরীয় অঞ্চলে গিয়ে নিজের বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। সঙ্গে আছেন তাঁর ছেলে অ্যালেক্স উইটকফ। অ্যালেক্স আবার ট্রাম্পের ছেলে এরিক ট্রাম্পের সঙ্গে ক্রিপ্টো ব্যবসায় অংশীদার। এই উদ্যোগে অর্থ দিচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এমনকি মেলানিয়া ট্রাম্পও নিজের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির জন্য জেফ বেজোসের কাছ থেকে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচ্ছেন।

এই প্রকাশ্য দুর্নীতিও ট্রাম্পের ভোটারদের বিচলিত করছে না। কিন্তু বাকিদের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন: আমরা কি ট্রাম্পের গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ধ্বংসের পথে সহযোগী হব, নাকি দেরি হওয়ার আগেই কথা বলব?

মাইকেল বার্লি সিনিয়র ফেলো, এলএসই আইডিয়াস, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো