পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো পরিস্থিতিকে যেকোনো উপায়ে নির্বাচনমুখী করতে আগ্রহী। এ রকম অবস্থায় গণ-অভ্যুত্থানের কর্মীরা কী করবেন, তা নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ
বাংলাদেশের গ্রাম-শহরজুড়ে গত আট মাস রাজনৈতিক মনোযোগের প্রধান বিষয় হয়েছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির সংগঠকেরা। ‘৩৬ জুলাই’ একটা অধ্যায়ের সমাপ্তির পর মানুষ দেখতে চেয়েছিল, পরের অধ্যায়ে এই তরুণেরা কী করেন। সেই দ্বিতীয় অধ্যায়ের চূড়ান্ত মুহূর্তগুলো পার হচ্ছে বাংলাদেশ।
প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক দল গঠন করে অভ্যুত্থানকর্মী তরুণেরা ব্যর্থ হতে চলেছেন কি না? রাষ্ট্রের মৌলিক কোনো সংস্কার ছাড়াই যদি নির্বাচনী তোড়জোড় শুরু হয়, তাহলে অভ্যুত্থানের কর্মীদের জন্য করণীয় কী? কীভাবে তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেন? কেবল অভ্যুত্থানকর্মী ওই তরুণদের জন্য নয়, জাতীয় স্বার্থেও এসব বিষয়ে পথ খোঁজার সময় এখন।
এনসিপির সামনে চ্যালেঞ্জ
প্রায় দুই মাস হলো ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র। এর আগে এই দলের সংগঠকদের বড় অংশ কাজ করছিলেন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে। গত সেপ্টেম্বরে ওই কমিটি ঘোষিত হয়। জাতীয় নাগরিক কমিটির আদি কাফেলা ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, যা গড়ে ওঠে কোটা আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের সমন্বয়ের লক্ষ্যে ২০২৪–এর লাল জুলাইয়ে।
পুরো হিসাব মিলিয়ে বলা যায়, আজকের জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির সংগঠকদের রাজনৈতিক পথচলার ৮-৯ মাস হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে তাঁরা সাংগঠনিক তিনটি কাঠামো পাল্টেছেন। এ রকম পরিবর্তনের আরও কিছু অধ্যায় বাকি আছে বলেও মনে হয়। এনসিপির অনেক কর্মী মনে করেন, তাঁদের নেতৃত্ব পর্যায়ে আরও পরিবর্তন ঘটবে সামনে। আরও কিছু ‘তারকামুখ’ যুক্ত হবেন তাতে। তবে সাংগঠনিক এসব পরিবর্তন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে জনগণের কৌতূহল এবং ভাষ্যকারদের মনোযোগ মূলত দলটির রাজনৈতিক পদক্ষেপের দিকে।
দল হিসেবে আবির্ভাবের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর এখনো ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করতে পারেনি বা করেনি এনসিপি, কেবল ৬৯৭ শব্দের একটা ‘ঘোষণা’ ছাড়া। যেখানে বাংলাদেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এনসিপি ২৮ ফেব্রুয়ারিতে সেকেন্ড রিপাবলিক-এর যেসব লক্ষ্য ঘোষণা করেছে, অন্যান্য বড় দল, যারা নিজেরাও অভ্যুত্থানে শরিক ছিল, তাদের দিক থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন মিলছে না। এ রকম অবস্থায় এনসিপি এককভাবে তাদের লক্ষ্য ও ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানকালে চাওয়া কীভাবে অর্জন করতে সক্ষম? তাদের বর্তমান সাংগঠনিক ও সামাজিক কৌশলে আদৌ সেটা বাস্তবসম্মত?
রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে বাংলাদেশে এখন যে ধরনের গভীর টানাপোড়েন চলছে, তাতে এনসিপির ছাত্র-তরুণেরা দেখছেন, সংস্কার প্রশ্নে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোকে তাঁদের মিত্র হিসেবে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আবার সমাজ-রাজনীতি-প্রশাসনের প্রচলিত কাঠামো বদলের জন্য চাপ তৈরির জোরও কমছে তাঁদের। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো পরিস্থিতিকে যেকোনো উপায়ে নির্বাচনমুখী করে ফেলতে আগ্রহী। এ রকম অবস্থায় অভ্যুত্থানকারী কর্মী দলের হতবিহ্বলতা তাদের নেতাদের জটিল এক পরিস্থিতিতে ফেলেছে। দেশজুড়ে তাই কৌতূহল, কী করবে এখন এই দল।
এনসিপির সংকট যে কারণে ‘জাতীয় সংকট’ও বটে
এনসিপির সংগঠকেরা এখন যে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জে পড়েছেন, এটা তাঁদের একার অভ্যন্তরীণ সমস্যা হলে এ নিয়ে অন্যদের ভাবনার প্রয়োজন ছিল না। তাঁদের এই কোণঠাসা অবস্থার একটা জাতীয় চরিত্র আছে। জাতীয় তাৎপর্যও আছে। চলমান রাজনৈতিক মেরুকরণে সঠিক কৌশল গ্রহণে এনসিপির ব্যর্থতা একই সঙ্গে জাতীয় ব্যর্থতাও হয়ে দাঁড়াতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের পর সবচেয়ে মেধাবী তরুণেরাও একবার এ রকম অপচয়ের শিকার হন।
সংস্কার প্রশ্নে বর্তমান টানাপোড়েনে যদি পুরোনো-প্রথাগত-সংস্কারবিমুখ মনোভাব জয়ী হয় এবং তার মোকাবিলায় এনসিপি যদি অসফল হয়, তাহলে জাতির দুর্ভাগ্যের ইতিহাসে নতুন পালকই কেবল যুক্ত হবে; যেমনটি ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের পর জাসদের ব্যর্থতায় এবং ১৯৯০-এর পর ‘তিন জোটের রূপরেখা’ বাস্তবায়নে তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর সচেতন উদাসীনতায়।
■ ‘৩৬ জুলাই’ ক্ষমতার কাঠামোর যে প্রকৃত ভারসাম্য বদলাতে চেয়েছে, সেটা শিল্পপতিদের সহায়তায় শহুরে মানুষদের মনোরঞ্জনে সম্ভব নয়। ■ হাজার হাজার ছাত্র-তরুণের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনবিরোধী অবস্থান না নিয়েও কীভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ও স্বপ্নগুলো বাস্তব করে তোলা যায়।
তিন জোটের রূপরেখায় উল্লেখ না থাকলেও নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের একটা প্রত্যাশা ছিল, সে সময়কার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ‘দশ দফা’র বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী সরকারগুলো। তিন জোটের রূপরেখায় ‘মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইনকানুন বাতিলের’ কথা ছিল। সেগুলো কিছুই পরবর্তী সরকারগুলো করেনি। আজও সেই ব্যর্থতার মানসিক ভার বইতে হয় ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের, বিএনপি বা আওয়ামী লীগকে নয়। অথচ বাংলাদেশে আজকের চলমান ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর অপরিবর্তিত অবস্থার দায় নিশ্চিতভাবেই স্বাধীনতা–পরবর্তী সরকার এবং নব্বই–পরবর্তী সরকারগুলোর ওপর বর্তায়। বাংলাদেশ কি আরেকবার একই রকম ‘রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা’র নতুন ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে?
নিশ্চিতভাবে এ মুহূর্তে নির্বাচন জরুরি এবং এটাই সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা দরকার। কিন্তু ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ এবং মৌলিক ধাঁচের কিছু সংস্কারেও রাজি হতেই হবে। কিন্তু সে রকম না হলে ছাত্র আন্দোলনের তরুণেরা কী করবেন? দল গঠন করে ভোটে লিপ্ত হওয়ার ভেতর দিয়ে তাঁরা কিছু অর্জন করতে সক্ষম কি না আদৌ?
