২০২১ সালের অভ্যুত্থানের মূল কারিগর এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধের উসকানিদাতা জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইং অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান হিসেবেই থাকছেন।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের মূল কারিগর এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধের উসকানিদাতা জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইং অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান হিসেবেই থাকছেন।ছবি : রয়টার্স

একটি নতুন নাম, নতুন নিয়োগ আর শীর্ষ পর্যায়ে সামান্য রদবদল—সব মিলিয়ে দেশকে প্রস্তুত করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। এর মধ্য দিয়েই ডিসেম্বরের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনকে বাইরের বিশ্বের কাছে প্রহণযোগ্য করাতে চায় তারা।

নেপিদোর জেনারেলরা আশা করছেন, এই নির্বাচন তাঁদের সেই বৈধতা এনে দেবে, যা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে হারিয়েছিলেন।

সমালোচকেরা এই পরিকল্পিত নির্বাচনকে সামরিক জান্তার ছলচাতুরি বলে খারিজ করে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এটা সাধারণ নির্বাচন নয়, ‘জেনারেলদের নির্বাচন’। এই অভিযোগ বাস্তবতার চেয়েও বেশি বাস্তব

সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দেশের বহু অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। জান্তাবিরোধী শক্তি (রাজনৈতিক দল ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী) যতটা ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে বলে দাবি করছে, বাস্তবে সেটি ততটা নয়। তবে এটিও পরিষ্কার, কোনোভাবেই ‘দেশব্যাপী’ আসন্ন নির্বাচন হবে না। অনেকেই এটিকে পাতানো নির্বাচন বলেই খারিজ করে দেবেন; কিন্তু নেপিদোর জেনারেলদের কাছে এটা কোনো ভাবনার বিষয়ই নয়। নির্মম বাস্তবতা হলো ১৯৬২ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে যেকোনোভাবেই হোক, সেনাশাসন চলে আসছে। এবারও তা কোনো না কোনোভাবে বহাল থাকবে।

২০১১ সালে সীমিত কিছু স্বাধীনতা চালুর পর পরবর্তী এক দশক মিয়ানমারে খানিকটা খোলামেলা পরিবেশ ছিল। তবে জেনারেলরা কখনোই প্রকৃত অর্থে ক্ষমতা ছাড়েননি। তাঁরা সব সময়ই অদৃশ্য প্রভাব ধরে রেখেছিলেন। সেনাবান্ধব সংবিধান সব সময় তাদের সুরক্ষা দিয়েছে। হুমকি দেখা দিলেই তারা হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। ২০২১ সালের অভ্যুত্থান তারই প্রমাণ।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অনেকটা সোভিয়েত আমলের রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মতোই অস্বচ্ছ। চীনসহ অনেক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে এখনো যেমনটা দেখা যায়। ফলে এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোনো বেসামরিক বা আধা বেসামরিক শক্তির কাছে ক্ষমতা ছাড়বে না।

আসন্ন নির্বাচনকে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক শক্তি ও তাঁদের আন্তর্জাতিক সমর্থকেরা যেভাবেই দেখুক না কেন, দেশটির আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের সমর্থন প্রায় নিশ্চিত। চার বছরের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির পর আসিয়ান ফলাফলকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখবেই।

চীন কোনো প্রশ্ন ছাড়াই নির্বাচনের ফলাফলকে গ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত, বাংলাদেশ ও সম্ভবত জাপানও মনে করবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হলেও সেটি নির্বাচনহীন অবস্থার চেয়ে ভালো। অস্ট্রেলিয়া, যার সেনাশাসিত মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আছে, তারাও মনে করবে নেপিদোর যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেয়ে সম্পৃক্ত হওয়াই উত্তম।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর গঠিত স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর জায়গায় নতুন সংস্থা স্টেট সিকিউরিটি অ্যান্ড পিস কমিশন (এসএসপিসি) গঠিত হয়েছে।

এটি আসলে ১৯৯৭ সালের পুনরাবৃত্তি। সে সময়ের সামরিক জান্তা যখন স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিলের নাম পাল্টে স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল রেখেছিল।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের মূল কারিগর এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধের উসকানিদাতা জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইং অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান হিসেবেই থাকছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেনারেল ন্যো সাও (যিনি ২০২৩ সালে এসএসিতে যোগ দেন) প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় পরিকল্পনামন্ত্রী হয়েছেন। তিনি একজন সামরিক অর্থনীতিবিদ।

ন্যো সাও সশস্ত্র বাহিনীর অন্যতম প্রধান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনের চেয়ারম্যান। সেনানিয়ন্ত্রিত বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড এবং ইনওয়া ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন।

কিন্তু মিন অং হ্লাইং আসলে কে? মিয়ানমারের সামরিক রাজনীতির অনিশ্চিত বাস্তবতায় হঠাৎ কোনো অঘটন না ঘটলে, নির্বাচনের পর তিনি সেনা পোশাক খুলে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে যাবেন। তবে আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক মহলে কেউ যদি মনে করেন পোশাক বদল মানেই সংস্কারের ইঙ্গিত, তাঁদের হতাশ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

