ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৮ সালের পর প্রথমবার চীন সফর করলেন। এ সফর আরও একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জগতে কূটনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনই একমাত্র স্থায়ী বিষয়। আর ভারত-চীন সম্পর্কে বারবার অদল–বদল আসায় এই দুই দেশের সম্পর্ক বরাবরই কূটনীতি নিয়ে আগ্রহীদের কাছে ‘উপাদেয়’ আলোচনার বিষয়।
আগে যখন ভারত আর চীনের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তখনো তাদের সম্পর্ক শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; তার প্রভাব আরও দূর পর্যন্ত গিয়েছিল। বাইরের নানা ঘটনা ও পরিবর্তন সব সময়ই এই সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। আজ সেই প্রভাব আরও বেশি এবং গভীর।
ইতিহাস বলছে, ভারত-চীন সম্পর্কের উত্থান-পতন হয়েছে বারবার, কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। ভারতের চীন নীতি বরাবরই একটা স্থিতিশীল ও অনুমেয় ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা করেছে। এটিই তিয়ানজিন সম্মেলনকে বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায়।
২০২০ সালে চীন পূর্ব লাদাখে হাজার হাজার সেনা ও অস্ত্র মোতায়েন করে; ফলে গালওয়ান সংঘর্ষ হয়। তারপর থেকেই সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়। ২০২৪ সালে দুই দেশ সম্পর্ক মেরামতের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পেছনে বড় কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিবর্তন। একই বছরের অক্টোবরে দেমচক ও দেপসাং সীমান্ত অঞ্চলের সমস্যা সমাধানই ছিল সম্পর্ক মেরামতের প্রথম বড় পদক্ষেপ। এরপর থেকে নীরবে হলেও সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঠিক হতে থাকে। আগস্টে ভারত সফরে এসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিশেষ প্রতিনিধি ওয়াং ই সীমান্তসহ নানা বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন।
আসলে ভারত-চীনের সম্পর্ক মেরামতের প্রক্রিয়াটা দুটি বড় বাইরের ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। তার একটি ঘটনা নেতিবাচক। অন্যটি ইতিবাচক। নেতিবাচক ঘটনাটি হলো, পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা এবং পাকিস্তানকে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ চীনের সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা। আর ইতিবাচক ঘটনাটি হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতের বিরুদ্ধে শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধ।
ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানকে, বিশেষ করে দেশটির সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ায় চীন বিস্মিত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই নীতিই ভারতকে চীনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে বিষয়টা শতভাগ সত্য নয়, কারণ ভারত-চীন সম্পর্ক অনেক বেশি জটিল। আসলে বলা ভালো, এই প্রক্রিয়া ভারত-চীন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন পথে যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তাও ভারত-চীন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে ‘পঞ্চশীল নীতি’র (চীন-ভারতের মধ্যে ১৯৫৪ সালে স্বাক্ষরিত একটি দ্বিপক্ষীয় নীতি, যা দুই দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল) প্রসঙ্গ তুলেছেন। এটি চীনের দৃষ্টিতে বর্তমান সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দেয় এবং তাদের একধরনের সদিচ্ছা প্রকাশ করে। অবশ্য ভারতের কাছে ‘পঞ্চশীল যুগ’ মানে বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতি।
ভারতের এখন এমন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত হিসাব-নিকাশ আর বিশ্বের ব্যাপারে চীন ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সঠিক সামঞ্জস্য থাকবে।
নরেন্দ্র মোদি নিশ্চিত করেছেন, তিয়ানজিনে তাঁর যাওয়ার পথ শুরু হয়েছে টোকিও থেকে। জাপান সফরে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত ঘোষণা দিয়েছেন, তা চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই দেশকেই একটি বার্তা দিয়েছে। বার্তাটি হলো বৈশ্বিক অঙ্গনে ভারত তার অর্থনৈতিক বিকল্পগুলো ধরে রাখবে এবং সেগুলো সফলভাবে কাজে লাগাবে।
ভারত যেমন চীনের আশপাশের অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, চীনও তেমনি ভারতের আশপাশের অঞ্চলে সক্রিয় হতে পারে। তবে পার্থক্য হলো, পাকিস্তান জাপানের মতো শক্তিশালী দেশ নয়। তাই ভারত এশিয়াকে চীনের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা রাখে না। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সত্যিকারের আস্থা তৈরি করতে হলে নিজেদের আশপাশের অঞ্চলে তারা যে নীতি নেয়, সেগুলো আরও স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করতে হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং
অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত-চীন সম্পর্ক ভারতের জন্য দিন দিন প্রতিকূল হচ্ছে। দুই দেশের বাণিজ্যে আসলে ‘দ্বিপক্ষীয়’ বলে কিছু নেই। মোট বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই হচ্ছে চীন থেকে ভারতে রপ্তানি; ভারতের রপ্তানি চীনে খুবই কম। এই ধারা চলতে থাকলে ভারত নিজস্ব উৎপাদন খাত চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হবে। এতে ভারত অর্থনৈতিকভাবে চীনের একধরনের অধীন দেশে পরিণত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের উচিত ভারতের ওপর অযথা রাগ না করে এটি ভাবা যে ভারত মার্কিন ভোক্তাদের কাছ থেকে যে ডলার আয় করছে আর সেই ডলার চীনে চলে যাচ্ছে। এটিই তাদের বেশি চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত। ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে এবং সেই ডলার ব্যবহার করে পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ চালাচ্ছেন—এই অভিযোগের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের আয় করা ডলারের চীনে চলে যাওয়াটা তাদের কাছে বেশি চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত।
এদিকে চীন ‘নির্ভরশীলতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার’ করার খেলায় ক্রমেই দক্ষ হয়ে উঠছে। পাশাপাশি তাদের হাতে প্রচুর অতিরিক্ত মূলধন ও অতিরিক্ত উৎপাদনক্ষমতা জমে আছে। চীন যখন এগুলো ভারতকে দেয়, সেটা সাধারণ পণ্যের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকারে আসে। তার সঙ্গে থাকে এমন প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত, যা একবার নেওয়া হলে বদলানো কঠিন হয়। এগুলোর অনেকটাই কৌশলগত খাতের সঙ্গে জড়িত। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বোঝা যায়, ভারত যে জাপানের বুলেট ট্রেন প্রযুক্তি বেছে নিয়েছে, কিংবা চীনের সহজলভ্য প্রযুক্তি না নিয়ে নিজেরা কঠিন পথ বেছে নিয়ে ফাইভ–জি ও সিক্স–জি প্রযুক্তি তৈরি করছে, তা মোটেও কাকতালীয় নয়।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে ‘পঞ্চশীল নীতি’র (চীন-ভারতের মধ্যে ১৯৫৪ সালে স্বাক্ষরিত একটি দ্বিপক্ষীয় নীতি, যা দুই দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল) প্রসঙ্গ তুলেছেন। এটি চীনের দৃষ্টিতে বর্তমান সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দেয় এবং তাদের একধরনের সদিচ্ছা প্রকাশ করে। অবশ্য ভারতের কাছে ‘পঞ্চশীল যুগ’ মানে বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতি।
সব দিক বিবেচনা করলে, তিয়ানজিন সম্মেলন কাজান (রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত হওয়া ব্রিকস সম্মেলন) থেকে শুরু হওয়া প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়েছে এবং ভারত-চীন সম্পর্ক স্থিতিশীল করার ভিত্তি তৈরি করেছে।
দুই দেশের নেতাই অংশীদার হওয়ার কথা বলেছেন—এটা ইতিবাচক দিক। তবে মনে রাখতে হবে, নিখুঁত সম্পর্ক বলে কিছু নেই। সব সম্পর্কেই ত্রুটি থাকে, বিশেষ করে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে তো থাকেই। বড় শক্তিগুলো সব সময় নিজেদের স্বার্থ রক্ষা এবং নিজেদের প্রভাবশালী অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একপক্ষীয়ভাবে কোনো জোট বা নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলে ভারতের চলার পথ মসৃণ হবে—ভারত যে এই ধারণাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তা এই সম্মেলনেই স্পষ্ট হয়েছে।
পঙ্কজ শরণ ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য ও বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