অনেক ছাত্র-তরুণকে দেখা যাচ্ছে রঙিন পোস্টার বানিয়ে ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারের প্রাথমিক মহড়া দিচ্ছেন! চূড়ান্ত রকমের সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও বিএনপি-জামায়াত ও পুরোনো দলগুলোর বাইরে ১০টি আসন যাবে কি? কেন মানুষ নতুনদের ভোট দেবে, যাদের তারা আদৌ নিজের উঠানে কোনো দিন দেখেওনি? বরং খুবই পুরোনো মডেলের এ রকম পন্থায় মানুষ লীগ-বিএনপি-জামায়াতের ছায়া দেখে কেবল। প্রশ্ন হলো, এর বিকল্প কিছু আছে কি না?
নতুন ‘রিপাবলিকের’ জন্য রাজনেতিক কাজের নতুন পদ্ধতি কী রকম হতে পারত, কী রকম হতে পারে, অভ্যুত্থানকর্মীদের সেসব নিয়ে ‘শিক্ষাশিবির’ করা দরকার ছিল। নতুন বাংলাদেশকে পুরোনো রীতি-সংস্কৃতিকে গড়তে গেলে মানুষ যে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, সেটা স্পষ্ট হয়েছে গত আট মাসে।
বহির্বিশ্বেও এ রকম অভিজ্ঞতা বিপুল। ভারতে গান্ধী পরিবারের নতুন প্রজন্ম যখন পুরোনো পরিবারতন্ত্রের আদলে রাজনীতি চালিয়ে নিতে গিয়েছিল, দলের আসন ২০০৯ সালের ২০৬ থেকে ২০১৯-এ ৫২–তে নেমে যায়; ২০২২ সালে রাহুল তখন ‘ভারতযাত্রা’য় নেমেছিলেন। এই লংমার্চে হেলিকপ্টার বা পাজেরোতে নয়, দলের হেভিওয়েটদের নিয়েও নয়, রাহুল অনেকটা অপ্রচলিত রুটে চার হাজার কিলোমিটার হাঁটেন পাড়া-মহল্লার মানুষদের সঙ্গে।
সেই যাত্রায় তিনি রাতে মোবাইল কনটেইনারে ঘুমাতেন আর দিনের বেলা হাঁটতেন। এভাবে লাখ লাখ এমন মানুষের সঙ্গে তিনি কথা বলতে সমর্থ হন, যাদের কাছে কুলীন রাজনীতিবিদেরা যাননি কখনো। কেবল এই ‘যাত্রা’য় রাহুল মৃতপ্রায় দলটিকে নতুন জীবন দেন; তাঁর নিজেরও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার রক্ষা পায় তাতে।
রাহুলের এই পদযাত্রা দেখে অনেকের মনে পড়তে পারে চে গুয়েভারার মোটরসাইকেল–যাত্রার কথা। ১৯৫২ সালে মেডিকেল ছাত্র চে নিজ দেশ আর্জেন্টিনা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরতে বেরিয়ে মানুষের সঙ্গে সংলাপ করতে করতেই বিশ্বখ্যাত বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হন। ৯ মাসে সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটারের সেই যাত্রায় খনিশ্রমিক থেকে কুষ্ঠরোগী—কারও জীবন বাদ যায়নি চের কৌতূহল থেকে। সেই যাত্রাতেই অতীতের চে পাল্টে এমন এক নতুন চের জন্ম হয়, যিনি এই মহাদেশজুড়ে মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারদের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিলেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের ‘পরিবর্তনবাদী’ তরুণেরা নিজেদের মতো করে পথে নামার বদলে রমনা ও মতিঝিল এলাকায় আটকে গেলেন কেন? তারকা হোটেল আর মিডিয়ার পরিসর ছেড়ে গ্রামগঞ্জের পথঘাটে যদি গত আট মাস তাঁরা মানুষের সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত হতেন, তাহলে ‘দ্বিতীয় রিপাবলিকের’ জন্য সমর্থন চেয়ে স্থিতিশীলতাপন্থী পুরোনো দলগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো না বলেই মনে হয়।
‘৩৬ জুলাই’ ক্ষমতার কাঠামোর যে প্রকৃত ভারসাম্য বদলাতে চেয়েছে, সেটা শিল্পপতিদের সহায়তায় শহুরে মানুষদের মনোরঞ্জনে সম্ভব নয়। সেটা হতে পারে অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে রাজধানীর বাইরে টেনে নিয়ে; সেটা হতো কৃষকপল্লি, লেবার লাইন, দলিত কলোনি আর আদিবাসীদের ঝুপড়িতে বসে তাদের না-বলা কথাগুলোকে আত্মস্থ করে। এভাবেই কেবল ঘটতে পারত শহুরে স্বপ্নবাজ অভ্যুত্থানকর্মীদের আত্ম-আবিষ্কারের অধ্যায়। যেখানে যেখানে গত এক শতাব্দীতে সমাজ বদলেছে, সেখানকার চে ও গ্রানাদোরা ঠিক এ পথেই এগিয়েছেন। রাহুলও এ পথেই একালের ‘গান্ধী’ হতে চেষ্টা করছেন। আবদুল হামিদ খান এভাবেই ‘ভাসানচরের মাওলানা’ হয়ে যান।
অভ্যুত্থানকর্মীরা এখন কী করবেন
এনসিপি বা তার আগের জাতীয় নাগরিক কমিটি বা তারও আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের একটা বড় অংশ অভ্যুত্থানের পরের অধ্যায়ের নিজেদের রাজনৈতিক করণীয় সম্পর্কে দূরদর্শী অবস্থান নিতে পেরেছিল কি না, সে প্রশ্ন করছেন এখন ছাত্র-তরুণদের অনেকে। বিশেষ করে সংস্কারের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য যখন প্রয়োজন ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কাঠামোকে ক্রমে প্রান্তের দিকে ছড়ানো, তখন দ্রুতলয়ে একটা নাগরিক কমিটি করে ফেলে সংস্কারের সমাবেশশক্তিকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে বলেই কারও কারও অভিমত।
‘৩৬ জুলাই’–এর আগের হাজার হাজার মিছিলের মুখকে এখন আর কোথাও দেখা যায় না। ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, উত্তরা-বসুন্ধরা-বনশ্রীর সেই শত শত নারীমুখ এখন আর কোথাও নেই। কেন তাঁদের ধরে রাখা গেল না, সেই আত্মজিজ্ঞাসা এ সময় জরুরি বৈকি, যদি তাঁদের আবার সমাবেশগুলোতে ফিরিয়ে আনতে হয়।
জুলাই অভ্যুত্থান মোটাদাগে শহুরে চৌহদ্দির ঘটনা ছিল, তাই ছাত্রনেতারা অভ্যুত্থানের পর দল বেঁধে গ্রামগঞ্জে ঘুরে সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠন করা একটা প্রয়োজনীয় কাজ ছিল। কিন্তু তার বদলে সংগঠকদের অনেকের অভিমুখ হয়ে পড়ে সচিবালয়। তত দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠকদের সঙ্গে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রশক্তিরও বিচ্ছিন্নতা ঘটে গেছে। ছাত্রনেতারা সচিবালয়মুখী হওয়ামাত্র স্বাভাবিকভাবে তাঁদের ওপর নিয়োগ ও বদলির তদবির বেড়ে যায় এবং তাঁদের মূল্যবান সময় ও মনোযোগের অনেকটা ওই সব কাজকারবারে চলে যায়। এতে মাঠে, বিশেষ করে জেলা-উপজেলায় সমাবেশশক্তি গড়ার কাজটি ব্যাহত হয়।