অসংখ্য মানবাধিকার সংস্থা নথিভুক্ত করেছে, কীভাবে মিন অং হ্লাইং ও তাঁর সহযোগীরা হাজার, হাজার বিরোধীমতের লোকদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি প্রতিরোধ গড়ে ওঠা অঞ্চলে বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। বেসামরিক জনগণের প্রাণহানির তোয়াক্কা তিনি করেননি। এমনকি ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকাতেও বিমান হামলা চালিয়েছেন।

হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আদালত বলছে, রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের দেশছাড়া ও নিপীড়নসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে তিনি যে জড়িত, তার যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি আছে।

মিন অং হ্লাইংয়ের উত্থান সবেক সামরিক শাসক জ্যোষ্ঠ জেনারেল থান শুয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ১৯৯২ সালে ক্ষমতায় আসেন থান শুয়ে, ক্ষমতাচ্যুত হন ২০১১ সালে। এরপর মিয়ানমারে খানিকটা সংবিধানিক শাসনব্যবস্থার পথ খোলে।

থান শুয়ে ও তাঁর পূর্বসূরি জেনারেল সাও মংয়ের স্বৈরশাসনে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ রেকর্ড গড়ে ওঠে। এর ফলে মিয়ানমার বিশ্বে একঘরে রাষ্ট্র হয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি হলো ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে হাজার হাজার নাগরিককে হত্যা করা হয়।

আরও পড়ুন

মিয়ানমার পরিস্থিতি: বাংলাদেশ কি সুযোগ হাতছাড়া করছে

১৬ এপ্রিল ২০২৪

মিয়ানমার পরিস্থিতি: বাংলাদেশ কি সুযোগ হাতছাড়া করছে

এ ঘটনার জেরে নিষ্টুর দমন–পীড়ন চলেছিল। এ সময় পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারকে বর্জন করে ও নিষেধাজ্ঞা দেয়। একমাত্র চীন হয়ে ওঠে মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক মিত্র।

১৯৫৬ সালের ৩ জুলাই মাগওয়ের মিনবু এলাকায় জন্ম মিন অং হ্লাইংয়ের। ১৯৭৪ সালে তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় তিনি ডিফেন্স সার্ভিসেস একাডেমিতে ভর্তি হতে পারেন। ১৯৭৭ সালে তিনি স্নাতক হন। তবে তাঁর ফলাফল ছিল সাধারণ মানের এবং সহপাঠীদের কাছেও তিনি খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না।

কিন্তু থান শুয়ের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তিনি ধীরে ধীরে সামরিক উচ্চপদে উন্নীত হন। ২০০৯ সালে তিনি ‘ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশনস-২’-এর প্রধান হন। এ দায়িত্বে থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শান রাজ্যের কোকাং এলাকায় দমন অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে চীনে পালাতে বাধ্য হন।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর বর্মান জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলগুলো এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা মিয়ানমারের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।

সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত বাহিনী একের পর এক পরাজয় বরণ করায় সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে হ্লাইংয়ের দুর্বলতা ও অদক্ষতা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, উপ–সেনাপ্রধান জ্যেষ্ঠ জেনারেল সো উইন তাঁকে সরিয়ে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নিতে পারেন।

তবে সেই আশঙ্কা এখন অনেকটাই ম্লান। দেশের কয়েকটি অঞ্চলে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধে সেনাবাহিনী আবারও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। যদিও পশ্চিম রাখাইনে স্থানীয় প্রতিরোধ গোষ্ঠী আরাকান আর্মি তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে, তবে অন্য বিরোধী গোষ্ঠীগুলো অনেক এলাকা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো নির্বাচনের পর যদি মিন অং হ্লাইং সামরিক পোশাক ছেড়ে ‘বেসামরিক’ ভূমিকায় যান, তবে সেনাপ্রধানের মতো ক্ষমতাধর পদে আসীন হবেন কে? শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে সো উইনের নাম শোনা গেলেও বর্তমান চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল কিয়াও সোয়ার লিনের নামও আলোচনায় আছে। তবে কিয়াও সোয়ার লিনের যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা নাই। কেবল হ্লাইংয়ের প্রতি আনুগত্যের কারণে তিনি সেনাপ্রধানের পদে বসতে পারেন বলে মনে করেন অনেকেই।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অনেকটা সোভিয়েত আমলের রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মতোই অস্বচ্ছ। চীনসহ অনেক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে এখনো যেমনটা দেখা যায়। ফলে এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোনো বেসামরিক বা আধা বেসামরিক শক্তির কাছে ক্ষমতা ছাড়বে না।

২০১১ থেকে ২০২১ সালের যে সামান্য খোলামেলা পরিবেশের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, সেটিকে এখন ভুল হিসেবে দেখেন সেনারা। তাই আধা গণতান্ত্রিক সেই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি আর হবে না।

বারটিল লিন্টনার সুইডিশ সাংবাদিক ও কৌশলগত পরামর্শদাতা। প্রায় চার দশক ধরে এশিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছেন

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো