সম্প্রতি উচ্চপদস্থ নারী কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলার নির্দেশিকা বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার জন্য একটি নিয়ম জারি ছিল। এই নির্দেশনা কার্যকর হবে অন্য উচ্চপদস্থ নারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও, যাঁদের সম্বোধনে এই রীতি প্রযোজ্য ছিল।
নারীদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে ‘স্যার’ শব্দটির ব্যবহার বাতিলের নির্দেশনা এলেও পুরুষের সম্পর্কে যেহেতু কোনো নির্দেশনা নেই, তাই ধারণা করা যেতে পারে যে পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘স্যার’ শব্দটির ব্যবহার অপরিবর্তিত থাকবে। এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণটি স্পষ্ট করা হয়নি। সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলার কোনো বিধান আছে বলে আমার জানা নেই। যদি এটা একধরনের চর্চা হয়ে থাকে, তাহলে শুধু নারীর ক্ষেত্রেই ‘স্যার’ বলার বিধান বাতিল করা হলো কেন? এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কি নারী কর্মকর্তাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল? নাকি স্যারদের সিদ্ধান্তে নারীদের জন্য এই নির্দেশনা এল?
আমি ব্যক্তিগতভাবে নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী নই। ‘স্যার’ শব্দটিও এর ব্যতিক্রম নয়। আমি নিজে যে সীমিত সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ক্যাডারে কাজ করেছি, ‘স্যার’ সম্বোধনটি মেনে নিতে বেশ কষ্ট হয়েছে আমার। মনে পড়ে অনেককেই আমি আমার ক্ষেত্রে ‘স্যার’ ডাকতে নিরুৎসাহিত করেছি। মনে রাখা প্রয়োজন ‘স্যার’ শব্দটি সাধারণ আর দশটি পুরুষবাচক শব্দের মতো নয়। এই শব্দটির সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছে ক্ষমতার রাজনীতি। তাই সম্বোধনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এ সম্বোধনটি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার পক্ষে আমার অবস্থান।
‘স্যার’ শব্দটি ইংরেজি ভাষা থেকে প্রবেশ করেছে আমাদের শব্দভান্ডারে সেই ব্রিটিশ শাসনামলে। ‘স্যার’ মূলত একটি সম্মানসূচক উপাধি; যার উৎপত্তি ফরাসি শব্দ ‘সিয়ার’ থেকে যা ‘লর্ড’ ‘মাস্টার’ বা ‘প্রভু’কে বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। ইংরেজি ভাষার ইতিহাসে শব্দটিকে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় ১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দে; যা প্রথমত নাইট উপাধি প্রাপ্ত এবং পরে ব্যারোনেটদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো।
প্রায় ৭৫ বছর আগে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও প্রভুত্বের গন্ধমাখা এই ‘স্যার’ শব্দটি আমাদের ভাষাচর্চায় প্রবলভাবে রয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার রাজনীতির মারপ্যাঁচ। ‘স্যার’ শব্দটির সঙ্গে যেহেতু ক্ষমতার ভীষণ বড় রকমের একটি সম্পর্ক আছে, তাই ক্ষমতা ধরে রাখাকে কেন্দ্র করে শব্দটি নিয়ে বারবার টানাহেঁচড়া করা হয়েছে।
শব্দটির রাজনীতিকরণ করা হয়েছে বারবার; এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। আর ক্ষমতার লড়াইয়ে যেহেতু নারী পিছিয়ে, তাই তার ক্ষেত্রেই শব্দটির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা ঘুরেফিরে এসেছে, সিদ্ধান্তের পরিবর্তনও হয়েছে। ক্ষমতাকে প্রবলভাবে ধারণ করে এ রকম একটি শব্দ পুরুষদের সম্বোধনের ক্ষেত্রেই–বা কেন ব্যবহার করা হবে, সেই আলোচনাটি কখনো সামনে আসে না। প্রশ্ন হলো, নারীদের ক্ষেত্রে ‘স্যার’ শব্দটি কেবল শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলের সিদ্ধান্ত ছিল বলেই বাতিল করা হলো, নাকি সেখানে কাজ করেছে নারীকে ক্ষমতায়িত দেখার সেই পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক হীনম্মন্যতা আর অস্বস্তি?
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ‘স্যার’ শব্দটি তাই সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য জোর দাবি জানাই। এ উদ্যোগটি একদিকে যেমন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সরকারি চাকুরেদের প্রভুসুলভ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে কিছুটা হলেও সহায়ক, অন্যদিকে তা আবার নারী-পুরুষের মধ্যে সম্বোধনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অস্বস্তি অনেকটাই কমিয়ে দেবে।
ভাষা কিন্তু নিছক শব্দসম্ভার নয়। আমাদের সম্বোধন করার শব্দগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। ভাষা যেমন একদিকে মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম, ঠিক একইভাবে তা কিন্তু আবার শোষণ, বৈষম্য আর নির্যাতনেরও মাধ্যম। শব্দ নির্বাচন আর প্রয়োগের রাজনীতি যুগে যুগে নির্ধারণ করেছে মানুষের সামাজিক অবস্থান।
যেহেতু ভাষা সমাজের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটায়, তাই কোনো সমাজে নারীর অবস্থান কেমন, তা বোঝা যায় সেই সমাজে নারীর প্রতি ব্যবহার হওয়া ভাষার মাধ্যমে। অস্বীকার করার উপায় নেই, কাউকে ওপরে ওঠানোর কিংবা নিচে নামানোর অন্যতম বড় অস্ত্র হলো ভাষা। শুধু তা–ই নয়; পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার একটি বড় হাতিয়ার হলো বৈষম্যমূলক ভাষা আর শব্দের ব্যবহার। ভাষাতে সম্মান, আবার ভাষাতেই অপমান।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শব্দচক্রে জর্জরিত নারীর জীবন। বাংলা শব্দসম্ভার কখনোই নারীবান্ধব নয়। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক শব্দের ব্যবহার নারীর অগ্রযাত্রাকে অনেকখানি থামিয়ে দেয়। নারীদের পথচলা এমনিতেই খুবই বন্ধুর। আমাদের পথ কখনোই খুব একটা মসৃণ ছিল না। বৈষম্যহীন দেশ গড়ার সংকল্প নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন যাত্রা শুরু করেছিল, তখন তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক।
কিন্তু এই শাসনামলেও নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, নির্যাতন, বৈষম্যমূলক নানা সিদ্ধান্ত, বিচারহীনতার ধারাবাহিক দৃষ্টান্ত কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না আমাদের। সাম্প্রতিক বৈষম্যমূলক এই নির্দেশনাটি নারীর আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমার মনে হয়।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ‘স্যার’ শব্দটি তাই সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য জোর দাবি জানাই। এ উদ্যোগটি একদিকে যেমন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সরকারি চাকুরেদের প্রভুসুলভ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে কিছুটা হলেও সহায়ক, অন্যদিকে তা আবার নারী-পুরুষের মধ্যে সম্বোধনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অস্বস্তি অনেকটাই কমিয়ে দেবে।
একই বৈঠকে পুরুষকে ‘স্যার’ আর নারীকে ‘আপা’ সম্বোধন ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব কেবলই বাড়িয়ে দেবে। আমার প্রশ্ন, নারীদের ‘আপা’ ডাকা হলে পুরুষদের ‘ভাই’ ডাকা যাবে কি? স্যাররা কি দয়া করে এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন?
মতামত লেখকের নিজস্ব