ভোটের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার পুরোনো উপায়গুলোর সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ভোটের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার পুরোনো উপায়গুলোর সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।ছবি: এআই ভিডিও থেকে নেওয়া প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তৈয়বকে দেখা যায় গরু মার্কা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের প্রার্থী সোলায়মান মিয়ার বাড়িতে গিয়ে এক গ্লাস দুধ খায়। ভোট পাওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে প্রার্থীর এই দুধ বিতরণ। ‘দুধ, খেতে কেমন?’ সোলায়মান মিয়ার এ প্রশ্নের উত্তরে সে জবাব দেয়, ‘মধুর চেয়ে মিষ্টি। এই দুধ খাইয়া মধু খাইলে, মধু পাইনসা লাগব।’ দুধ খাওয়ানোর কারণ আঁচ করতে পেরে তৈয়ব বলে, ‘আরেক গ্লাস দুধ দিতে বলেন। এক গ্লাস দুধে পেট ভরে মন ভরে না।’ এই একই তৈয়বকে নির্বাচনের দিন আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী মনসুর এক শ টাকার নোট হাতে দিয়ে নির্বাচনের জন্য কাজ করতে বললে তৈয়ব অনুরোধ করে, ‘আর এক শটা টাকা দেন, অসুবিধার মধ্যে আছি।’ এমনকি পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করা নাটকের আরেক চরিত্র ফজলুর হাতে যখন মনসুর টাকা তুলে দেয়, তখন ফজলুও স্লোগান দিতে থাকে, ‘ভোট দিবেন কিসে, ঘড়ি মার্কা বাক্সে।’ সমাজ ও জীবনকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারার অসামান্য গুণের অধিকারী হুমায়ূন আহমেদ নির্বাচনের প্রার্থী ও ভোটারের চিত্র তুলে এনেছেন দারুণ দক্ষতায়। ভোটের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার সেই পুরোনো উপায়গুলোর সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওতে স্লোগান হয়েছে, ‘ভোট দিলাম সন্দ্বীপে, এমপি পেলাম মালদ্বীপে’ (প্রথম আলো, ১০ জুলাই ২০২৫)। মানুষকে দিয়ে কথা না বলিয়ে কথা বলানো যাচ্ছে এআই দিয়ে। নিজে দলের পক্ষে সমর্থন আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে চলছে অন্য দলের বা প্রার্থীর সমর্থন কমিয়ে আনার চেষ্টা। অনেক গঠনমূলক ও উদ্ভাবনী কাজের সঙ্গে সঙ্গে গুজব, প্রপাগান্ডা, অপতথ্য ছড়ানোর কার্যকরী এক মাধ্যম এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ফ্রি কিংবা সামান্য কয়েক ডলার খরচ করলেই বানানো যাচ্ছে কৃত্রিম অডিও, ভিডিও ও ছবি। ডিপফেক ও জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় অবিকল নকল করা যাচ্ছে কণ্ঠ, ছবি বা মুখাবয়ব। সাধারণ একজন ব্যবহারকারীর কাছে সেগুলো আসল নাকি নকল, সেটির পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব। উচ্চশিক্ষিত মানুষও অনায়াসে ধরা পড়ছেন সেই ফাঁদে। মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন। আর ঠিক বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জায়গাতেই সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনের প্রচারণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সাইবার অ্যাটাক যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে সেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে রোমানিয়ার ডিসেম্বর ২০২৪ সালের নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। ভোট গ্রহণের ঠিক দুই দিন আগে রোমানিয়ার সাংবিধানিক আদালত নজিরবিহীনভাবে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাতিল করেন। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনের প্রচারণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সাইবার অ্যাটাক যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে সেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে রোমানিয়ার ডিসেম্বর ২০২৪ সালের নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। ভোট গ্রহণের ঠিক দুই দিন আগে রোমানিয়ার সাংবিধানিক আদালত নজিরবিহীনভাবে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাতিল করেন। সেখানে ভোটের দুই সপ্তাহ আগে একজন প্রার্থীর সমর্থনে প্রায় ২৫ হাজার টিকটক অ্যাকাউন্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে প্রায় ৮০০টি অ্যাকাউন্ট ২০১৬ সালে তৈরি করা হয়েছিল এবং নির্বাচনের আগপর্যন্ত মূলত নিষ্ক্রিয় ছিল। (দ্য কনভারসেশন, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪) তদন্তে জানা যায়, নির্বাচনী প্রচারের জন্য অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ করা হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের। এমনকি টিকটকের অভিযুক্ত করা হয়েছে নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে করা পোস্টকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য। ইউরোপীয় কমিশন টিকটকের সুপারিশকারী (রেকমেন্ডার) সিস্টেমের বিস্তারিত জানাতে এবং তথ্য কারসাজি মোকাবিলায় টিকটক কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে, সেটিও সরবরাহ করতে বলে। টিকটক জানায়, নভেম্বরের শেষের দিকে রোমানিয়া থেকে পরিচালিত ৭৮টি অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্ক তারা সরিয়ে দিয়েছে, যেসব অ্যাকাউন্ট একজন প্রার্থীর হয়ে প্রচারের পাশাপাশি ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। টিকটক দাবি করে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রোমানিয়ায় তারা প্রায় ৪৫ মিলিয়ন ভুয়া লাইক, ২৭ মিলিয়নেরও বেশি ভুয়া ফলো রিকোয়েস্ট সরিয়েছে এবং ৪ লাখের বেশি স্প্যাম অ্যাকাউন্ট তৈরি বন্ধ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে রোমানিয়ার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৮৫ হাজারের বেশি সাইবার-আক্রমণ হয়েছে, যেগুলো মূলত চালানো হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে। শুধু রোমানিয়া নয়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ ধরনের আক্রমণ আরও বহু দেশেই হয়েছে। যেমন স্লোভাকিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে একজন প্রার্থী এবং একজন মিডিয়া প্রতিনিধির মধ্যে কথোপকথন ভাইরাল হয়ে যায়, যেখানে ভোট কেনাসহ নির্বাচনে কারচুপি করার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। অথচ কথোপকথনের ভুয়া রেকর্ডিংগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছিল (সিএনএন, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। প্রশ্ন হলো, আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কনটেন্ট তৈরি করা হলে সেটির ঘোষণা দেওয়া, নির্বাচনী বিজ্ঞাপন হলে সেটির উৎস ও বিজ্ঞাপণ প্রদানকারীর পরিচয় প্রদর্শন করা, দ্রুত অপতথ্য অপসারণ, নির্বাচনকালীন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া ইত্যাদি নানা বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন থেকেই গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার–প্রচারণা শুরু করে দিতে হবে। ইতিমধ্যে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে নির্বাচন কমিশন এআই ঝুঁকি মোকাবিলার সহায়তা চেয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে সহায়তা নেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, সেটি যেন আবার শিয়ালের কাছে মুরগি রাখার মতো না হয়ে যায়। নিয়ন্ত্রণ, সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যেন দেশীয় প্রযুক্তিবিদদের হাতেই থাকে। বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

ই–মেইল: [email protected]

সূত্র, প্রথম আলো