সমাজ তার প্রয়োজনেই রাষ্ট্র ও সংবিধান তৈরি করে এবং একই কারণে সমাজ নিয়ত সংবিধানের সংস্কার করতে থাকে। কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম এই প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে না, তাই এই সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় অনেক বৈচিত্র্য দেখা যায়। অতএব চলমান সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব যে অনেকভাবেই বাস্তবায়িত হতে পারে, সেটা ধরে নিয়ে আমাদের বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে হবে।
যখন কোনো দেশ নতুন করে তার সংবিধান তৈরি করতে চায়, তখন সাধারণত কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সাংবিধানিক পরিষদ তৈরি করেই সেটা করা হয়। কিন্তু বিদ্যমান সংবিধান সংস্কারের জন্যও সাংবিধানিক পরিষদ সৃষ্টি করার উদাহরণ ইতিহাসে অনেক পাওয়া যায়।
২০২২ সালে চিলি তাদের সংবিধান সংস্কারের জন্য যে সাংবিধানিক পরিষদ তৈরি করে, তার নামই রাখা হয় সংবিধান সংস্কার পরিষদ। যদিও সেই পরিষদ যে সংস্কার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য গণভোটে পেশ করে, সেটা চিলির জনগণ প্রত্যাখ্যান করেন।
ইন্দোনেশিয়া তার প্রথম সংবিধান পায় ১৯৪৫ সালে। ১৯৯৮ সালে একনায়ক সুহার্তোর পতনের পর প্রচলিত সংবিধানে ফেডারেল বা প্রাদেশিক কাঠামো প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ সীমিতকরণ এবং নাগরিক অধিকার সুরক্ষার মতো মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচিত হয়।
এই পরিষদ ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য তিন বছর ধরে আলোচনা করে ২০০২ সালে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে সক্ষম হয়। ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইতালি সাংবিধানিক পরিষদ তৈরি করে তাদের সংবিধানের মৌলিক সংস্কার করার জন্য।
সংবিধান পরিষদ তৈরি না করে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেও সংবিধানের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যায়। সংসদ সাধারণত সংবিধান সংশোধনের মধ্যে তাদের এখতিয়ার সীমাবদ্ধ রাখলেও ইতিহাসে সংসদের মাধ্যমে মৌলিক সংস্কার সাধনের উদাহরণ আছে অনেক।
শেষমেশ নাগরিকেরাই সংবিধানের সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা। সংস্কার প্রস্তাবগুলো জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলে সেটা যেকোনো পদ্ধতিতেই অধিষ্ঠিত হোক না কেন, সেটা টেকসই হতে বাধ্য।
বাংলাদেশের সংসদ দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করে। জার্মানির সংসদের দুই কক্ষ বুন্ডেস্টাগ ও বুন্ডেসরাট মিলে দুই জার্মানি একীভূত করার মতো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ-পরবর্তী নতুন সংবিধান তাদের নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই অধিষ্ঠিত করে। যুক্তরাজ্যের কোনো লিখিত সংবিধান না থাকলেও ১৯৪৯ সালে তাদের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্স, উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসের ক্ষমতা অনেক কমিয়ে ফেলে।
সংসদ তো নির্বাচিত; কিন্তু নির্বাচিত সাংবিধানিক পরিষদ ছাড়াই যে সংবিধানের বড় পরিবর্তন আনা যায়, সেই উদাহরণ খোদ বাংলাদেশেই আছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের করা বাকশাল বাতিল করা হয় জিয়াউর রহমানের একক সিদ্ধান্তে। সেই পরিবর্তন নাগরিকদের পক্ষে ছিল বলে সেই সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
এক ব্যক্তির নেতৃত্বে সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে ফ্রান্সের পঞ্চম রিপাবলিক। পঞ্চাশের দশকে ফ্রান্স যখন তাদের সাংবিধানিক পরিষদের তৈরি চতুর্থ রিপাবলিকের সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে এবং তাদের উপনিবেশ আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে ফ্রান্সের সমাজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তখন চার্লস দ্য গলের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়িয়ে গণভোটের মাধ্যমে পঞ্চম রিপাবলিকের সংবিধান গৃহীত হয়। সেই পঞ্চম রিপাবলিক এখনো অটুট।
অনেক সময় অনির্বাচিত সংস্থাও সংবিধানের মৌলিক এবং স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে। ১৯৭৩ সালে ভারতের উচ্চ আদালত সংবিধানের মূল কাঠামো নিয়ে তাঁদের রায়ের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদের সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করেন। ১৯৪৭ সালে দখলদার মার্কিন প্রশাসন জাপানের নির্বাচিত সংসদের সংবিধান প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে সেই সংসদকে দিয়েই নিজেদের প্রস্তাবিত সংবিধান পাস করিয়ে নেয়। জাপান এখনো বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সেই সংবিধান নিয়েই চলছে।
এই দিকে সাংবিধানিক পরিষদের তৈরি করা সংবিধানও অনেক সময় দেশের কোনো কাজে আসে না। চিলির উদাহরণ থেকে আমরা দেখলাম, যেখানে সাংবিধানিক পরিষদের প্রস্তাব চিলির জনগণ প্রত্যাখ্যান করেন। আইসল্যান্ডে আবার দেখা যায়, তাদের জনগণ ১৯১২ সালে তাদের সাংবিধানিক পরিষদ দিয়ে যেই সংবিধান প্রস্তাব গণভোটে পাস করে, সেই সংবিধান তাদের সংসদ নাকচ করে দেয়। বিচিত্র এই পৃথিবী।
অনেক সময় সাংবিধানিক পরিষদের পাস করা সংবিধান নিজেই দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে। সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাক ২০০৫ সালে তাদের সরকার হিসেবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংসদ নির্বাচিত করে, যাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। প্রস্তাবিত সংবিধান গণভোটে ৮০ ভাগ সমর্থন পেয়ে পাস হলেও সংখ্যালঘু সুন্নিরা সেই সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে এবং ইরাক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সেই গৃহযুদ্ধ থেকে ইরাক এখনো বের হতে পারেনি।
এত সব উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের জন্য তার সংবিধান সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে, সেটা বাস্তবায়নের জন্য তার সামনে অনেকগুলো পথ খোলা আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধ্যাদেশ, সাংবিধানিক পরিষদ, সংবিধান সংস্কার পরিষদ, এক নির্বাচনে সাংবিধানিক পরিষদ এবং সংসদ, কেবল সংসদ এবং গণভোট; সব পথেই সংবিধান সংস্কার সম্ভব।
অনেকেই মনে করেন যে সাংবিধানিক পরিষদ সৃষ্টি হলে সংবিধান নতুন করে লেখার চাপ সৃষ্টি হবে এবং দেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। আমরা অন্য দেশের উদাহরণ থেকে দেখলাম যে সংবিধান সংস্কারের জন্যও সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচন করা যায়; সুতরাং সাংবিধানিক পরিষদ সৃষ্টি করলেই চলমান সংবিধান বাতিল হয়ে যায় না। অতএব নতুন সংবিধান তৈরির প্রশ্ন ওঠে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পরিষদ, সংবিধান সংস্কার পরিষদ বা সংসদ, সব ক্ষেত্রেই ঐকমত্য সনদের ভিত্তিতেই সংস্কার করবে, বিধায় নতুন সংবিধানের আবদার খুব একটা হালে পানি পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
বাস্তবায়নের পথে আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সংস্কার প্রস্তাবনার বিষয়ে কোনো দ্বিধা না রেখে একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো। আপত্তি নিষ্পত্তি করে একটা পরিষ্কার প্রস্তাব দাঁড় করাতে পারলে বাকি পথ সহজ হয়ে যাবে। সেই পরিষ্কার করার পথে সংস্কারের পরিসর নিয়ে ঐকমত্যে আসাটা আরও একটা বড় পরীক্ষা। এখন পর্যন্ত যতটুকু বিষয়ে ঐকমত্য পৌঁছানো গেছে, সেটুকুতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নেই। তার মানে, দলগুলোকে ঐকমত্যে আসা প্রস্তাবের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
যদি সংস্কার নিয়ে কোনো যদি কিন্তু ছাড়া একটা পরিষ্কার প্রস্তাব আনা যায় এবং যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, উচ্চকক্ষ, নারীর অংশগ্রহণ, সাংবিধানিক পদে নিয়োগসহ ক্ষমতাকাঠামোর কিছু মৌলিক সংস্কার সংযুক্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে সেই সমঝোতার সনদের পক্ষে অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে সংসদের হাতেই বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পণ করার সুযোগ থাকবে।
আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলাকালে সরকার পরিচালনা করবে কারা। চলমান মব আর চাঁদাবাজির অস্থিরতায় দেশের অনেকেই নির্বাচিত সরকারের হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছেন, সে জন্য অনেক সময় নিয়ে সংবিধান সংস্কার করে তারপর নতুন সরকারের ক্ষমতায় আসার সুযোগ আর এখন নেই। অতএব সামনের নির্বাচন হতে হবে সংসদ যোগ সাংবিধানিক সভার নির্বাচন, ঠিক সত্তরের নির্বাচন যেমন হয়েছিল, তেমন। সংস্কার প্রস্তাব সম্পর্কে পরিষ্কার ঐকমত্যে পৌঁছানো গেলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা খুব কম সময়ের মধ্যেই সংস্কার বাস্তবায়ন করে তাঁদের আইনসভা এবং সরকারি দায়িত্ব পালন শুরু করতে পারবেন।
এই আলোচনা থেকে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে যতই চেষ্টা করি না কেন, পরিপূর্ণভাবে সংস্কার টেকসই নিশ্চিত করার কোনো প্রক্রিয়া দুনিয়াতে নেই। গত ৭৫ বছরে পৃথিবীতে যে ২০০টি দেশ আছে, সেখানে ৬০০ সংবিধান তৈরি হয়েছে। তার মানে, সংবিধানের সংশোধন অবশ্যম্ভাবী। তার ওপর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে সংবিধান সংস্কারের পথ খোলা না রাখলে সেই রাষ্ট্রে সাংবিধানিক গোলযোগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। সব দিক বিচারে বাংলাদেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলেই সংস্কার টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বাড়বে।
শেষমেশ নাগরিকেরাই সংবিধানের সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা। সংস্কার প্রস্তাবগুলো জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলে সেটা যেকোনো পদ্ধতিতেই অধিষ্ঠিত হোক না কেন, সেটা টেকসই হতে বাধ্য।
সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের একজন রাজনৈতিক কর্মী। ই-মেইল [email protected]।
মতামত লেখকের নিজস্ব