রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে অপছন্দ হলো সংস্কার ও পরিবর্তন। আমাদের রাজনীতি নিউটনের প্রথম সূত্র মেনে প্রচলিত পথেই চলছে, নিউটন যাকে বলেছেন ‘ইনারশিয়া’ বা জড়তা। অবস্থার পরিবর্তন প্রতিরোধ করার প্রবণতা হলো জড়তা। জড়তা ও সংস্কার বিপরীতমুখী। সংস্কার অর্থ পরিবর্তন ও বিশেষ বিধিবিধান। নতুন বিধিবিধান মেনে চলতে হবে, সেটা রাজনীতিবিদদের জন্য বেশ কষ্টকর।

বিশেষ করে বিধিবিধান যদি অন্যদের লেখা সনদ হয়, সেগুলো মেনে নেওয়া আরও কঠিন। তবে নিজেদের তৈরি সংস্কারগুলোর প্রতি রাজনীতিবিদদের স্বভাবতই দুর্বলতা রয়েছে, সংগত কারণেই।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ‘সংস্কার’ করে নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা উঠিয়ে দিলেন, এ সংস্কারের কারণ দেখিয়েছিলেন, অনির্বাচিত সরকারের অধীন দেশ এক দিনের জন্যও পরিচালিত হবে না।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও নিরপেক্ষ সরকারের প্রধানকে নিয়ে ‘সংস্কার’ করেছিলেন—২০০৪ সালে, নির্বাচনের ঠিক আগে। বিএনপি সরকার, চতুর্দশ সংশোধনী করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেওয়ার বয়স বাড়িয়ে দেয়, যাতে পছন্দসই অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি নিরপেক্ষ সরকারের প্রধান হতে পারেন। ওবায়দুল কাদেরেরা ‘লগি-বইঠা’ আন্দোলন করে সেই সংস্কার আটকে দেন।

কিন্তু শেখ হাসিনার নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনপদ্ধতি বাতিল করা বিএনপি রুখতে পারেনি। তবে দুই প্রধানমন্ত্রীকেই দুভাবে ক্ষমতা হারিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল। বদিউল আলম মজুমদারের লেখা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি’ বইয়ে এসব ‘অপকর্ম ও অপরাজনীতির ইতিহাস’ কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে।

এগুলো তো হলো ইতিহাসের কথা। ইতিহাস থেকে বের হয়ে বর্তমানে ফিরে আসি।

২.

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি মূল্যবান কিছু কথা বলেছেন, ‘শুধু কাগজের লেখা পরিবর্তন মানে সংস্কার নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘লিখিত বিধিবিধান দিয়ে ফ্যাসিবাদ ঠকানো যায় না।’ কথাগুলো একদম সত্য। সংস্কার নিয়ে কঠিন কাজগুলো করতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের, বিশেষভাবে যাঁরা ক্ষমতায় যাবেন।

এই কাগজের লেখাগুলো রাজনৈতিক নেতারা যদি মনে-প্রাণে ও হৃদয়ে ধারণ করতে না পারেন, তাহলে কোনো সংস্কারই কার্যকর হবে না।

মনে হচ্ছে, মান্না দের গাওয়া ‘যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে.../ হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে’। বিখ্যাত গানটার অর্থ অনেক বিস্তৃত। সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে লেখা হচ্ছে ‘জুলাই সনদ’। রাজনীতিবিদদের ওজর-আপত্তি ও স্বার্থ সংরক্ষণের টানাহেঁচড়ায় সনদের কাগজগুলো এর মধ্যেই বেশ মলিন হয়ে গেছে। প্রশ্ন থেকেই যাবে, কাগজে লেখা সনদ-কাগজ ছিঁড়ে যাবে, তখন কী হবে? রাজনীতিবিদদের হৃদয়ে কি এই সনদ রয়ে যাবে?

৩.

জুলাই সনদে অনেক অনুচ্ছেদ-পরিচ্ছেদ দিয়ে অনেক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যে তিনটি সংস্কার প্রকৃতভাবে অর্থবহ, সেগুলো হলো—

(ক) একজনের সর্বোচ্চ দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্ব

(খ) স্বাধীন বিচারব্যবস্থা

(গ) নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন

এ তিনটি সংস্কার নিয়ে কিছু কথা বলব। যাঁরা আমাদের রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, তাঁরা বলবেন, ভবিষ্যতে অর্থবহভাবে টিকে থাকার প্রচেষ্টায় এ তিনটি সংস্কারই যথেষ্ট হুমকির মুখে পড়বে।

৪.

সনদে দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে বিএনপি যথেষ্ট আপত্তি জানিয়েছিল—পরবর্তী সময়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে মেনে নিয়েছে। একজন প্রধানমন্ত্রীকে যদি ১০ বছর কাজ করে যুবক বয়সে অবসরে যেতে হয়, তাহলে বাকি জীবন তিনি কী করবেন?

অনেকে বলেন, আমাদের দেশের পরিবারভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর পারিবারিক কর্তৃত্বেও এ সংস্কার প্রভাব ফেলবে। ১০ বছর পর পরিবারের বাইরে যিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাঁর হাতে এত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকবে যে তিনি পরবর্তী সময়ে দলের কর্তৃত্বও নিয়ে নিতে পারেন।

ভারতে মহারাষ্ট্র রাজ্যের শারদ পাওয়ার একজন ঝানু রাজনীতিবিদ। এককালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী—অনেক কিছুই ছিলেন; এখন কংগ্রেস জোটের সমর্থক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এনসিপি (ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি) চালাতে তাঁর ডানহাত ছিলেন তাঁর ভাতিজা অজিত পাওয়ার। কয় বছর আগে অজিত চাচাকে না বলে একদিন বিজেপির জোটে যোগ দিয়ে মহারাষ্ট্রের ডেপুটি চিফ মিনিস্টার হয়ে গেলেন। চাচার তো মুখে চুন-কালি! এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী সময়ে অজিত পাওয়ার ক্ষমতাবলে পুরা দলই দখল করে নিলেন। হায়রে রাজনীতি! বাংলাদেশ অবশ্য এসব হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবু নেতারা হুঁশিয়ার থাকবেন।

সে জন্য সম্ভবত কেউই আশ্চর্য হবেন না, যদি ভবিষ্যতে দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষমতাবলে দুই মেয়াদের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। তা ছাড়া কে না চায় সারা জীবন ক্ষমতায় থাকতে? শেখ হাসিনাও চেয়েছিলেন!

আরও পড়ুন

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান: স্বপ্নগুলো বুকপকেটে লুকিয়ে ফেলেছি

০৩ জুলাই ২০২৫

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান: স্বপ্নগুলো বুকপকেটে লুকিয়ে ফেলেছি

৫.

যাঁরা দেশের আইন বিভাগকে পরিশুদ্ধ রাখতে চান, তাঁদের প্রথমে বুঝতে হবে রাজনীতিকেরা কীভাবে বিচার বিভাগ চালাতে চান, কী রকম বিচারপতি নিয়োগ দিতে চান এবং কেন?

সরকার এর মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই করবে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। যদি দলীয় সমর্থকদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যায়, তাহলে নিশ্চয় বিচারপতি মুর্শেদ এবং বিচারপতি শাহাবুদ্দিনেদের মতো স্বাধীন, সৎ ও আপসহীন আইনজ্ঞরা আবার সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চে ফিরে আসবেন।

ভবিষ্যতে ‘জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহির’র নামে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিলকে যে রাজনৈতিকীকরণ করা হবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে?

৬.

নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়ে গেল। নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এমনিতেই ক্ষমতাসীনেরা অসন্তুষ্ট থাকবেন, তা জানা কথা। বিগত দিনে এই নিয়ে অনেক অশান্তি হয়েছে। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসা খুব সহজ নয়, অনেকটা অনিশ্চিত। তা ছাড়া , নির্বাচনের সময় ডিসি, এসপিকে নির্দেশ দেওয়া যাবে না, এটা অনেক রাজনীতিবিদের কাছে অচিন্তনীয় ও অস্বস্তিকর।

সংবিধান সংস্কার কমিশন যেভাবে নিরপেক্ষ সরকার নিয়োগ প্রণালি রচনা করেছে, তাতে বলা যায় রাজনীতিকেরাই নির্ধারণ করবেন কে নিরপেক্ষ সরকারে আসবেন।

সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ এর পূর্ণাঙ্গ খসড়া পাঠিয়েছে।

তাতে বলা হয়েছে - সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে, একটি 'নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি' গঠিত হবে। এতে থাকবেন - ১. প্রধানমন্ত্রী, ২. বিরোধী দলীয় নেতা, ৩. স্পিকার, ৪. ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং ৫. সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। এতে আরও বলা হয়েছে , কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহ, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবে। কমিটি একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। জানামতে, এটাই সর্বশেষ প্রস্তাব।

বাছাই কমিটিতে পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই বিরোধী দলের ( বিরোধী দলের নেতা , ডেপুটি স্পিকার , দ্বিতীয় বিরোধী দলের নেতা) । যদি সংসদে প্রধান বিরোধী দল ২০ জনের এবং দ্বিতীয় বিরোধী দল ৫ জন সদস্যের হয় , তাহলে বলা যেতে পারে - এই ২৫ জনের প্রতিনিধিরাই ঠিক করবেন পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা। তাঁদের মনোনীত প্রার্থীকে কি সবাই মানবেন?

অনেকে মনে করবেন, এই কমিটির গঠন বেশ অবাস্তব। রাজনীতিবিদেরা নিজেদের নিয়ে বাস্তব বা অবাস্তব কমিটি যাই করুন না কেন; অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তাকে নিরপেক্ষ মেনে নিতে সমস্যা দেখা দেবে। আরও কৌতূহলের বিষয় হলো , শুধু সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক দলেরাই কমিটিতে মনোনয়ন পাঠাতে পারবেন।

এইভাবে একজন ভালো লোককে প্রধান উপদেষ্টা পদে নির্বাচিত করা হলেও, তার চরিত্র হরণ শুরু হয়ে যাবে- কারণ নির্বাচিত ব্যক্তি রাজনৈতিক লোকদের মনোনয়নে এবং তাঁদের এক পক্ষের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন। কথা উঠবে তিনি কীভাবে নিরপেক্ষ হবেন? দেশে নির্বাচনের আগে একটা অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।

এই সব দৃশ্য আমরা আগেও দেখেছি, এখন শুধু অপেক্ষা পুনরায় মঞ্চস্থ হওয়ার।

বিএনপি অবশ্য সনদকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে মেনে নিচ্ছে না । তারা যে অভিমত জানিয়েছে তাতে, এ সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, এমন বিধান রাখারও বিপক্ষে বিএনপি। অনেকেই মনে করেন, কমিশনের সুপারিশগুলো একদিকে জটিল, অন্যদিকে নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করার অন্তরায় হতে পারে।

৭.

নির্বাচনকালীন সত্যিকার নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হলে, বাছাই কমিটিকে সম্পূর্ণ ক্ষমতাসীন সরকার ও রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে দূরে রাখতে হবে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সদস্যদের নিয়ে বাছাই কমিটি গঠন করতে হবে। যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, তাঁদের মধ্য থেকে সিনিয়র তিনজনকে নিয়ে বাছাই কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তাঁরা রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়িক চেম্বার, এবং অন্যান্যদের মনোনীত প্রার্থী নিয়ে একটা শর্ট লিস্ট বানাবেন। প্রার্থীদের যাচাই বাছাই ও পর্যালোচনা করে, সর্বনিম্ন দুই বিচারকের ভোটে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত করে প্রেসিডেন্টের কাছে সুপারিশ করবেন। এর চেয়েও ভালো ও নিরপেক্ষ পদ্ধতি কি হতে পারে?

এই পদ্ধতিতে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক হইচই এর বাইরে, অত্যন্ত সহজ ও, নিরপেক্ষ ভাবে এবং ন্যূনতম সময়ে নিয়োগ পাবেন প্রধান উপদেষ্টা। কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। রাজনীতিবিদেরা অন্তত এই ক্ষমতাটার থেকে নিজেদের বিমুক্ত রাখতে পারেন। মাত্র তো নব্বই দিন - এর পরেতো সব ক্ষমতাই তাঁদের এবং নতুন সরকারের।

সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সূত্র, প্রথম আলো