এক বছর পার হলেও গণ-অভ্যুত্থানের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে ছিল, তার অনেক কিছুই বাস্তবতার মুখ দেখেনি। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে নির্বাচনের জন্য ক্রমাগত চাপের মধ্যেই রেখেছিল। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকে নির্বাচনের অনিবার্যতার যুক্তি দিয়ে আসছিল।
ইতিমধ্যে আমরা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের মাধ্যমে জানতে পারি যে ২০২৬–এর ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনের সময় নিয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবিত নানা সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা থাকলেও তারা সংস্কারবিষয়ক তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি করতে পারেনি। বছর পার হয়ে গেলেও সংস্কার বিষয়ে তেমন একটা অগ্রগতি না হওয়ার কারণে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করছেন। গবেষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। সেই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে এত কম সময়ে এমন একটি অস্থায়ী এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে আসলে কতটা সংস্কার করা সম্ভব?
যে উচ্চাভিলাষী প্রত্যাশা এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের সংস্কার এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেছে, সেটি এই স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই বর্তমান বাস্তবতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব সংস্কার নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করা জরুরি, সেদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মনোযোগ দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জায়গায় তাদের মনোযোগ দিতে হবে সেটি হলো, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনের জন্য ন্যূনতম যেসব সংস্কার জরুরি, সেসব সংস্কার করে ফেলা।
পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নির্বাচনগুলো যেন একটি সুষ্ঠু এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় করা যায়, সে ধরনের স্থায়ী একটি কাঠামোর দিকে জাতিকে নিয়ে যাওয়া। কেননা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এই অল্প সময়ের মধ্যে এখন আর অনেক সংস্কার করা সম্ভব নয়।
আমরা যদি বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে যারা সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করতে পেরেছে, তারা কেউই একটা স্বল্প সময়ে দেশের সব সংস্কারপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পারেনি। সংস্কারকে তারা একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে নিয়েছে এবং তার ফল এখন তারা ভোগ করছে।
এর মধ্যে চীনের কথা বিশেষ করে আমরা উল্লেখ করতে পারি। প্রাথমিক ও মৌলিক সংস্কারের জন্য তারা বছরের পর বছর সময় নিয়েছে। আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমরা বুঝতে পারি যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর অপ্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষার বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার কারণেও আমাদের মধ্যে সেই আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল।
এক বছর পর যখন আমরা গণ-অভ্যুত্থানের দিকে ফিরে তাকাই, তখন বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করলে আমাদের এই বিস্তর প্রত্যাশা আসলে বাস্তবতা বিবর্জিত ছিল। সেদিক দিয়ে আমি বলব না, তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ; তবে যে কর্মযজ্ঞ এই সরকার শুরু করে দিয়েছে, একে ইতিবাচকভাবে টেনে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন রাজনৈতিক দলগুলোর।
যেহেতু এখন আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির দিকে যাচ্ছি, আমাদের সব দৃষ্টি নির্বাচনের দিকে থাকবে। তাই সংস্কার প্রক্রিয়াকে যেন আমরা ভুলে না যাই, সেদিকে নজর দিতে হবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকার যেন পরবর্তী সংস্কারগুলো ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেন একটি মতৈক্য গড়ে তোলা যায়, এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঐকমত্য কমিশন কিছু কাজ এগিয়ে রাখতে পারে।
আমরা অনেকবারই দেশকে বিনির্মাণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই সুযোগ আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। বারবার আন্দোলন–সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সরকার বদলের যে ঐতিহ্য আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে, সেটি একটি গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ হতে পারে না। কেননা, গণ-অভ্যুত্থানে ঝরে যাওয়া প্রাণের কোনো বিনিময় হতে পারে না।
পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও ঐকমত্যে রাজি হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে তাদের নির্বাচনের ইশতেহারে নিয়ে আসা বা তার সঙ্গে সমন্বয় করার দিকেও ইতবাচকভাবে নজর দিতে হবে। যেহেতু নির্বাচন খুব শিগগির; অর্থাৎ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে একমত হওয়া সংস্কারের বিষয়গুলো যুক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে, তাহলে তাদের জনসমর্থন যেমন বাড়বে, সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়েও মানুষের মধ্যে একটি আস্থা তৈরি হবে। দেশগঠনে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আর নির্বাচিত দল যদি পরবর্তী সময়ে সংস্কারের মাধ্যমে দেশ পুনর্গঠনে নজর না দেয়, সেটি আমাদের জাতির জন্য একটি হতাশার বিষয় হবে।
আমরা অনেকবারই দেশকে বিনির্মাণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই সুযোগ আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। বারবার আন্দোলন–সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সরকার বদলের যে ঐতিহ্য আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে, সেটি একটি গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ হতে পারে না। কেননা, গণ-অভ্যুত্থানে ঝরে যাওয়া প্রাণের কোনো বিনিময় হতে পারে না।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন দেশের স্বার্থে গণতন্ত্রের বিশেষায়িত দিকের বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে, সেখানে আমরা এখনো সেই ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক ধারাতেই রয়ে গেছি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নতুন গণতান্ত্রিক ধারাকে মেনে নিতে একধরনের সংশয় এর মধ্যে আছে, অথচ দেশের উন্নয়নের জন্য যা প্রয়োজন, তাকে গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করলে দেশ উন্নয়নের দিকে আরও দ্রুত অগ্রসর হবে। দীর্ঘ সময় গণতন্ত্রহীনতায় থাকার সঙ্গে সঙ্গে বিগত সময়ে আমাদের দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়, রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতিসহ আরও নানা অনিয়ম। রয়েছে মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা।
এসব থেকে মুক্তি পেতে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানাবিধ প্রস্তাবনাগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখা রিপোর্ট হিসেবে যেন থেকে না যায়, সেদিকে নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমরা কত কমিশন হতে দেখলাম, তারা কত রিপোর্ট তৈরি করে, রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে হস্তান্তর করল, কিন্তু দেশ সেই একই জায়গায় রয়ে গেল। কেননা, আমরা তাদের সঠিক বাস্তবায়ন দেখলাম না। সাধারণ মানুষের মুখেও আর হাসি ফুটল না। সাধারণ মানুষ খুব বেশি কিছু চায় না। তারা চায়, আয় ও ব্যয় এর সমন্বয় করে যেন তারা দিন কাটাতে পারে, বাজারব্যবস্থা যেন সিন্ডিকেটমুক্ত হয়; তারা চায়, ঘরে ও বাইরের নিরাপত্তা। আমাদের সব স্থানের নিরাপত্তা প্রয়োজন।
আমাদের সন্তানেরা যেন বাসার বাইরে নিরাপদ বোধ করে, পিতা-মাতাদের যেন তার সন্তানদের জন্য সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকতে না হয়। আইনের শাসনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে যেন এই বিষয়গুলোর যথাযথ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
মোটকথা, আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো যেন সঠিকভাবে নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নয়নের সুফলগুলো যেন দেশের সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রাখতে হবে। বারবার গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের সন্তানদের আর হারাতে পারব না। সন্তানহারা পিতা-মাতার অসহায় মুখ যেন আমাদের আর দেখতে না হয়।
তাই দেশগঠনের জন্য সব রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করে যেতে হবে। এবারের গণ-অভ্যুত্থান যে অনন্য সুযোগ নিয়ে এল, তা যেন সত্যিকার অর্থেই আমরা দেশ গড়ার কাজে লাগাই, সেই প্রত্যাশা থাকবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি।
আপনারা যেন আমাদের দেশের অসহায় জনতাকে ভুলে না যান, সেটা নিশ্চিত করবেন। যদিও আমরা দেখেছি যে মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চায় না; কিন্তু আমি মনেপ্রাণে চাই, আমার এই ধারণা যেন এবার ভুল প্রমাণিত হয়। আমরা যেন অতীত ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, সেই প্রত্যাশা থাকবে।
বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়