মানুষ কখনো স্থায়ী শান্তিতে বিশ্বাস করেনি, আজও করে না। যুদ্ধের ন্যায্যতা প্রমাণে কত হাস্যকর যুক্তি যে আমরা দিতে পারি!
মানুষ কখনো স্থায়ী শান্তিতে বিশ্বাস করেনি, আজও করে না। যুদ্ধের ন্যায্যতা প্রমাণে কত হাস্যকর যুক্তি যে আমরা দিতে পারি!ছবি : প্রতীকী
মানবসভ্যতার ইতিহাস মূলত যুদ্ধের ইতিহাস। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ সংঘাতের মধ্য দিয়েই তার পথ তৈরি করেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ১২৭৪ সালে সংঘটিত কাদেশ যুদ্ধকে প্রাচীনতম নথিভুক্ত যুদ্ধ হিসেবে ধরা হয়, যা আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের ঘটনা। তবে এর আগে কতশত, সহস্র যুদ্ধ হয়েছে, তার কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। শুধু রক্তাক্ত নিঃশব্দতা।
জাতি, সভ্যতা ও ভূখণ্ডের উত্থান–পতনের মূল চালিকা শক্তিই ছিল যুদ্ধ। ১২০০ সালের দিকে কেউ চিনত না মঙ্গলদের। কিন্তু ১২১৮ সালে চেঙ্গিস খানের উত্থানের পর মধ্য এশিয়ার খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়। এরপর ১৪০০ সালের মধ্যে গড়ে ওঠে ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্য। মঙ্গলদের হাতে কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারান।
বাগদাদের পতনের পর ফোরাত নদীর পানি রক্তে লাল হয়েছিল দিনের পর দিন।
এরপর এসেছে গ্রিক, রোমান, পারস্য ও মোঘলদের যুদ্ধগাথা। এসেছে দুটি মহাযুদ্ধ, যা গোটা পৃথিবীর মানচিত্র ও মানবতার বোধকে পাল্টে দিয়েছে। তবু মানুষ থেমে থাকেনি। যুদ্ধ যেন মানবজাতির বিবর্তনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
মানুষ কখনো স্থায়ী শান্তিতে বিশ্বাস করেনি, আজও করে না। যুদ্ধের ন্যায্যতা প্রমাণে কত হাস্যকর যুক্তি যে আমরা দিতে পারি! লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু আমাদের বিবেককে নড়াতে পারে না। গাজা উপত্যকায় হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনির মৃত্যুও আমাদের দৃষ্টিকে ঝাপসা করতে পারে না। কারণ, পাশ্চাত্য শক্তিগুলো নিরন্তর ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধ করার জন্য আজ আর প্রকৃত কোনো কারণের প্রয়োজন হয় না, কেবল একটি অজুহাতই যথেষ্ট। ‘তোমার বাবা পানি ঘোলা করেছিলেন’ ধরনের যুক্তিই এখন যথেষ্ট। ইসরায়েল ১৯৭৩ সাল থেকে প্রায় ১০০টি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বসে আছে। সবাই জানে, কিন্তু কেউ স্বীকার করে না। অন্যদিকে ইরান যেন একটিও বোমা তৈরি না করে। এ দ্বিচারিতা আমাদের সভ্যতার নির্মম বাস্তবতা।
মানবসভ্যতা আজ ভয়াবহ এক বাস্তবতার মুখোমুখি। যেকোনো মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে আণবিক যুদ্ধ। আর তা যদি হয়, আমাদের উত্তরসূরিরা যে পাথর আর তির–ধনুক যুদ্ধ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবার্ট ওপেনহাইমার নেভাদায় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের পর শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একটি শ্লোকের অনুছায়ায় বলেছিলেন, ‘নাউ আই এম বিমাক ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অব ওয়ার্ল্ডস’। সে পথেই আজ মানুষ ধেয়ে যাচ্ছে।
জনাথন সুইফট তাঁর ব্যঙ্গাত্মক রচনায় লিলিপুট ও ব্লেফুস্কু নামের দুটি জাতির কথা বলেন,যারা শত বছর যুদ্ধ করেছে ডিম ভাঙার পদ্ধতি নিয়ে—এক পক্ষ ডিমের মোটা দিক দিয়ে, অপর পক্ষ সরু দিক দিয়ে ভাঙার পক্ষে। বাস্তবেও আমাদের যুদ্ধের কারণ প্রায় তেমনই তুচ্ছ ও হাস্যকর।
আজকের যুদ্ধ আর আগেকার মতো সম্মুখ সমর নয়। গ্লাডিয়েটরদের হাতাহাতির দিন পেরিয়ে গেছে। এখন দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়, যাদের ভৌগোলিক দূরত্ব হাজার মাইল। এক দেশের যুদ্ধবিমান আরেক দেশের নিউক্লিয়ার স্থাপনায় বোমা ফেলছে এবং প্রতিপক্ষ তাদের রাজধানীতে মিসাইল ছুড়ে দিচ্ছে। যুদ্ধ এখন বোতামে চাপ, রাডার ফাঁকি, স্যাটেলাইট আর ড্রোনের খেলা।
নৌযুদ্ধও বদলে গেছে। এখন আর ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’-এর মতো তরবারি হাতে জাহাজে ঝাঁপিয়ে পড়া নয়। এখন আধুনিক যুদ্ধজাহাজ বা সাবমেরিন থেকে দূরবর্তী টার্গেট ধ্বংস করা হয় বোতাম টিপেই। পারমাণবিক সাবমেরিন মাসের পর মাস পানির নিচে থেকে যেকোনো শহর ধ্বংস করে দিতে পারে।
আকাশযুদ্ধেও পরিবর্তন এসেছে। ‘টপ গান’–এর মতো যুদ্ধবিমান কামান দিয়ে শত্রু ভূপাতিত করার যুগ পেরিয়ে গেছে। এখন ২০০ কিলোমিটার দূর থেকে শত্রুর বিমান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। কিছু বিমান রাডারেও ধরা পড়ে না। এটি যেন মহাভারতের মতো—মেঘনাদ আড়াল থেকে আক্রমণ করছে, অর্জুন দূর থেকে শত্রু সেনাকে বাণে বিদ্ধ করছে।
ড্রোন প্রযুক্তি যুদ্ধকে করেছে আরও ভয়াবহ। ইউক্রেন যুদ্ধ, ইরানে পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যা কিংবা হামাসের নেতাদের সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে বিস্ফোরণ—সবই ড্রোন ও রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তির উদাহরণ। যুদ্ধ এখন মানুষবিহীন, মনুষ্যত্বহীন, কিন্তু নিখুঁত।
আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিসে হবে জানি না, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে পাথর আর তির–ধনুক দিয়ে।’ অনেকেই বলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়তো ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, শুধু আমাদের তা বুঝে ওঠা বাকি।
চীনের অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত উত্থান আজ বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে। ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, বিমানবাহী রণতরি, নতুন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি—সবই নতুন যুদ্ধ বাস্তবতার দিকচিহ্ন। চীনের পরোক্ষ সহায়তায় পাকিস্তান ভারতের গর্ব ‘রাফাল’ বিমান ভূপাতিত করেছে। পশ্চিমা প্রাধান্যের যুগ কি তবে শেষ? পশ্চিমারা হয়তো তা মানতে চায় না, তাই তারা শেষ পর্যন্ত মরিয়া প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদেরই বানানো নিয়ম আজ তাদেরই অনৈতিকতা প্রমাণ করছে।
বিশ্ব এখন এমন এক যুদ্ধ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, যেখানে যুদ্ধ মানে শুধু গোলাবারুদের সংঘর্ষ নয়, এটি প্রযুক্তির, নৈতিকতার, রাজনৈতিক দ্বিচারিতার ও আন্তর্জাতিক হিপোক্রেসির ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি।
মানবসভ্যতা আজ ভয়াবহ এক বাস্তবতার মুখোমুখি। যেকোনো মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে আণবিক যুদ্ধ। আর তা যদি হয়, আমাদের উত্তরসূরিরা যে পাথর আর তির–ধনুক যুদ্ধ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবার্ট ওপেনহাইমার নেভাদায় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের পর শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একটি শ্লোকের অনুছায়ায় বলেছিলেন, ‘নাউ আই এম বিমাক ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অব ওয়ার্ল্ডস’। সে পথেই আজ মানুষ ধেয়ে যাচ্ছে।
তুষার কান্তি চাকমা সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।