১.
২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারার অধীন কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দেওয়া দণ্ড বা জরিমানা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
উল্লিখিত ধারায় অপরাধ সংঘটনে সহায়তার অপরাধে কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালে নিষ্পন্নাধীন কোনো মামলা বা অন্যান্য কার্যধারা অথবা পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্তাধীন মামলা বা কার্যক্রম বাতিল হবে এবং এ বিষয়ে আর কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না।
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আইনটি ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দোহাই দিয়ে করা হলেও মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল বিরোধী দলের নেতা–কর্মী ও সাংবাদিকেরা। সরকারের সামান্য সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দেওয়া হতো। ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতেও এই আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকার আইনের উল্লিখিত ধারায় করা মামলা ও দণ্ড বাতিল করে একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছে।
এর পাশাপাশি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) বিবৃতিটি পড়লে আমরা দেখব এই সরকারও পুরোনো ধারায় চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খোলনলচে বদলালেও আওয়ামী লীগ আমলে প্রণীত সন্ত্রাস দমন আইনটি পুরোপুরি রেখে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার এইচআরডব্লিউ’র বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত অওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক হিসেবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সম্প্রতি সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবহার করছে।’ সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের মানবাধিকার দলের অবিলম্বে নির্বিচার আটক ব্যক্তিদের মুক্তির দাবি জানানো উচিত। সেই সঙ্গে মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং বেআইনি রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের সময় বাংলাদেশের মানুষকে যেসব সহ্য করতে হয়েছে, সেই একই ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ অন্তর্বর্তী সরকারের করা উচিত নয়। তা সেটি বিরোধী রাজনীতিবিদদের ধরে নিয়ে কারাগারে পুরে দেওয়া হোক বা শান্তিপূর্ণ ভিন্নমতকে বন্ধ করে দেওয়া, তা যেটিই হোক না কেন।
এইচ আর ডব্লিউর অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। বহু মানুষকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন, যার মধ্যে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করার মতো বিষয়ও আছে। (প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর, ২০২৫)
জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, অমলধবল কোনো চাকরি নেই পৃথিবীতে। তাঁর কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে অমলধবল কোনো সরকার নেই। স্বৈরাচারী শাসকেরা বরাবর তাদের শাসনকাজ নির্বিঘ্ন করতে কালো আইনের আশ্রয় নেয়; কিন্তু স্বৈরাচারকে হটিয়ে যারা জনগণের সম্মতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, তারাও রহস্যজনক কারণে সেই কালো আইন ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল। সেই সময়ে আইনটি খারাপ হলে এখন ভালো হওয়ার কোনো কারণ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার সাহস দেখাতে পারে, সন্ত্রাসবিরোধী আইন বা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বহাল তবিয়াতে রাখছে কেন? যারা নিবর্তনমূলক আইন সংযোজনের কারণে বায়াত্তরের সংবিধানের কঠোর সমালোচনা করেন, তারাও এসব কালো আইন রাখা ও ব্যবহারের পক্ষে নানা যুক্তি দাঁড় করান। কালো আইন সব সময়ই কালো। সরকার বদলের পর সেটি সাদা হয়ে যায় না।
২.
জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনার ধরন দেখে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তিই মনে পড়ে। ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ আগামী ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষরিত হবে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কার্যালয়ের সভাকক্ষে কমিশনের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
কিন্তু জুলাই সনদে যারা সই দেবে, সেই রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে ঐকমত্য থাকলেও গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ আছে। এ অবস্থায় কমিশন গণভোটের দিনক্ষণের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে যদি একমত না হতে পারে, তাহলে তারা ইতিহাসের সেরা নির্বাচনটি কীভাবে করবে?
৩.জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনার মধ্যে এনসিপি প্রধান ও সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের একটি বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের (নিরাপদ প্রস্থান) কথা ভাবতেছে।’ তিনি কারও নাম না বললেও সময়মতো নাম প্রকাশ করে দেবেন বলেও মন্তব্য করেছেন।
অন্যরা নিশ্চুপ থাকলেও অন্তত তিনজন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের মিঠেকড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সড়ক যোগাযোগ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নিজে পদে থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করিনি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাউকে ব্যবসা বা চাকরি দিই নাই নিজের সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি শিক্ষকতার সূত্রে, ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার নিশ্চিত সুযোগগ্রহণ করিনি। তাই আজ ৭২ প্লাস বছর বয়সে আমাকে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তা হবে গভীর দুঃখের বিষয়!’ একজন পরচ্ছিন্ন চরিত্রের আমলার পক্ষে এই সেইভ এক্সিট নেওয়ার অভিযোগ মেনে নেওয়া কঠিন।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘আমি একদম কোনো এক্সিট খুঁজছি না। দেশেই ছিলাম, এর আগেও বহু ঝড়ঝঞ্ঝা এসেছে। সেসব ঝড়ঝঞ্ঝা প্রতিহত করে দেশেই থেকেছি। বাকিটা জীবনও বাংলাদেশেই কাটিয়ে যাব।’ মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ এনসিপি নেতার বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক’ বলে মন্তব্য করে বলেছেন, উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিটের দরকার আছে বলে মনে করি না।
সেইভ এক্সিট বলতে আমরা নিরাপদ নির্গমন বুঝি। এটা তাদের প্রয়োজন হয়, যাদের সরকারে আগমন নিয়ে বিতর্ক আছে। যেমন ২০০৭–২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত সরকারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের সেইভ এক্সিট প্রয়োজন হয়েছিল। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর কাছে তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ তুললে তিনি তাঁকে এক ধরনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তো এসেছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে। তাদের সেইভ এক্সিট নেওয়ার প্রশ্ন এল কেন? তাও এমন একজন ব্যক্তির কাছ থেকে যিনি এই সরকারে কয়েক মাস উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে পদত্যাগ করে এসে নতুন দল গঠন করেছেন।
● সোহরাব হাসান সাংবাদিক ও কবি