সমাবেশশক্তি কমে যাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল ছাত্রনেতাদের অপ্রযোজনীয়ভাবে ডানে-বামে মতাদর্শিক বিতর্কে লিপ্ত হওয়া। এই কাজে কিছু বুদ্ধিজীবীর ইন্ধন ও উৎসাহ ছিল। তাতে করে অভ্যুত্থান–পরবর্তী সামাজিক চিন্তা থেকে শ্রমিক-কৃষক-দলিত সমাজের জরুরি এজেন্ডা উধাও হয়ে যায়। আবার অভ্যুত্থানের সরকার অনেক চেষ্টা করেও তাদের প্রশাসনিক কর্মতৎপরতাকে জনপ্রত্যাশার কাছাকাছি আনতে না পারার দায়ও বর্তাচ্ছে ছাত্রনেতাদের ওপর। সরকারের ভেতর ছাত্রনেতারা থাকায় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক-মহাপরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের সম্পর্ককে বিবেচনায় নিয়ে জনগণের কাছে এই সরকার ও ছাত্র আন্দোলন সমার্থক হয়ে ধরা দেয়। এসবও এনসিপির এখনকার ইমেজে যুক্ত আছে। যে ইমেজ একটা বোঝা হয়ে এখন তরুণদের ঘাড়ে।
এ সুযোগেই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন প্রশ্নে সরব হয়ে ওঠে। তাদের দিক থেকেও এটা অস্বাভাবিক চাওয়া নয়। জনগণও ১৫ বছর ধরে একটা ভোট–উৎসবের জন্য অপেক্ষায় অধীর। কিন্তু স্রেফ একটা নির্বাচন রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা কমাতে পারলেও বাংলাদেশকে কেবল সেটা আবার ১৯৯১ সালে স্থাপন করবে। কিন্তু ২০২৪–এ দেড় হাজার মানুষ জীবন দিয়ে বাড়তি কিছু চেয়েছিল। সেই ‘কিছু’ তো নিশ্চয়ই একটা সুষ্ঠু নির্বাচন নয় কেবল।
এ অবস্থায় হাজার হাজার ছাত্র-তরুণের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনবিরোধী অবস্থান না নিয়েও কীভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ও স্বপ্নগুলো বাস্তব করে তোলা যায়। সেই কৌশল কী হবে? শহরে প্রেস কনফারেন্স ডেকে বারবার গণপরিষদ নির্বাচন আর আওয়ামী অপকৃতির কথা বলা? মনে হয়, এ রকম কৌশল এনসিপির সমাবেশশক্তিতে র্যাডিক্যাল কোনো বদল ঘটাতে আর সক্ষম নয়। বরং দলটির নেতৃত্ব পর্যায়ে মোটাদাগে শুদ্ধি অভিযান, আত্মজিজ্ঞাসা এবং পুনর্জাগরণ জরুরি। অভ্যুত্থানের এ রকম কারিগরদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো গত আট মাসের নির্মোহ রিপোর্ট কার্ড তৈরি। প্রয়োজনে ভুল নেতৃত্ব এড়িয়ে সরাসরি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে চলে যাওয়া, নতুন ‘৩৬ জুলাই’–এর জন্য ক্রমাগত নতুন মানুষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া।
পুরোনো অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব যে নতুন অভ্যুত্থানেও নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে, এমন না–ও হতে পারে। একাত্তরের নেতৃত্ব চুয়াত্তরে দেশ এগিয়ে নিতে পারছিলেন না। নব্বইয়ের নেতৃত্ব গণতন্ত্র দিতে পারেনি। ১৯৭২ ও ১৯৯২ থেকে আমরা শিখতে পারি। কুলীনদের সঙ্গে দর–কষাকষি করে বাংলাদেশে নতুন বন্দোবস্ত সম্ভব কি না, নাকি নিচুতলার মানুষদের আরও বৃহত্তর শক্তি সমাবেশ প্রয়োজন, সেটাই এখনকার ‘এক নম্বর প্রশ্ন’। বাংলাদেশ কেবল পুরোনো বন্দোবস্ত নয়, রাজনীতি করার পুরোনো রীতিরও বদল চাইছে।
●আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক