সেটি ধরলে যদি ডিসেম্বরে ইলেকশন করতে হয় তাহলে হাতে আছে আর সাড়ে ৫ মাস। আর যদি পরের বছর জুনে ইলেকশন করতে হয় তাহলে তফসিল ঘোষণার সময়টি বাদ দিয়ে হাতে থাকে আর সাড়ে ১০ মাস। এ সাড়ে ৫ মাস অথবা সাড়ে ১০ মাস- কোন সময়ে ইলেকশন হবে? এ প্রশ্ন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইসিটির আইন সংশোধন করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, অতঃপর আইসিটি কোনো সংস্থা বা ইংরেজিতে Entity এরও বিচার করতে পারবে। যেভাবেই ধরা হোক না কেন, আওয়ামী লীগ আর আগামী ইলেকশনে আসতে পারছে না। তাই এখন রাজনীতির মাঠে বিএনপিকেই বৃহত্তম দল হিসাবে গণনা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে গণনা করা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে। তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে গণনা করা হচ্ছে ছাত্রদের নবগঠিত দল এনসিপিকে। আগামী নির্বাচনে এ তিনটি দলই প্রধানত ফ্যাক্টর হবে। তবে সংসদীয় রাজনীতিতে জোট গঠনের নজীর ভুরি ভুরি। এ তিনটি দল ছাড়া অনেকগুলো ছোট দল আছে। এরাও আবার নিজেদের মধ্যে জোট গঠন করেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণনা করা হয় গণতন্ত্র মঞ্চকে। এ মঞ্চে রয়েছে আ.স.ম আব্দুর রবের জাসদ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য,সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এরা আছে বিএনপির সাথে। আর একটি জোট রয়েছে। তার নাম ১২ দলীয় জোট। এদের নেতা হলেন এহসানুল হক। এরাও বিএনপির সাথে আছে। আরও আছে লেবার পার্টি।
গণমাধ্যমের রিপোর্ট মোতাবেক দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতে ইসলামী দেশে ৩০০ টি আসনেই প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে। তবে নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে ততই রাজনৈতিক দল এবং জোট সমূহের পারমিউটেশন এবং কম্বিনেশন হবে। তখন ফাইনালী কে কার সাথে যায় সেটি বোঝা যাবে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য অতি সম্প্রতি যে ৩ দিনের আন্দোলন হলো সেখানে প্রথমে আন্দোলন বলতে গেলে একাই শুরু করেছিলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। এরপর এনসিপি দল হিসাবে এলো। কিন্তু আন্দোলন প্রচণ্ড গতি লাভ করলো যখন জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির এ আন্দোলনে যোগদান করে। জামায়াতের সাথে সাথে হেফাজতে ইসলামও আন্দোলনে শরিক হয়। কোনো কোনো গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে, খেলাফত মজলিশেরও কিছু সদস্য এ আন্দোলনে যোগদান করেন।
এসব দেখে জনগণের মধ্যে একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছিলো যে, আগামী নির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি এবং অন্যান্য ইসলামী দল জোট বাঁধবে। এটি শুধু ধারণা নয়। সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, এ রকম একটি জোট মানুষ চান। ভবিষ্যতই বলবে যে এ রকম জোট হবে কিনা।
কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ফেসবুুকের মাধ্যমে যেসব স্ট্যাটাস দিচ্ছেন সেগুলোকে লুফে নিচ্ছে প্রতিপক্ষ শিবির, বিশেষ করে সেক্যুলার ঘরানা। মাহফুজ আলম এসব কথা এখন কেনো বলছেন সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। ’৭১-এর প্রশ্নের কী মীমাংসা তিনি চান? বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে তার ভাষায় ‘পাকিস্তান পন্থা’ বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান পন্থা বলতে তিনি কী বলতে চান? বিষয়টি তার পরিস্কার করা উচিত। এদেশে প্রো-ইন্ডিয়ান এলিমেন্ট রয়েছে। আওয়ামী ঘরানার একটি অংশ তো পারলে বাংলাদেশকে ভারতের সাথে জুড়ে দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ঐ অংশ ছাড়া বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষই এখন প্রচন্ড ভারত বিরোধী।
