স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান নিয়ে আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারত সব সময়ই নেতিবাচক ছিলো। এ ক্ষেত্রে দেশটির প্রধান ভীতির কারণই ছিলো জামায়াতে ইসলামী। মূলত, দেশটির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেসক্রিপশনেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ধর্মের নামে কোন রাজনৈতিক সংগঠন থাকতে পারবে না ধুয়া তুলে তদানীন্তন সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিলো। সরকারের ইসলাম বিদ্বেষের অংশ হিসাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে ‘রাব্বি জিদনী ইলমা’, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের মনোগ্রাম থেকে ‘ইকরা বিসমে রাব্বিকাল লাজি খালাক’, কবি নজরুল ইসলাম হল থেকে ‘ইসলাম’ এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু হিন্দু ধর্মভিত্তিক শ্রীকৃষ্ণ মিশন, রামকৃষ্ণ মিশনসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ছিলো বহাল তবিয়তে। এতেই স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার এবং ভারতের ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধভীতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অথচ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন প্রতিবেশী দেশের ইসলাম ও জামায়াত ভীতির বিষয়টি অহেতুক ও অদূরদর্শী।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারত বাংলাদেশের সাথে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়নি। অথচ উভয় দেশের জনগণের মধ্যে একটি প্রীতির সম্পর্ক অতীতে ছিল, এখনো আছে। একই সাথে উভয় দেশের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধও জোরালো ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী উভয় দেশের জনগণের মধ্যে এ প্রীতিকর সম্পর্ক কোনভাবেই মূল্যায়ন করেনি বরং এদেশে একটি আজ্ঞাবাহী ও দাসশ্রেণি সৃষ্টিতে সচেষ্ট থেকেছে। সে ক্ষেত্রে বেছে নেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগকে। ফলে দেশটির শাসকগোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশের জনগণের বড় ধরনের দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। এ যৌক্তিক দূরত্বকেই ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী ও একেশ্রেণির ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের মানুষকে ভারত বিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে এসেছে। অথচ ভারতের এমন দাবি কোনভাবেই যৌক্তিক নয় বরং বাংলাদেশের মানুষ পুরোপুরি ভারতবান্ধব ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ। শুধু তারা ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব এবং শ্রেণি তোষণের ঘোরতর বিরোধী।

সার্বিক দিক পর্যালোচনায় একথা স্পষ্টতই প্রমাণ হয়েছে যে, ভারত স্বাধীনতার পর শুধু আওয়ামী লীগের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। এর মাধ্যমে ভারত তাদের স্বার্থ উদ্ধার করার বিনিময়ে একটি জনসমর্থনহীন শক্তিকে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু গত বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে নাটকীয় পটপরিবর্তন ঘটেছে, সে ঘটনাপ্রবাহ বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে একটা বাঁকবদলের অবকাশ সৃষ্টি করেছে। যা বিবিসি বাংলায় গত ১৫ এপ্রিল প্রচারিত এবং প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী দিল্লীতে রাজনীতি, নিরাপত্তা বা কূটনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতের বিশেষ কয়েকটি ‘দাবি’ বা ‘প্রয়োজনে’ যদি বিএনপি ইতিবাচক সাড়া দেয়, তাহলে ভারতের দিক থেকেও বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে কোনও অসুবিধা থাকার কারণ নেই। এতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক নয় বরং তারা এদেশে তাদের একটি আজ্ঞাবাহী শ্রেণি প্রতিষ্ঠা করতে চায়; যারা তাদের অঙ্গুলি হেলনে চলাফেরা করবে। জামায়াতের কাছ থেকে এমন অনৈতিক সুবিধা আদায় করা সম্ভব নয় জেনেই দেশটি তাদের অতি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প থেকে দেশের একটি উদীয়মান ও জনপ্রিয় শক্তিকে হিসাবের বাইরে রেখেছে।

যেহেতু কোণঠাসা আওয়ামী লীগের সহসাই রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ফেরার কোন সম্ভাবনা নেই এবং পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির ভালো ফল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তাই খালেদা জিয়ার দলই যে ভারতের জন্য এ মুহূর্তে সেরা বাজি সেটাও তারা কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন। উদ্ভূত পটভূমিতে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের প্রধান শর্তই জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে উভয় দলের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে মতভেদ সুস্পষ্ট হলেও বিএনপি জামায়াত ছেড়ে ভারতের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন না।

অবশ্য সাউথ ব্লক মনে করছে, দীর্ঘদিনের সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব অনাকাক্সিক্ষতভাবে বেড়েছে। এ বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিক বলছেন, ‘ডেফিনিটলি জামায়াত আর বিএনপির মতবিরোধগুলো এখন খুব স্পষ্ট। উভয় দলের মধ্যে কোনও অ্যালায়েন্স হওয়া সম্ভবনাও নেই বললেই চলে। তাই এ সুযোগকে ভারত কাজে লাগাতে পারে!’ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইরের কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার এমনিতে কোনও কারণ নেই। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অবশ্যই অনেকটাই ভিন্ন! ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে কোনও রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন, এমনও নজির রয়েছে। যা একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তদানীন্তন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও বৈঠক করেছিলেন। সে সময় এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বোঝানো হয়েছিলো যে, তারা নির্বাচনে না আসলে এবং দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারলে জামায়াত ক্ষমতায় আসবে। এরপর থেকে ভারত যদিও প্রকাশ্যে অন্তত বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখারই চেষ্টা করে। কিন্তু জামায়াত বা ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে ভারতের আপত্তি একেবারেই কোনও গোপন বিষয় ছিলো না। বিজেপি এমপি শমীক ভট্টাচার্য স্পষ্ট করেই বলছেন, ‘তবে আমরা স্পষ্টতই জামাতের যে চিন্তাভাবনা, তালেবানাইজেশনের যে কনসেপ্ট তার ঘোরতর নিন্দা করি। এটার যে বিরোধিতা করে যাওয়া, সেটা আমরা করছি এবং করেও যাব!’ ভারতের কর্মকর্তা ও নীতি নির্ধারকরা এখনও একান্ত আলোচনায় পরিষ্কারই বলছেন আগামী দিনে বিএনপির সঙ্গে তাদের যে কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ‘শর্ত’ হতে হবে জামায়াতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সঙ্গ তাদের ত্যাগ করতেই হবে। অথচ ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয় ইসলামপন্থীরা কখনোই ভারতের প্রতিপক্ষ ছিলো না বরং তারাই পুরো ভারতকে নিখুঁতভাবে সাজিয়েছে।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, বিএনপি সম্পর্কেও ভারতের মনোভাব মোটেই ইতিবাচক নয়। দিল্লীতে নেতা-মন্ত্রী-কূটনীতিকরা অবশ্য যুক্তি দেন, অতীতে বিএনপি শাসনামলের অভিজ্ঞতা ভারতের জন্য তেমন ভাল ছিল না বলেই দু’পক্ষের মধ্যে আস্থা বা ভরসার সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে বিএনপির বক্তব্য, তারা বাংলাদেশে ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বিরোধী এবং যেকোনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সমান-মর্যাদার ভিত্তিতে দেখতে চায় কিন্তু তাই বলে তাদের ভারত-বিরোধী বলে চিহ্নিত করার কেনো যুক্তি নেই। এমন বাস্তবতায় ২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি প্রথমবারের মতো ভারতের ক্ষমতায় আসে। বিএনপির ধারণা ছিল, যে কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রায় ঐতিহাসিক একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। তাদের শাসনের অবসানের পর দক্ষিণপন্থি বিজেপির সঙ্গে বিএনপির মধ্যে একটা নতুন সমীকরণের সূচনা হতে পারে। কিন্তু তাদের সে ধারণা বাস্তবতা পায়নি। উল্টোদিকে প্রায় রেকর্ড সময়ের মধ্যে জমাট বেঁধেছে নরেন্দ্র মোদি আর শেখ হাসিনার ‘পার্সোনাল কেমিস্ট্রি’ বা ব্যক্তিগত রসায়ন, মজবুত হয়েছে দু’সরকারের সম্পর্ক।

মূলত, বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির অনেকে দেশটির অন্য কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ইস্যুটিই সবার আগে টেনে আনছেন। বিজেপির সিনিয়র নেতা ও পার্লামেন্টারিয়ান শমীক ভট্টাচার্যর ভাষায়, ওপার বাংলায় যারা ঘোষ-বোস-দত্ত-মিত্র গুহ ঠাকুরতারা আছেন, যারা গুপ্তা-জয়সওয়াল আছে, যারা মতুয়া আছে, বৌদ্ধ আছে-তারা তো আমাদের রক্ত, আমাদের ভাই! কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে আজকে সমস্ত হিন্দু যদি ভারতবর্ষে চলে আসতে বাধ্য হয় এবং এটাকেই তাদের ডেস্টিনেশন মনে করে তাহলে সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পক্ষেও কাক্সিক্ষত নয়! তিনি বলছেন, সে জায়গা থেকেই আমরা চাই যে, বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসুক, বাংলাদেশে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। মানুষ যাকে চাইবে তাকে বেছে নেবে কিন্তু মৌলবাদ থেকে সরতে হবে। আর কথিত মৌলবাদ বলতে তারা সব সময়ই জামায়াতে ইসলামীকে বুঝিয়েছেন। মূলত, এটিই হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের শাসকগোষ্ঠীর বাংলাদেশের জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি অশ্রদ্ধা। যা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতে চলে আসতে পারেন এমন একটা কথা বিজেপি নেতাদের প্রায়শই বলতে শোনা গেছে, যদিও বাস্তবে তেমন কোনো ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের বিজেপি নেতারা পরিষ্কার বলছেন, বাংলাদেশে বিএনপি বা অন্য যে কোনো দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপনের মূল ভিত্তিটাই হবে ক্ষমতায় এলে তারা সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারছেন কি না, সেটা! আসলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্র্র্যাতনের অভিযোগ আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশীর শুধুই বাহানা বা বায়বীয় অভিযোগ। কারণ, বাংলাদেশে কোন সাম্প্রদায়িক সংঘাত নেই বরং বিপ্লবী সরকারকে বিব্রত ও বিতর্কিত করায় প্রতিবেশী দেশের উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক শাসক গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। যা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।

কিন্তু একথাও সত্য যে, সাউথ ব্লকে একটা বিশ্বাস আছে যে, বিএনপির ডিএনএ-তেই রয়েছে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি। দলটির রাজনৈতিক উত্থানের পেছনেও ভারতের আধিপত্যবাদ বিরোধিতার একটা বড় ভূমিকা আছে। বিএনপি অবশ্য বলে থাকে বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা কখনোই তাদের নীতি নয়। তারা চায় ভারতের সঙ্গে একটি মর্যাদা ও সম্মানের সম্পর্ক। এ অবস্থানকে যে নামেই ডাকা হোক, বিএনপি তাদের সে পুরনো রাজনীতি থেকে এখন কতটা সরবে তা নিয়ে কিন্তু সন্দিহান অনেক পর্যবেক্ষক। ভারতের সাবেক আইপিএস কর্মকর্তা শান্তনু মুখার্জি ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করছেন বহুদিন ধরে।

তার বিশ্বাস, নির্বাচনী প্রচারণায় খালেদা জিয়া ভারতের বিরুদ্ধে যে বক্তৃতাগুলো দেবেন; পাবলিক সেন্টিমেন্টটা দেখে আমার এ ধারণা যে ভারতের বিরুদ্ধে ওনারা বলবেনই...কেননা ওনাদের ধারণাতে ভারতকে যত ডিসক্রেডিট করা যাবে, তত ওদের ভোটের পার্সেন্টেজটা বেড়ে যাবে! কিন্তু ভোটের সময় বিএনপি যে রাজনীতিই করুক, নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলে তাদের প্রতিবেশী ভারতকে নিয়ে অনেক বাস্তববাদী মনোভাব নিতে হবে বলেই ভারতে অনেকে মনে করেন। আর সে বিশ্বাসটাও দু’পক্ষের মধ্যে এখন থেকে একটা সম্পর্কের সেতু গড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তারপরও দেশটি বিএনপিকে পুরোপুরি আস্থায় রাখতে পারছে না। আবার পুরোপুরি উপেক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে। কারণ, আগামী নির্বাচনে বিএনপিই ক্ষমতায় আসছে বলে মনে করছেন। কিন্তু বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে নানা ছলছুতায় তাদের কাছ থেকে আলাদা করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। কারণ, তারা বাংলাদেশে তাদের আধিপত্য বাজায় রাখার জন্য যেকোন বিষের বড়ি গিলতে প্রস্তুত হলেও জামায়াতের ক্ষেত্রে তারা শূন্য সহনশীল।

বিএনপি ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে বড় অস্বস্তির জায়গাটা হল ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলের বিভিন্ন ঘটনা। ভারত বিশ্বাস করে সে সময় উলফা-সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে ঢালাও আশ্রয় পেয়েছিল। যদিও এসব অভিযোগ কোনভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। ভারতের সাবেক শীর্ষ কূটনীতিবিদ রিভা গাঙ্গুলি বলছেন, ‘আমার মনে হয় ভারতের মাথায় এটাও থাকবে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়কার রেকর্ডটা! সেটা তো একটা সময় ছিল যখন এমন অনেক কিছুই হয়েছে যেগুলো ভারতের সিকিওরিটির দিক থেকে ও ভারতের কোর কনসার্নগুলোর ক্ষতিই করেছে! তো সে রেকর্ডটাও কিন্তু আছে! নিরাপত্তা বিশ্লেষক শান্তনু মুখার্জি আবার মনে করেন, নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশের ক্ষমতায় এলে বিএনপির সে পুরনো রেকর্ড অবশ্যই বদলাতে পারে এবং ভারতও তখন উপযুক্ত সাড়া দিতে প্রস্তুত থাকবে।

