জুলাই সনদ স্বাক্ষর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক যুগান্তকারী অধ্যায়। এটি কেবল একটি দলিল নয়, বরং জাতির সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে অর্জিত এই সমঝোতা এক নতুন যুগের সূচনা করেছে।

এই ঐতিহাসিক সমঝোতা বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমত, অংশগ্রহণকারী দলগুলোর বিভিন্ন প্রস্তাবে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) রয়েছে। দ্বিতীয়ত, কয়েকটি দল এখনো স্বাক্ষর করেনি। তৃতীয়ত, সনদের আইনগত ভিত্তি প্রদান বিষয়ে দ্বিধাবিভক্তি আছে। চতুর্থত, গণভোটের রূপরেখা নিয়ে আছে মতান্তর। কী প্রশ্ন করা হবে, কতটি প্রশ্ন থাকবে, এর ব্যাখ্যা কী হবে—এসব নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

চারটি দল সব বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। এই দলগুলো হলো ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণসংহতি আন্দোলন ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক—১৬টি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বাসদ। বিএনপি ১৫টি প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। এর মধ্যে ৯টি প্রস্তাবে এনডিএম, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী ঐক্যজোটও একই অবস্থান নিয়েছে।

এই আপত্তিগুলো শুধু সংখ্যার বিষয় নয়, বরং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন। একটি জাতির সাংবিধানিক দর্শন নিয়ে চলমান সংলাপের প্রকাশ।

প্রস্তাব ও জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা

উত্থাপিত বিভিন্ন বিকল্প প্রস্তাব বিষয়ে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রস্তাবগুলোর সারবত্তা অনুধাবনে সহায়ক। প্রস্তাব করা হয়েছে যে অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে সনদটি কার্যকর করতে পারে। কিন্তু ইতিহাস দেখিয়েছে, এ ধরনের পথ স্থিতিশীলতা বা বৈধতা নিশ্চিত না–ও করতে পারে। জনগণের সরাসরি সম্মতি ছাড়া যখনই ওপর থেকে পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে, তখনই তা বিভাজন সৃষ্টি করেছে এবং আস্থার সংকট ডেকে এনেছে।

আইয়ুব খান থেকে পারভেজ মোশাররফ পর্যন্ত পাকিস্তানে সামরিক শাসকেরা বারবার আদেশ জারি করে গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন, যার প্রভাব আজও বর্তমান। ২০১২ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করলে ব্যাপক জনবিক্ষোভের জন্ম দেয় এবং দেশটি এখনো নতুন জান্তার শাসনব্যবস্থায় থিতু হয়ে আছে। একইভাবে গণপরিষদ (সংবিধান সভা) আহ্বান যদিও আকর্ষণীয় মনে হয়, তবু তা ঝুঁকিপূর্ণ। ইতিহাসে অনেক নজির আছে। যেমন ফরাসি বিপ্লবের সময় গণপরিষদ শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসের যুগে পরিণত হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতাগুলো প্রমাণ করে, বৈধতা চাপিয়ে দেওয়া যায় না; জনগণের সম্মতির মাধ্যমেই অর্জিত হয়।

জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং যেকোনো গণতন্ত্রে দুটি ক্ষমতার, তথা ‘গঠিত ক্ষমতা’ ও ‘গাঠনিক ক্ষমতা’র মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। গঠিত ক্ষমতা (কনস্টিটিউটেড পাওয়ার) বলতে বোঝায় সেই কর্তৃত্ব, যা একটি বিদ্যমান সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে প্রয়োগ করা হয়। গাঠনিক ক্ষমতা (কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার) বলতে বোঝায় সেই কর্তৃত্ব, যা সংবিধান তৈরি বা পুনর্গঠন করার অধিকার প্রদান করে। গাঠনিক ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত।

কোনো সরকার, কমিশন বা রাজনৈতিক দল জনগণের পক্ষে এই ক্ষমতার দাবি করতে পারে না। জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা একটি অখণ্ড ও অবিভাজ্য সার্বভৌম ক্ষমতা। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এই মৌলিক সত্যটিকে আবারও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অর্থাৎ বৈধতার উৎস জনগণ, রাষ্ট্র নয়।

গণভোটের রূপরেখা

গণভোট আয়োজনের ব্যাপারে সমঝোতা রয়েছে। তবে গণভোটে জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একাধিক জটিল প্রশ্ন জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। গণভোট নিয়ে অনেক ঝুঁকির অভিজ্ঞতাও আছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণভোটে মৌলিক প্রশ্ন করা যেতে পারে—জনগণ কি পরবর্তী সংসদকে গাঠনিক ক্ষমতা বা সংবিধান পুনর্গঠনের ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে? এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘জুলাই সনদ’ একটি আলোচনাভিত্তিক দলিল থেকে জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে বৈধ সামাজিক চুক্তিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে।