॥ দুই ॥
কেউ যদি দেশের স্বার্থে বিশেষ কোনো মতাদর্শে বিশ্বাসী হন সেখানে খারাপের কিছুই দেখা যায় না। দু’-একটি উদাহরণ দিচ্ছি। সকলের সামনেই এখন বিরাট মাথাব্যাথা। চারদিকে বিশাল ভারত। তাদের জনসংখ্যা ১৪২ কোটি। অথচ বাংলাদেশের এ ৫৪ বছরে ভারত অন্ধভাবে আওয়ামী লীগকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে গেছে। কংগ্রেস বলুন আর বিজেপি বলুন, আওয়ামী লীগ প্রশ্নে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এক এবং অভিন্ন। ভারতের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ মনে করেন যে, আমেরিকার সাথে আমাদের শক্ত বন্ধুত্ব হওয়া উচিত। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে শত্রুর বন্ধু আমাদেরও বন্ধু। সে দৃষ্টিকোন থেকে অনেকে মনে করেন চীনের সাথে আমাদের শক্ত গাটছড়া বাঁধা উচিত। এ ধরনের চিন্তা যাদের মাথায় আছে তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু খারাপ নয়। তারা চান, যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশ ভারতের প্রভুত্ব থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন সত্তা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।
কিন্তু তাই বলে কেউ পাকিস্তানের সাথে ঐ ধরনের গাটছড়া বাঁধার পক্ষপাতি নন। মুসলিম প্রধান হিসাবে দুটি দেশের মধ্যে ধর্মীয় ও আদর্শিক সম্পর্ক থাকতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে যেসব ব্যবসা করলে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়, সে ধরনের ব্যবসা পাকিস্তানের সাথে করা যেতে পারে। এগুলোকে পাকিস্তানবাদ বলা যায় কী? একমাত্র আওয়ামী লীগের সময় বিএনপি এবং জামায়াতকে শেখ হাসিনা ব্যাঙ্গ করে বলতেন, ‘ওদের পেয়ারে পাকিস্তান।’ বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে বিএনপি বা জামায়াতের কেউ নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান যাননি বা সেখানে সেট্ল্ করেন নি। কিন্তু শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের মে মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন। আবার গত বছরের ৫ অগাস্ট তিনি দিল্লি ফিরে গেছেন। আসলে অনেকে বলেন যে আওয়ামী লীগ দিল্লির নাড়ী কাটা ধন। তাই ওরা যেখান থেকে আসেন সেখানেই ফিরে যান। শেখ হাসিনার পর প্রথম মাহফুজ আলমকেই দেখলাম যিনি ‘পাকিস্তানবাদ’ নামের একটি শব্দ রাজনীতিতে যুক্ত করলেন।
॥ তিন ॥
মাহফুজ আলমদের বয়স ৩০ এর ওপর নয়। তাই তারা যুদ্ধাপরাধ. তার বিচার, ইতাদি সম্পর্কে সঠিকভাবে ওয়াকিবহাল নন। তাদের অবগতির জন্য এসম্পর্কে দুটি কথা বলছি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। ভারতীয়রা তাই ১৬ ডিসেম্বরকে অফিসিয়ালি পাকিস্তানের ওপর ভারতীয়দের বিজয় উৎসব হিসাবে পালন করে। অথচ এটি ছিলো বাংলাদেশ কেন্দ্রিক যুদ্ধ। গতবছর নরেন্দ্রমোদি ১৬ ডিসেম্বরের বানীতে মুক্তি বাহিনীর নাম পর্যন্ত নেননি। কারন হাসিনা তো ক্ষমতায় নেই।
১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ থেকে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। কেনো তাদেরকে বাংলাদেশে রাখা হলো না? এদেশে যুদ্ধাপরাধ করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারাই ৯ মাসে বাংলাদেশীদের ওপর জুলুম চালিয়েছে। সেজন্য শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর অসংখ্যবার সভা-সমিতি এবং জনসভায় ওয়াদা করেছিলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পাক সেনাবাহিনীর বিচার করা হবে। সে এক লম্বা ইতিহাস।
৯৩ হাজারের তো আর বিচার করা যায় না। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার শুরু করলো যুদ্ধবন্দীদের শর্ট লিস্টিং। প্রথমে বলা হলো ১০ হাজারের বিচার হবে। তার পর বলা হলো ৫ হাজার , তার পর ১ হাজার। অবশেষে শর্ট লিস্টিং করতে করতে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১৯৫ জন। এ ১৯৫ জন পাক সেনার নামধামও ঠিক করা হয়। তখন কিন্তু সমস্ত যুদ্ধবন্দী ভারতে, যদিও তাদের বাংলাদেশে থাকার কথা ছিলো। এরমধ্যে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী অনুভব করেন যে, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হবে। ভারত তখন পাকিস্তানের ৫ হাজার বর্গমাইল এলাকা দখল করে রেখেছে। আর তাদের হাতে ঐ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ভারতের ঠান্ডা দেশ হিমাচল প্রদেশের শিমলায় ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অথচ এ বৈঠকে শেখ মুজিবের উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবকে বাদ দেন।
এ বৈঠকে পাকিস্তান যেমন কিছু কনসেশন বা ছাড় দেয় তেমনি ভারতও কিছু ছাড় দেয়। ভারত পাকিস্তানকে সম্মত করায় যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কাশ্মীরের যেখানে যে অবস্থায় যুদ্ধ বিরতি হয়েছে সেটি যুদ্ধ বিরতি সীমা রেখা না বলে সেটি বিবেচিত হবে লাইন অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখা হিসাবে। দ্বিতীয়ত কাশ্মীর প্রশ্ন অতঃপর দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসাবে পরিগণিত হবে। কাশ্মীর বিরোধে জাতিসংঘ তো দূরের কথা, কোনো তৃতীয় পক্ষও কথা বলতে পারবে না। এ ছাড়ের বিনিময়ে ভারত তার দখলিকৃত ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়। এছাড়া ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দির সকলকে পাকিস্তানে ফেরত দিতে রাজি হয় ভারত। এর মধ্যে ঐ ১৯৫ জন পাক সেনাও ছিলো যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং যাদেরকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার করার কথা ছিলো। অর্থাৎ ১ জন পাকিস্তানি সৈন্যেরও আর বিচার করা হয়নি। এ সিদ্ধান্তের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে লেখা হয় যে What Pakistan lost in the battle field regained in the conference table.
এতবড় একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো অথচ যে যুদ্ধের ময়দান ছিলো বাংলাদেশ এবং যে যুদ্ধের কেন্দ্র ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সে বাংলাদেশ তথা তার নেতা শেখ মুজিবকে গণনার মধ্যেই নেননি ইন্দিরা গান্ধী।
এসব কথা মাহফুজ সাহেবরা জানেন না। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের নামে যাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে সেগুলো ছিলো বিচারের নামে নগ্ন প্রহসন। ইংরেজিতে বলা হয়, Miscarriage of Justice যাদেরকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে সেগুলো ছিলো পিওর এ্যান্ড সিম্পল জুডিশিয়াল কিলিং বা বিচারিক হত্যাকাণ্ড। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের যে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিলো সেখানে যদি Retrial বা পুনর্বিচারের বিধান যোগ করা হয় তাহলে এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা যাবে যে দিল্লির ইঙ্গিতে এদেশে ইসলামী শক্তির শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার জন্য, অর্থাৎ রাজনৈতিক জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য বিচারের নামে নাটক সাজানো হয়েছিলো।
আগামীতে যদি সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে দেখানো যাবে যে কেমন করে শুধুমাত্র প্রতিশোধ স্পৃহার কারণে ৬ নেতাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে।
সূত্র,দৈনিক সংগ্রাম