ভূরাজনীতির মঞ্চে ছায়া আর নীরবতা দিন দিন প্রধান বিষয় হয়ে উঠছে। এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে চলমান সশস্ত্র লড়াই প্রক্সি যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিকে সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে সামনে নিয়ে আসছে। ১৫ জুলাই ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রায়ান বারলেটিক নতুন এক বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন। তাঁর অভিযোগ হলো ওয়াশিংটন সম্ভবত নীরবে বেলুচ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা দিচ্ছে। নির্দিষ্ট করে চীনা প্রকৌশলী ও পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করতে এ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
যদিও তাঁর এই দাবির সত্যতা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক রয়েছে। তার পরও তথ্য–প্রমাণ থেকে এই বাস্তবতা দৃশ্যমান হচ্ছে যে বেলুচ সশস্ত্র সংগ্রাম এখন আর নিখাদ অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম নেই। এটি এখন দুই পরাশক্তির কৌশলগত টানাপোড়েনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে বেলুচিস্তানে অন্তত এক ডজন সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুজন পদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছেন।
বেলুচিস্তান দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ভিন্নমত ও বিদ্রোহের একটি কেন্দ্র। এখন এটি বৃহত্তর বৈশ্বিক সংঘাতের একটি বিভেদক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বেলুচিস্তান ইরান ও আফগানিস্তানের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোয়াদার বন্দর এখানে রয়েছে।, বেলুচিস্তান চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি ভারকেন্দ্র।
গোয়াদার বন্দরের সঙ্গে সংযুক্তির কারণে বেইজিংয়ের পক্ষে মালাক্কা প্রণালি এড়িয়ে বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা ওয়াশিংটন ও এর মিত্রদের কৌশলগত হিসাবনিকাশকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, চীনা স্বার্থ লক্ষ্য করে ঘটানো প্রতিটি হামলা শুধু অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের প্রতিফলন নয়, এটা বৈশ্বিক উদ্বেগেরও প্রতিধ্বনি।
যদিও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যোগসূত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরিস্থিতিগত বাস্তবতা বলছে, এটাকে অস্বীকার করা কঠিন।
ইউএস পিস ইনস্টিটিউট, ফরেন পলিসি ও রেডিও ফ্রি ইউরোপের মতো সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে তড়িঘড়ি করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এখন বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) ও তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-সহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। এ ধরনের মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের বিস্তার (এমনকি তা অনিচ্ছাকৃত হোক না কেন) এ অঞ্চলে (বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে) সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত বাস্তবতা হিসেবে কাজ করেছে।
ভারতের ভূমিকা এখানকার সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলেছে। চীন-পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে শঙ্কিত নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের অভিযোগ হলো, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থ জোগাচ্ছে ভারত। তালেবান এখন ক্ষমতায় এবং আঞ্চলিক জোটগুলোর পুনর্গঠন চলছে—এই প্রেক্ষাপটে কে বা কারা বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মিকে সহায়তা করে চলেছে, সেই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে।
বালুচ বিদ্রোহ, জিহাদি আন্দোলন নয়। সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ, গণতান্ত্রিক অধিকার, জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের মতো পরিভাষা ব্যবহার করার কারণে বেলুচ বিদ্রোহ খুব স্বাচ্ছন্দ্যে পশ্চিমা উদারপন্থী মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়। এ আদর্শগত সাযুজ্যের কারণে বালুচদের প্রবাসী সংগঠনগুলো ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসে প্রভাব তৈরির সুযোগ পাচ্ছে। তারা প্রকাশ্যেই মার্কিন কংগ্রেসের হস্তক্ষেপ এবং পাকিস্তানের বিদ্রোহ দমন নীতির উপর বৈশ্বিক নজরদারির দাবি তুলছেন।
যদিও এ ধরনের প্রকাশ্য তদবির গোপন পৃষ্ঠপোষকতার সমান নয়; কিন্তু এখান থেকে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যে বেলুচ লিবারেশন আর্মি সম্প্রতি চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করেছে, তাদের নিয়েই পশ্চিমা রাজধানীগুলিতে আলোচনা চলছে, বিবৃতি আসছে।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র বেলুচ লিবারেশন আর্মিকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করলেও সেটি অনেকটাই আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ। সংগঠনটির আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গঠন, অর্থ সংগ্রহ ও প্রচারণা—এ সব কর্মকাণ্ড রোধে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বিমুখী নীতি নতুন নয়। লাতিন আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য—প্রকাশ্যে কূটনৈতিক অবস্থান নিলেও, গোপনে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্থিরতা সৃষ্টির কাজে সহায়তা দিয়েছে, এই ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের।
উদাহরণ হিসেবে সিরিয়ার কথা বলা যায়। সেখানে জিহাদি সহিংসতার বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রকাশ্য নিন্দা জানালেও আসাদবিরোধী এই শক্তিগুলোকে গোপনে সমর্থন জানিয়ে গেছে। বিদ্রোহে বিপর্যস্ত বেলুচিস্তানে কৌশলগত যুক্তি খুব একটি ভিন্ন নয়। বেলুচ বিদ্রোহীরা চীনের অবকাঠামোগত বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সেবা করে।
ইরানের ক্ষেত্রেও সেই একই যুক্তি খাটে। ইরানে জাতিগত বালুচ অধ্যুষিত অঞ্চল সিস্তান ও বেলুচিস্তান বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। তেহরান বারবার করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে তারা ‘জায়েশ আল-আদল’ নামের সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠীকে মদদ দিচ্ছে। এই গোষ্ঠী ইরানের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর হামলার জন্য দায়ী। এ অভিযোগ সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, সীমান্ত অঞ্চলে স্থায়ী অস্থিরতা ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব খর্ব করতে চাওয়া শক্তিগুলোর পক্ষেই যায়।
ভারতের ভূমিকা এখানকার সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলেছে। চীন-পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে শঙ্কিত নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের অভিযোগ হলো, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থ জোগাচ্ছে ভারত। তালেবান এখন ক্ষমতায় এবং আঞ্চলিক জোটগুলোর পুনর্গঠন চলছে—এই প্রেক্ষাপটে কে বা কারা বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মিকে সহায়তা করে চলেছে, সেই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে।
এসব বাস্তবতায় পাকিস্তানের নীরব প্রতিক্রিয়া অনেক কথায় বলে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও পাকিস্তানে কর্মরত চীনা নাগরিকদের ওপর একের পর এক হামলা হওয়া সত্ত্বেও ইসলামাবাদ কখনোই এই বিদ্রোহের সম্ভাব্য অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উচ্চারণ করেনি। এর বদলে পাকিস্তান মূলত ভারতের দিকে অভিযোগের তির ছোড়ে কিংবা ‘শত্রু দেশের গোয়েন্দা সংস্থা’র কাজ বলে বিবৃতি দেয়। এই কূটনৈতিক সংযমের পেছনে যুক্তি আছে।
পাকিস্তানের অর্থনীতি খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দেশটিকে বারবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে এবং পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতে জড়ানো কঠিন।
রহিম নাসার পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত