২০১৫ সালে যখন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শেষবার একসঙ্গে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন যে পরিস্থিতি ছিল, আজ তা নেই। অনেক কিছু বদলে গেছে। চলতি সপ্তাহে তাঁরা আবারও সেখানে দাঁড়ালেন। বলা হচ্ছে তাঁরা পাশাপাশি দাঁড়ালেন সমান অংশীদার হিসেবে; কেউ ছোট, কেউ বড়—এমনভাবে নয়। কিন্তু বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল।

সাধারণভাবে মনে করা হয়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা চালানোর পর থেকে এই সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণমূলক শক্তি হয়ে উঠেছে চীন। কারণ, এখন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন।

২০২৩ সালে রাশিয়ার মোট আমদানির অর্ধেকের বেশি এসেছে চীন থেকে। অথচ রাশিয়া চীনের শীর্ষ পাঁচ বাণিজ্যিক অংশীদারের মধ্যেও নেই। রাশিয়া তার মোট অপরিশোধিত তেলের প্রায় অর্ধেক চীনের কাছে বিক্রি করলেও তা চীনের মোট তেল আমদানির মাত্র ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে বলা যায়, রাশিয়ার অর্থনীতি সচল রাখতে চীনের ওপর বড় ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। তবে এতটা নির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও চীনের হাতে পুরো নিয়ন্ত্রণ নেই। আবার রাশিয়াও নিজেকে চীনের চেয়ে ছোট বা অধীনস্থ অংশীদার হিসেবে দেখাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধের কথা ভাবুন।

এই যুদ্ধ কিছু দিক থেকে চীনের জন্য লাভজনক। এই যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার মনোযোগ প্রশান্ত মহাসাগর থেকে সরিয়ে ইউরোপে বেশি ব্যস্ত রেখেছে। কিন্তু যুদ্ধ কখন শুরু হবে, কত দূর চলবে বা কীভাবে শেষ হবে—এসব সিদ্ধান্ত একমাত্র পুতিনই নিচ্ছেন।

কাগজে-কলমে মনে হতে পারে চীন চাইলে রাশিয়ার নীতি বদলাতে পারে। কিন্তু চীন ইউক্রেনের ব্যাপারে রাশিয়ার ওপর তার সেই ক্ষমতা খাটাতে যাবে—এমন পরিস্থিতি কল্পনা করা কঠিন। কারণ, এতে শুধু ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং চীনের দীর্ঘদিনের ‘অন্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা’ নীতিরও লঙ্ঘন হবে। আর এই ব্যাপারটা পুতিনও ভালো করে জানেন।

চীন নিজেকে সব সময় ‘শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করে এলেও ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে সেই ভূমিকা ইতিমধ্যেই পালন করেছে তুরস্ক, সৌদি আরবসহ অন্য দেশগুলো। আর এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন প্রমাণ করেছেন, তাঁরা কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাতে সক্ষম।

চীনের প্রভাবের সীমাবদ্ধতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার নিজের সীমান্ত অঞ্চলে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ক্রমাগত বেড়ে চলা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ওই অঞ্চলে চীনের জন্য উদ্বেগ তৈরি করছে। মনে রাখতে হবে, ইউরোপে রাশিয়ার হস্তক্ষেপকে চীন হয়তো স্বাগত জানায়, কিন্তু কোরীয় উপদ্বীপে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা তার কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।

চীন ধীরে ধীরে রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী প্রভাবক্ষেত্র, মধ্য এশিয়ায় নিজের পদচারণ বাড়াচ্ছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধেই চীন এ অঞ্চলে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সম্প্রতি সি চিন পিং আস্তানায় দ্বিতীয় চীন-মধ্য এশিয়া সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এটি চীনের অগ্রাধিকার বোঝাতে স্পষ্ট একটি সংকেত। কারণ, এত দিন তিনি আন্তর্জাতিক সফরে সীমিতভাবে অংশ নিচ্ছিলেন।

চীন যদি ইউক্রেনের সমস্যা সামলাতে না চায় এবং নিজের পাশের দেশগুলোতে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ককে কেবল বড়-ছোট অংশীদার হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। আরও বুঝতে হবে, তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক হয়তো কিছুটা বদলেছে, কিন্তু রাজনৈতিক সম্পর্ক এখনো প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে।

ঐতিহাসিকভাবে চীন বহু বছর ধরে উত্তর দিকের প্রতিবেশী রাশিয়ার ‘জুনিয়র পার্টনার’ ছিল। কখনো কখনো তারা রাশিয়ার ‘শিকার’ও ছিল। উনিশ শতকে জার–শাসিত রাশিয়া চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে প্রায় ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার (৫ লাখ ৭৯ হাজার বর্গমাইল) এলাকা দখল করে নিয়েছিল, যা আজকের চীনের মোট ভূখণ্ডের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। পরে ১৯৬৯ সালে একই সীমান্ত নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের সাত মাসব্যাপী সংঘর্ষও হয়েছিল।

বেইজিংয়ে অনেকে মনে করেন, চীন-রাশিয়ার মধ্যে ৩০ বছর ধরে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে, সেটি স্বাভাবিক নয়, বরং এটি ব্যতিক্রম। তাঁরা মনে করেন, ঐতিহাসিকভাবে এ দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক ছিল, এখন পারস্পরিক প্রয়োজনে তারা কাছে এসেছে। চীনা নেতারা এই সম্পর্ক নতুনভাবে সাজাতে চাইছেন না, অর্থাৎ এ সম্পর্ককে কোনোভাবে তিক্ত করতে চাইছেন না। কারণ, বর্তমান অবস্থায় চীন রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তা জ্বালানি পাওয়ার মতো বড় সুবিধা পাচ্ছে। অর্থনৈতিক সুবিধা ও রাজনৈতিক উদ্বেগ একসঙ্গে থাকায় চীন ক্রেমলিনের ওপর কোনো বড় ধরনের চাপ প্রয়োগ করবে—এটা খুবই অসম্ভব।

অন্যদিকে রাশিয়া সহজে মেনে নিচ্ছে না যে চীন এত প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ, সাইবেরিয়া পাওয়ার ২ গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে আলোচনা চলছে, কিন্তু রাশিয়া এখনো চীনের দাবি মোতাবেক গ্যাস দেশীয় ভর্তুকি দামে বিক্রি করতে রাজি হয়নি। এ ছাড়া পশ্চিমা গাড়ি নির্মাতারা দেশ ছাড়ার পর চীনের গাড়ি আমদানি সাত গুণ বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়া চীনের ওপর ‘রিসাইক্লিং ফি’ (শুল্কের মতো) বসিয়েছে।

এদিকে রাশিয়ার ডানপন্থীরা ক্রমে চীনের ওপর নির্ভরতা ঠেকাতে ক্রেমলিনকে উৎসাহিত করার জন্য সরব হচ্ছে। তারা বলছে, রাশিয়ার জনবিরল দূরপ্রাচ্য অঞ্চলের পাশে চীনের বিপুল জনসংখ্যা রয়েছে। জাতীয়তাবাদী বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, চীনারা তাদের ‘হারানো ভূখণ্ডের’ কথা ভুলে যায়নি এবং তারা নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার সস্তা জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে নজর রাখছে। তাঁদের এ বক্তব্য কেবল অর্থনীতির ওপর নয়, ইতিহাস ও জাতীয় পরিচয়ের যুক্তিতেও দাঁড়িয়ে আছে। এটি রাশিয়াকে একপ্রকার ভিক্ষুকসুলভ অবস্থান থেকে বিরত রাখার চেষ্টা।

রাশিয়া আর্কটিক অঞ্চলে চীনের প্রবেশ সীমিত করছে। সেখানে চীন নিজেকে ‘নিকট-আর্কটিক দেশ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ায় রাশিয়া যত বেশি জ্বালানি, খাদ্য ও প্রযুক্তি সহায়তা দেবে, ততই কিম জং–উনের ওপর চীনের প্রভাব কমে যাবে।

তবু কিছু ক্ষেত্রে চীন আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। চীন ধীরে ধীরে রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী প্রভাবক্ষেত্র, মধ্য এশিয়ায় নিজের পদচারণ বাড়াচ্ছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধেই চীন এ অঞ্চলে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সম্প্রতি সি চিন পিং আস্তানায় দ্বিতীয় চীন-মধ্য এশিয়া সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এটি চীনের অগ্রাধিকার বোঝাতে স্পষ্ট একটি সংকেত। কারণ, এত দিন তিনি আন্তর্জাতিক সফরে সীমিতভাবে অংশ নিচ্ছিলেন।

শুধু ‘সীমাহীন অংশীদারি’র ঘোষণা দিয়ে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ককে বোঝা যাবে না। এ সম্পর্ক বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাদের বাস্তব আচরণ। তাদের সম্পর্ক আপাতত ভাঙছে না। তবে এর বিকাশ হবে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে।

রুবি ওসমান টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের চীনবিষয়ক সিনিয়র নীতি উপদেষ্টা এবং

ড্যান স্লিট টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের রাশিয়া ও ইউক্রেনবিষয়ক সিনিয়র নীতি উপদেষ্টা

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সূত্র, প্রথম আলো