এই সোজাসাপটা কিন্তু গভীর প্রশ্নটি একত্রে একাধিক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। প্রথমত, সংসদকে ‘মৌলিক কাঠামো’ (বেসিক স্ট্রাকচার) তত্ত্বের আইনি জটিলতা অতিক্রমের সাংবিধানিক ক্ষমতা দেবে।

দ্বিতীয়ত, বিতর্কিত সব ইস্যু সমাধানের একটি সুষ্ঠু পদ্ধতি তৈরি করবে। সামনের নির্বাচন একটি সাংবিধানিক দর্শন নির্বাচনের গণভোটে পরিণত হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের সাংবিধানিক দর্শন স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করবে।

বাস্তব অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে একাধিক প্রশ্ন নিয়ে গণভোট করা জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এ ক্ষমতা প্রয়োগের সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে স্পষ্ট ও মৌলিক প্রশ্নের মাধ্যমে গণভোট। এটি গণতান্ত্রিক, বাস্তবসম্মত এবং সর্বোপরি জনগণের প্রতি পূর্ণ আস্থার জীবন্ত প্রতিফলন।

জনগণের অংশগ্রহণ শুধু একটি সরকার নির্বাচিত করবে না; গণতন্ত্রকে আরও অর্থবহ করে তুলবে। তৃতীয়ত, এই পদ্ধতি জুলাই সনদের সর্বসম্মত প্রস্তাবের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে, পাশাপাশি ভিন্নমতের বিষয়গুলো সমাধানের জন্য একটি গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে। এই অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি সব অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা সতর্ক করে দেয় যে একাধিক প্রশ্ন নিয়ে গণভোট বিপজ্জনক হতে পারে। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট গণভোট যুক্তরাজ্যকে সংসদীয় অচলাবস্থায়, মন্ত্রিসভার পতনে এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় পর্যবসিত করেছিল। ২০১৭ সালে স্পেনের কাতালান অঞ্চলের একতরফাভাবে আয়োজিত গণভোট সাংবিধানিক সংকট, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল।

২০১০ সালে কেনিয়ায় নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে একাধিক জটিল প্রশ্ন উপস্থাপনের ফলে জাতিগত বিভাজন তীব্রতর হয়েছিল এবং রাজনৈতিক সংঘাতের ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছিল। ২০২২ সালে চিলির সংবিধান পুনর্লিখন নিয়ে ১২টি পৃথক অনুচ্ছেদ–সম্পর্কিত জটিল প্রশ্নাবলি ভোটারদের মধ্যে এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল যে ৭৮ শতাংশ ভোটার সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তা দেশটিকে সাংবিধানিক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

২০১৬ সালে থাইল্যান্ডে সেনা–সমর্থিত সংবিধান নিয়ে গণভোটে দুটি প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়েছিল। একটি সংবিধান এবং অন্যটি সংসদীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ–সম্পর্কিত। বিরোধী দলগুলোকে গণভোট বর্জন করতে প্ররোচিত করেছিল এবং গণতান্ত্রিক বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় সংবিধান সংশোধনী নিয়ে একাধিক প্রশ্নের গণভোট প্রস্তাব নিয়ে এমন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল যে নির্বাচনী ব্যবস্থা, রাজ্যে ক্ষমতা বণ্টন এবং সরকারের কাঠামো সংস্কার–সম্পর্কিত জটিল বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্যের অভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া স্থগিত করতে হয়েছিল।

সাধারণ মানুষকে জটিল সাংবিধানিক বিষয়গুলো নিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারে। বিভিন্ন প্রশ্নের বিভিন্ন ফলাফল থেকে সৃষ্ট আইনি জটিলতা দেশের সাংবিধানিক কাঠামোয় গভীর অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে পারে।

জনগণই ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস

বাস্তব অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে একাধিক প্রশ্ন নিয়ে গণভোট করা জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এ ক্ষমতা প্রয়োগের সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে স্পষ্ট ও মৌলিক প্রশ্নের মাধ্যমে গণভোট। এটি গণতান্ত্রিক, বাস্তবসম্মত এবং সর্বোপরি জনগণের প্রতি পূর্ণ আস্থার জীবন্ত প্রতিফলন।

‘জনগণই সকল ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস’—এ পথে হাঁটাই বাংলাদেশকে স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের নিশ্চয়তা দিতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত গণভোটে হবে না কোনো দলের জয়-পরাজয়, বরং গোটা জাতির সাংবিধানিক জয় হবে। এ সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নততর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত রচনা করবে।

সূত্র, প্রথম আলো