শান্তনু মুখার্জি বলছেন, ‘দেখুন, পূর্বদিকে তারা আমাদের খুব ইম্পর্ট্যান্ট নেইবার, আমরা প্রতিবেশী দেশ। সম্পর্ক সব সময়ই ভাল ছিল ১৯৭১ থেকে তো যে কেউই সেখানে নির্বাচিত হয়ে আসুক আমার মনে হয় যে ভারতের দিক থেকে তাদের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক থাকবেই! থাকতেই হব। আসলে এটা তো মিউচুয়াল কনসার্ন...ওদেরও যেমন ভারতকে দরকার, তেমনি আমরাও চাইব একটা সুস্থ পরিবেশে আমরা থাকি। ফলে আমাদের নিরাপত্তার জিনিসগুলোকে যদি অ্যাড্রেস করে দেয়, আমাদের ওদের এগেইনস্টে যাওয়ার মানে হয় না। কোনো কারণ দেখছি না আমি। অন্যভাবে বললে ভারতের পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সেভেন সিস্টার্সের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যদি প্রশ্রয় না পায় কিংবা ধরা যাক চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা বহাল থাকে, বিএনপির সঙ্গে ডিল করতেও ভারতের কোনো সমস্যা নেই!

তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, ভারত কিন্তু এখন স্থির করেছে নির্বাচনের আগে অন্তত বাংলাদেশের বিশেষ কোনো দলের প্রতিই প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানানো হবে না, বা থাকলেও অন্তত সেটা প্রকাশ করা হবে না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্টতই বলছে, তারা চায় বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) ও পার্টিসিপেটরি (অংশগ্রহণমূলক) নির্বাচন যাতে সব দল ও মতের মানুষ ভোটে লড়ার সুযোগ পায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ব্যাংককে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক বৈঠকেও ঠিক এ বিষয়টির ওপরেই জোর দিয়েছেন এবং সে দেশে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে একরকম ‘তাগাদা’ দিয়েছেন। এ মুহূর্তে ভারতের কৌশলটাই হল বাংলাদেশে যত তাড়াতাড়ি একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে চাপ দেয়া এবং তাতে যারাই জিতে ক্ষমতায় আসুক, তাদের সঙ্গে একটা ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ তৈরির পথ প্রস্তুত করে রাখা। কিন্তু আওয়ামী-ফ্যাসিবাদী আমলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং ইনক্লুসিভ ও পার্টিসিপেটরী নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি বরং তারা বিনাভোটের সরকারকেই শর্তহীন সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও ভারতে এখন রীতিমত পতিতদের অভয়ারণ্য।

আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতই পতিত আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ পরিসরে টিকিয়ে রেখেছিলো। মূলত, মিত্র হিসাবে আওয়ামী লীগই তাদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু সহসাই আওয়ামী লীগের পক্ষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়ায় তারা বাংলাদেশে এখন বিকল্প মিত্রের সন্ধানে নেমেছে। এক্ষেত্রে তারা বিএনপিকেই প্রথম পছন্দে রেখেছে। কিন্তু অতীত পর্যালোচনায় তারা দলটির ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না। কারণ, ভারতের আধিপত্যবাদ বিরোধিতায় বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তির মূলমন্ত্র। আর দেশটির সবচেয়ে বেশি অপছন্দের শক্তি জামায়াতের ইসলামীর সাথে দীর্ঘদিনের মিত্রতা রয়েছে। তাই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ ঘটানো দেশটির জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে তারা কতখানি সফল হবে তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। তবে প্রতিবেশী দেশের জামায়াতভীতি অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। কারণ, জনপ্রিয়তা দেশটির জন্য মোটেই উদ্বেগের নয়; বরং তা দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।

তাই একথা সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে, ভারতের জামায়াত ভীতি অহেতুক ও অমূলক। মূলত, দলটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করতে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। একই সাথে দেশ ও জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে কথা বলে। সর্বোপরি সকল প্রকার বৈষম্য, অন্যায্যতা ও আধিপত্যবাদ বিরোধী। কিন্তু ভারত এদেশে একটি আজ্ঞাবাহী শ্রেণিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু জামায়াত সম্পর্কে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর নেতিবাচক মনোভাব শুধু অন্যায্যই নয় বরং বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা। আর এ অশুভ বৃত্ত থেকে দেশটি বেরিয়ে আসতে না পারলে উভয় দেশের মধ্যে কার্যকর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং ন্যায্যতাভিত্তিক সহাবস্থানই পারে উভয় দেশের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন মজবুত করতে।

সূত্র, সংগ্রাম