ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছাড়ার ক্ষেত্রে কিছু শঙ্কা স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে লক্ষ করা যায়, যার মধ্যে ডলারের বিপরীতে নিজস্ব মুদ্রার অবমূল্যায়ন একটি।

ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছাড়ার ক্ষেত্রে কিছু শঙ্কা স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে লক্ষ করা যায়, যার মধ্যে ডলারের বিপরীতে নিজস্ব মুদ্রার অবমূল্যায়ন একটি। অর্থাৎ ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা তৈরি হয়, দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। সেজন্য বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, এসব দেশ ডলারের বিনিময় হার বেঁধে দেয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান সংকট ও সাম্প্রতিক প্রবণতা বিবেচনায় ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার সুপারিশ দীর্ঘকাল ধরেই করে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে আইএমএফের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থছাড়ের শর্ত পরিপালনের অংশ হিসেবে ১৪ মে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্বস্তির বিষয় হলো বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রথম সপ্তাহে ডলারের দরে বড় কোনো অস্থিরতা দেখা যায়নি। গত এক সপ্তাহে ব্যাংক খাতে প্রতি ডলার ১২২-১২৩ টাকায় কেনাবেচা হয়েছে। যদিও জানা যায়, হজযাত্রীদের প্রভাবে কার্ব মার্কেটে (খুচরা বাজার) প্রতি ডলার ১২৭ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। তবে দেশে চার বছর ধরে ডলারের দরে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার তুলনায় এটা খুব বেশি শঙ্কার বিষয় নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। কেবল বাংলাদেশ ব্যাংককে তৎপর থাকতে হবে যাতে কোনো অদৃশ্য শক্তি বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। এর পর থেকেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা চরমে ওঠে। এক বছর পর প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডলারের দর ছিল ১১০ টাকা। সে বছরের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ নীতি গ্রহণ করলে তখন এক ধাক্কায় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১৮ টাকায় উঠে যায়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি বিনিময় হার আরো বেড়ে ১২০ টাকায় স্থির হয়। অর্থাৎ বাজারভিত্তিক করার পর ডলারের দামে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেনি।

ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রফতানি ও প্রবাসী আয় ঊর্ধ্বমুখী থাকায় এবং বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের দাম কমে আসায় এ সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনতে পারে। সেই সঙ্গে তারা সুপারিশ করেছেন ডলারের অব্যাহত প্রবাহ ধরে রাখতে কঠোর নজরদারি রাখতে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে ডলারের দর যেন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে না যায়, তাই সার্বক্ষণিক বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি অতি জরুরি প্রয়োজনে ডলারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে ৫০ কোটি ডলার দিয়ে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।

তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক আশ্বাস দিলেও ডলারের প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। দেশের চারটি ব্যাংকের ডলার কেনাবেচার তথ্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে তৈরি বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দামে অস্থিরতা না থাকলেও বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার সপ্তাহে প্রায় ১১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স কম এসেছে। যদিও ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে মাসের শেষ দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স বাড়ার কথা।

মূলত ডলারের দাম বাড়তে পারে ভেবে প্রবাসী বাংলাদেশী ও অ্যাগ্রিগেটরদের কারো কারো মধ্যে ডলার ধরে রাখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের এ চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। বণিক বার্তার আয়োজনে ‘বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রয়োগ ও প্রভাব’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তার ভাষ্যমতে, দাম বাড়ার আশায় ডলার ধরে রাখলে ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে প্রবাসী বাংলাদেশী ও অ্যাগ্রিগেটরদের। কারণ দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই ডলারের দর বাজারের ওপর ছাড়া হয়েছে এবং পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনাই বেশি। গভর্নরের পাশাপাশি এ আলোচনায় অংশগ্রহণকারী অর্থনীতিবিদ ও অন্যান্য অংশীজনও এ বিষয়ে জোর দিয়েছেন।

দেশের অর্থনীতি যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, সেখানে অংশীজনদের উচিত সহযোগী হয়ে কাজ করা। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান ও রিজার্ভ পরিস্থিতি উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ডলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ডলারের প্রবাহ কমলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার বোঝা দেশের জনগণকেই বহন করতে হবে। এমনিতেই দেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সহ্য করে দিনাতিপাত করছে। তাই প্রবাসী বাংলাদেশী ও অন্য সব অংশীজনের দেশের স্বার্থে ডলারের প্রবাহ ঠিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কঠোর হতে হবে যেন কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না পারে।

সেজন্য ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে যে প্রতিটি ব্যাংককে নিজেদের ওয়েবসাইটে ডলারের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বিনিময় হার প্রকাশ করতে হবে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে গ্রাহকরা জানবেন কোন ব্যাংক কোন হারে মুদ্রা কেনাবেচা করছে এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হবে। ব্যাংকগুলো যাতে এ নির্দেশনা পালন করে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে যথাযথ তথ্যের অভাবে গ্রাহকদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হবে। পাশাপাশি অন্যান্য ঝুঁকির বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।

ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু দেশের আর্থিক খাতে একটি বড় ধরনের নীতিগত সংস্কার। এর ধারাবাহিকতা ও সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারলে দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজ সহজ হতে পারে।

সূত্র, বণিক বার্তা