নির্বাচন নিয়ে দেশে নানামুখী তৎপরতা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো যে যার মতো প্রস্তুতি নিচ্ছে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করছে। আবার বড় দলে মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতার সমর্থকদের মধ্যে হানাহানির ঘটনাও ঘটছে। এরই মধ্যে গতকাল বুধবার আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগের দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার কথা জানিয়ে দেন। আগামী ১ আগস্ট থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক সরকারের নির্বাচনী প্রস্তুতির সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ফোনালাপে আরও অনেক বিষয়ের সঙ্গে নির্বাচনের প্রসঙ্গও তুলেছেন বলে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। মার্কিন শুল্কনীতির সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতির সম্পর্ক থাকুক আর না-ই থাকুক, বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য খুবই উদ্বেগজনক। তিন মাস সময় পেয়েও সরকার কেন শুল্ক সহনীয় স্তরে নিয়ে আসতে পারল না, এই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতির নির্দেশনা দিলেও নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমার কথা বলেননি। ওই দিন রাতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রধান উপদেষ্টার বরাতে বলেন, ‘নির্বাচন ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে হবে।’ পবিত্র ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন নির্বাচন হবে জানালে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল এর বিরোধিতা করে। বিএনপির নেতারা আন্দোলনে নামার ঘোষণাও দেন এ সময়। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চলতি বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার অর্থ হলো দেশবাসীকে নির্বাচনী ট্রেনে ওঠার জন্য বাঁশি বাজানো। কিন্তু তাঁদের ট্রেনে তোলার আগে এটা পরিষ্কার করা উচিত যে কোথায় গিয়ে সেটি থামবে। এই প্রেক্ষাপটে জুনের মাঝামাঝি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। ওই বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের পবিত্র রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজটি করতে হবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকেই। সে ক্ষেত্রে সময়সীমা নিয়ে ধোঁয়াশা রাখার দরকার কী? বিভিন্ন দল নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারকাজ দৃশ্যমান করার যে দাবি জানিয়েছিল, সেটা যৌক্তিক বলেই মনে করি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সব সংস্কার ও বিচার সম্পন্ন করার আগে নির্বাচন হতে পারবে না। সাম্প্রতিক সময়ে দুটিতেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে। তারা আশা করছে, জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা যাবে। ডেইলি স্টারের খবরে দেখলাম, সরকার বিএনপির কাছে যেই খসড়া পাঠিয়েছে, নিজেদের মতামতসহ তা তারা ফেরতও দিয়েছে। ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার অর্থ হলো দেশবাসীকে নির্বাচনী ট্রেনে ওঠার জন্য বাঁশি বাজানো। কিন্তু তাঁদের ট্রেনে তোলার আগে এটা পরিষ্কার করা উচিত যে কোথায় গিয়ে সেটি থামবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আরও কিছু সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে, যার বেশির ভাগের সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। যেমন গত তিন নির্বাচনে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে (পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড) ১৭ হাজার নতুন সদস্য নেওয়া, সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্সের দায়িত্ব দেওয়া, বিগত সরকারের আমলে তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ না জানানো। ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সীদের মধ্যে যাঁরা বিগত ৩টি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি, তাঁদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের ভাবনার সঙ্গেও কেউ দ্বিমত করবেন না। কিন্তু তাঁদের জন্য পৃথক ভোটার তালিকা ও আলাদা ভোটিং বুথ রাখার প্রস্তাব কোন যুক্তিতে, তা পরিষ্কার নয়। এতে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি আছে বলে মনে হয়। যেখানে ভোটারদের অর্ধেকের বেশি ১৮ থেকে ৩৩ বছরের মধ্যে, সেখানে তাঁদের আলাদা বুথ বা আলাদা তালিকা করার চিন্তা কেন? এ ধরনের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তার চেয়ে সরকারের উচিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দিকে নজর দেওয়া ও মব ভায়োলেন্স বন্ধ করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাটগ্রাম ও পটিয়ার ঘটনায় সরকার অভিন্ন অবস্থান নিতে পারলে পুলিশ বাহিনীর মনোবল বাড়ত। সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত হতো। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তরুণসহ সব ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের পছন্দসই প্রতিনিধি বেছে নিতে পারবেন। এটা এখন দৃশ্যমান যে যাঁরা ‘প্রকৃত সংস্কার’ ও ‘সত্যিকার বিচারের’ পর নির্বাচন করার জন্য মাঠে-ময়দানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে আগাম নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। একটি দল তো ২৯৬টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। যাঁরা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীন নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছেন, তাঁরাও সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষে জেলায় জেলায় গিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমনকি কোন দল কত আসনে জয়ী হবে, সেই সংখ্যাও তাঁরা জানিয়ে দিচ্ছেন। অতএব, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারের দোলাচল মোটেই কাম্য নয়। নির্বাচন তারা কবে করতে চায়, সেটি খোলাসা করে বলুক।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
(মতামত লেখকের নিজস্ব)