২০১৪ সালে আমি ‘দ্য সৌদি কিংডম’ নামে একটি বই লিখেছিলাম। সেখানে খুব খোলাখুলিভাবে সৌদি আরবের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা নিয়ে আমি নৈরাশ্য প্রকাশ করেছিলাম।
দশকের পর দশক ধরে দেশটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন বয়স্ক শাসকেরা, তাঁরা দেশের পরিবর্তনের জন্য খুব বেশি কিছু করেননি। আমার সোজাসাপটা সিদ্ধান্ত ছিল—সৌদি আরবের প্রয়োজন এমন একজন শক্তিশালী সংস্কারক নেতা, যিনি পুরো ব্যবস্থা, সমাজ ও অর্থনীতিকে নতুন করে সাজাতে পারবেন।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় বসেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ। তিনি দ্রুতই তাঁর ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে (এমবিএস) বড় পরিসরে সংস্কারের কর্মসূচি চালু করার ক্ষমতা দেন। গত আগস্টে এমবিএসের বয়স ৪০ পূর্ণ হয়েছে। ২০১৫ সালে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার পর এক দশক পূর্ণ হয়েছে। আজকের সৌদি আরব প্রায় অচেনা, মাত্র ১১ বছর আগে যে দেশ নিয়ে আমি লিখেছিলাম, তার সঙ্গে আজকের মিল খুবই সামান্য।
এমবিএসের সংস্কারে সৌদি আরব কতটা পথ অতিক্রম করতে পেরেছে, তা বোঝার জন্য একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি দিয়ে শুরু করাই ভালো। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আমি রিয়াদে ব্যাংকার হিসেবে কাজ করতাম। তখন ধর্মীয় নেতাদের চাপে স্কুলে মেয়েদের খেলাধুলা নিষিদ্ধ ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি আমার ৯ বছর বয়সী মেয়েকে সৌদি আরব থেকে সরিয়ে দুবাই নিয়ে যাই, যাতে সে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাও করতে পারে। এ বেদনাদায়ক স্মৃতি পুরোনো ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে তোলে।
এক বিরাট রূপান্তর
২০১৭ সালে এমবিএস বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য আবারও শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করেন। যে কারণে একসময় আমার মেয়েকে সৌদি আরব থেকে সরিয়ে দুবাই নিতে হয়েছিল, সেটি এখন সৌদি পরিবারগুলোর কাছে একেবারেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অংশ। জনপরিসর এখন নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। একসময় ধর্মীয় পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষকে থামাতে, ধাওয়া করতে কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারত। ২০১৬ সালে এমবিএস ধর্মীয় পুলিশের হাতে থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেন। এ সিদ্ধান্তের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাটের পরিবেশ পাল্টে যায়। প্রায় চার দশক পর ২০১৮ সালে সিনেমা হল চালু করে দেওয়া হয়। এখন সিনেমা দেখতে যাওয়া বা কনসার্টে যাওয়া কোনো সৌদি নাগরিকদের জন্য অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা বলছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে। জাপানে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে, ২৮ জুন ২০১৯
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা বলছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে। জাপানে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে, ২৮ জুন ২০১৯ফাইল ছবি: রয়টার্স\
সৌদি আরবে ভ্রমণ একসময় মূলত হজযাত্রা ও ব্যবসায়িক কাজে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে ই-ভিসার মাধ্যমে পর্যটনের দরজা খুলে দেওয়া হয়। পর্যটন খাত এখন কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের বড় উৎসে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালে সৌদি আরবে রেকর্ড তিন কোটি বিদেশি পর্যটক আসে। হোটেল, বিনোদন খাত ও ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোতে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণের বৃহত্তর কৌশল নিয়েছে সৌদি আরব।
আমার দৃষ্টিতে সৌদি সমাজে নারীর ভূমিকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। ২০১৯ সালে এমবিএস সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আনেন। নারীদের আর কাজ করতে, ভ্রমণ করতে বা সামাজিকভাবে কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি লাগবে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি। এসব সংস্কারের ফলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা একেবারেই পাল্টে যায়। ফলে আইন, বিমান পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, অর্থনীতি, বাণিজ্য, এমনকি সামরিক বাহিনীর মতো বহু খাতে প্রতিভাবান নারীদের উত্থান দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে সৌদি আরবে এখন নারীদের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার প্রায় ৩৫ শতাংশ। এক দশকেরও কম সময়ে এই হার দ্বিগুণ হয়েছে। এর স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে পারিবারিক আয় ও অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতায়। আজ আমি যখন বিমানবন্দর, ব্যাংক বা মন্ত্রণালয়ে হেঁটে যাই আর নারী-পুরুষকে নির্ভারভাবে একসঙ্গে কাজ করতে দেখি তখন মনে হয়, ২০১৪ সালে এটি কল্পনাও করা যেত না।
৪০ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমান আরও বহু দশক ক্ষমতায় থাকতে পারেন। তুরস্কের মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ এবং চীনের দেং শিয়াওপিং তাঁদের দেশকে রূপান্তর করেছিলেন। কারণ, তাঁরা সাহসের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এনেছিলেন এবং যথেষ্ট সময় ক্ষমতায় থেকে সেই পরিবর্তনকে স্থায়ী করেছিলেন। এমবিএস তাঁর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ শেষ করেছেন। এখন মূল চ্যালেঞ্জ দ্বিতীয় ধাপে।
নতুন অর্থনৈতিক লক্ষ্য
এই এক দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারও কম বৈপ্লবিক নয়। ২০১৬ সালে সৌদি সমাজকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্য নিয়ে এমবিএস ভিশন ২০৩০ চালু করেন। এটি শুরু হয় আর্থিক খাতে সংস্কার দিয়ে। দশকের পর দশক ধরে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পানির ওপর দেওয়া ভর্তুকির কারণে সরকারি অর্থের ব্যাপক অপচয় হয়েছে, তাতে বাজেটের ওপর চাপ পড়েছে। ২০১৬ সালে সরকার জ্বালানি ও বিভিন্ন পরিষেবার মূল্য পুনর্নির্ধারণ শুরু করে এবং অসহায় পরিবারদের সরাসরি সহায়তা দিতে নগদ অর্থ প্রদান কর্মসূচি চালু করে। এরপর ২০১৮ সালে সৌদি আরব মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করে। ২০২০ সালে ভ্যাটের হারকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করে। রাজনৈতিকভাবে কষ্টদায়ক হলেও অর্থনৈতিক বিচারে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল এ সিদ্ধান্ত।
এ বুদ্ধিদীপ্ত ও কঠিন সিদ্ধান্তগুলো সৌদি আরবের জন্য নতুন সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করেছে। সৌদি আরব এখন পণ্য পরিবহন, সরবরাহ ও বিতরণ খাত, খনি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রযুক্তি, সৃজনশীল শিল্প ও উন্নত প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদনে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে।
গত দশকে এমবিএস আরও কয়েকটি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প হাতে নেন। এর মধ্যে রয়েছে নেওম বা উচ্চ প্রযুক্তির নগর, দিরিয়াহ বা আল সৌদের ঐতিহাসিক রাজধানীর পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন; রেড সি প্রজেক্টস বা লোহিত সাগর ঘিরে একাধিক পর্যটনকেন্দ্র এবং কিদ্দিয়া, একটি বৃহৎ বিনোদন ও ক্রীড়া শহর।
এই প্রকল্পগুলো প্রায়ই অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু প্রকল্পগুলোর পেছনে যে কৌশলগত যুক্তি, সেটা কিন্তু স্পষ্ট—নতুন শিল্পক্ষেত্র তৈরি করা, পণ্য ও সেবার মানের সরবরাহ ও দক্ষতা বাড়ানো এবং বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।
সৌদি আরব সফরে গেলে রিয়াদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে স্বাগত জানান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ডিসেম্বর, ২০২৩
সৌদি আরব সফরে গেলে রিয়াদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে স্বাগত জানান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ডিসেম্বর, ২০২৩ছবি: এএফপি
এমবিএস ও সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ
এই এক দশকে কিছু ভুল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। আবার সৌদি আরবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ একেবারেই অমূলক নয়। তবে এক দশক পর হিসাব-নিকাশটা খুবই স্পষ্ট। ২০১৪ সালে আমি যে সৌদি আরব দেখেছিলাম, তার তুলনায় আজকের দেশটি অনেক নিরাপদ, গতিশীল, বাসযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক।
আমার কাছে এক দশকের এ পরিবর্তনটা গভীরভাবে ব্যক্তিগত। একসময় আমি আমার মেয়েকে রিয়াদ থেকে দুবাই সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ, মেয়েদের খেলাধুলার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। আজ বাবা-মায়ের চোখের সামনে মেয়েরা স্কুল শেষে পার্কে দৌড়ায়, যা আগে কল্পনাতেও ছিল না। আমি একসময় সতর্ক করেছিলাম, সস্তা জ্বালানি ও সর্বত্র ভর্তুকির ওপর দাঁড়ানো অর্থনীতি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়বে।
আজ শিল্পগুলো খরচ নিয়ন্ত্রণ করছে, কোম্পানিগুলো উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে, আর তরুণেরা নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। কয়েক বছরের মধ্যেই কিছু উদ্যোক্তা প্রযুক্তি খাতে ‘ইউনিকর্নে’ পরিণত হয়েছেন। আমি একসময় ভেবেছিলাম, সৌদি আরবের অর্থনীতি প্রাচীরের আড়ালে স্থবির হয়ে থাকবে। অথচ আজ ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন পর্যটকেরা, আর বিশ্বের সেরা ক্রীড়াবিদ, শিল্পী, প্রযুক্তিবিদেরা ঢুকছেন-বের হচ্ছেন সেসব শহরে, যেগুলোর আকাশসীমা মাসে মাসে বদলে যাচ্ছে।
৪০ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমান আরও বহু দশক ক্ষমতায় থাকতে পারেন। তুরস্কের মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ এবং চীনের দেং শিয়াওপিং তাঁদের দেশকে রূপান্তর করেছিলেন। কারণ, তাঁরা সাহসের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এনেছিলেন এবং যথেষ্ট সময় ক্ষমতায় থেকে সেই পরিবর্তনকে স্থায়ী করেছিলেন। এমবিএস তাঁর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ শেষ করেছেন। এখন মূল চ্যালেঞ্জ দ্বিতীয় ধাপে। সংস্কারগুলোকে এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যাতে ভবিষ্যতের কোনো সরকার সহজে তা উল্টে দিতে না পারে।
আলী শিহাবি সৌদি লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দ্য টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত