আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে ধন্যবাদ। তিনি সত্যটা স্বীকার করেছেন। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরতে গিয়ে এই উপদেষ্টা বলেছেন, ‘মিথ্যা মামলা নিয়ে আমার বিরক্তি ও আপত্তি বহুবার প্রকাশ করেছি। বারবার আপনাদের বলি, আমাদের সরকারের আমলে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, একটা হচ্ছে মিথ্যা মামলা, মামলা হতে পারে, কিন্তু মিথ্যাভাবে লোককে ফাঁসানো, মানে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা; আরেকটা হচ্ছে মব জাস্টিস। মব সন্ত্রাস আমি বলি। এই দুইটা আমাদের খুবই পীড়িত করে।’
আইন উপদেষ্টা সত্য স্বীকার করলেও এই সরকারের ভেতরেই আবার কেউ কেউ সেটি স্বীকার করতে চান না। যাঁরা মব সন্ত্রাস বা মব ভায়োলেন্সকে প্রেশার গ্রুপ বা নানা কিছু কাজ বলে লঘু করতে পছন্দ করেন।
আইন উপদেষ্টা যে তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে ১৫ হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করার কথা বলেছেন, সেগুলো আগের সরকারের আমলের। কিন্তু তিনি এখন যেসব কারণে বিব্রতবোধ করছেন, দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সেগুলো চলমান আছে।
আইন উপদেষ্টা যেদিন মব সন্ত্রাস ও মিথ্যা মামলা নিয়ে কথা বলেছেন, সেদিনই মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিবেদনে দেখলাম, গত জুলাই মাসে মব সৃষ্টি করে (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ) বা গণপিটুনি দিয়ে ১৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। জুলাই মাসে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের আটটি ঘটনা ঘটেছে বলে এমএসএফের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যার মধ্যে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ১৫টি বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও আছে।
মব সন্ত্রাস চালিয়ে যারা সমাজে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সেটি তারা কতটা দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে করছে বা আদৌ করছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানটি হয়েছিল গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। এক বছরের ব্যবধানে সেই গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা, আইনের শাসন ও সহিষ্ণু সমাজ বিনির্মাণে আমরা কোথায় আছি, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনেই স্পষ্ট।
এতে বলা হয়, ‘স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর এক বছর ধরে ক্ষমতায় আছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু তারা মানবাধিকার রক্ষার চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে। এই সরকারও কথিত রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে নির্বিচার আটক করছে এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় তারা এখনো কাঠামোগত সংস্কার আনতে পারেনি।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেন এক জায়গায় আটকে আছে। একদিকে সংস্কারবিহীন নিরাপত্তা বাহিনী, অন্যদিকে মাঝেমধ্যে সহিংস ধর্মীয় কট্টরপন্থী এবং এমন কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সামলাতে হচ্ছে, যারা বাংলাদেশিদের অধিকার রক্ষার চেয়ে শেখ হাসিনার সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বেশি আগ্রহী।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে সরবরাহ করা তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ২০২৪ সালের আন্দোলনকালের হত্যা বা হত্যাচেষ্টার অন্তত ৬৮টি মামলার আসামি হয়ে গত অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন।
কোনো সাংবাদিক আইন ভঙ্গ করলে কিংবা দুর্নীতির আশ্রয় নিলে তাঁর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হবে। তাই বলে সবার বিরুদ্ধে হত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলা দিয়ে কী ফায়দা নিতে চায় সরকার? আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করতে চাইত। গণরোষে সেই সরকারের বিদায় নেওয়ার পরও মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ না হওয়ার কী কারণ?
তবে এসব ঘটনার মধ্যে ৩৬টি ঘটেছিল এমন সময়ে, যখন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। অন্যান্য অনেক ঘটনার মতো এখানেও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি। অন্যান্য বড় রাজনৈতিক মামলায় আটক ব্যক্তিরাও অভিযোগ করছেন, তাঁদের ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের চিকিৎসাসেবা ও জামিন থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এ রকম সাজানো মামলার অভিযোগ উঠেছে অনেকের ক্ষেত্রে। রাজনীতিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী সবার ক্ষেত্রে ঢালাও খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য অতীতের রাজনৈতিক সরকারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারও এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনকে কিছুটা একপেশে বলে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করছে।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় প্রথমে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, কোনো শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পরে দেখা গেল, বেশ কিছু শিশু গ্রেপ্তার হয়েছে। প্রথম আলোর গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি নূতন শেখের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পথসভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮টি শিশু রয়েছে। এর মধ্যে গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার সাত শিশুর জামিন আবেদনের শুনানি হয়। গোপালগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) সৈয়দ আরাফাত হোসেন তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর আগে সোম ও মঙ্গলবার পাঁচ শিশুর জামিন আবেদন করা হয়। তাদের জামিন নামঞ্জুর করা হয়। ওই পাঁচ শিশুর জামিন আবেদন করা হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
এক শিশুর বাবা বলেন, ‘সংসারে অভাব-অনটন, নিজেরাই সংসার চালাইতে পারি না। আমার কষ্ট দেখে ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেয়। সে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রমজান শেখ নামের এক রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে। কাজের সময় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।’
ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছরের জুলাই ও আগস্টের ঘটনা-সম্পর্কিত বিভিন্ন মামলায় কমপক্ষে ২৬৬ সাংবাদিককে জড়ানো হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকায়—৮৮টি। সিলেট ও চট্টগ্রামে যথাক্রমে ৩৯ ও ৩৬ সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামি হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ—সংখ্যায় যা প্রায় ৫০—সরাসরি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন। এর বাইরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিশোধমূলক কারণে সাংবাদিকদের আসামি করা হয়েছে। (ডেইলি স্টার, ৩ মে ২০২৫)
কোনো সাংবাদিক আইন ভঙ্গ করলে কিংবা দুর্নীতির আশ্রয় নিলে তাঁর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হবে। তাই বলে সবার বিরুদ্ধে হত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলা দিয়ে কী ফায়দা নিতে চায় সরকার? আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করতে চাইত। গণরোষে সেই সরকারের বিদায় নেওয়ার পরও মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ না হওয়ার কী কারণ?
সরকারের উপদেষ্টারা বলেন, মামলা সরকার করে না। ভুক্তভোগী করেন। কিন্তু বাস্তবে ভুক্তভোগীকে দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই মামলা করান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ তাঁদের সক্রিয় সহায়তা করে। ভুক্তভোগীর কাজ হয়ে দাঁড়ায় মামলার কাগজপত্রে সই দেওয়া। এ রকম অনেক ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পরও কেন সরকার সত্য লুকাতে চায়, সেটাই প্রশ্ন।
আইন উপদেষ্টা বলেছেন, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে তাঁর মন্ত্রণালয়ের যা করণীয়, সেটা করছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এ ধরনের মামলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কিংবা তাঁর মন্ত্রণালয় এ ধরনের কতজন মামলাবাজকে আইনের আওতায় এনেছে, সেই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না। যেসব মামলা সরকার জানে উদ্দেশ্যমূলক, সেসব মামলায় অভিযুক্তরা যাতে জামিন পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা তো করতে পারে।
আশা করি, আদালতের ওপর আমাদের হাত নেই বলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মতো তাঁরা দায় এড়ানোর চেষ্টা করবেন না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
মতামত লেখকের নিজস্ব