যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ইরানবিরোধী আগ্রাসী যুদ্ধে একধরনের ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও এর পরের পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে সেটা বলা যাচ্ছে না। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে একটি অস্থির প্রশাসন দায়িত্বে রয়েছে। স্ববিরোধিতা, বিভ্রান্তি ও নীতিগত ইউটার্ন বিবেচনায় ট্রাম্প প্রশাসন ভূরাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার এক শিল্পে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এখন পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে তার অনেক কিছু নির্ভর করবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ এবং ইরানের প্রতিক্রিয়ার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাটি সেখানে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভূমিকার দিক থেকে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর পেছনের আসনে চলে গেছেন।
ট্রাম্প মূলত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। অনেক সময় নেতানিয়াহুর কৌশলগত চাল ও ঠান্ডা মাথার ষড়যন্ত্র দেখে অবাক ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন, নেতানিয়াহুও সেটা করছেন।
সম্প্রতি নেতানিয়াহু ইরানে যে বোমা হামলা চালিয়েছেন, সেটা শুধু পশ্চিমা বিশ্বের ‘ইসরায়েল সমস্যা’-কে আরও জটিল করে তুলেছে। ওয়াশিংটন নিজেদের জাতীয় স্বার্থ ও ঘোষিত মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে বিশ্বাসহীন ও কেবলমাত্র স্বার্থান্ধ ইসরায়েলি ‘মিত্রের’ কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
ট্রাম্প নিজেকে একজন ‘যুদ্ধবিরোধী প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে জাহির করেন। ২০১৯ সালে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, মহান জাতিগুলো কখনোই অনন্তকাল ধরে চলা যুদ্ধ শুরু করতে পারে না। তিনি বিদেশে উদারবাদ ও গণতন্ত্র রপ্তানিতেও আগ্রহী নন।
কিন্তু নেতানিয়াহু ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ না করার নীতিকে পরাজিত করেছেন। এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, যেখানে ট্রাম্প রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মুখ রক্ষার জন্য হলেও হস্তক্ষেপ করার পথ বেছে নিয়েছেন।
গত মাসে যে সংঘাতের ঘটনা ঘটল তাতে দেখা যাচ্ছে, ইরানের পারমাণবিক হুমকি দূর করার ঘোষিত লক্ষ্যের প্রায় কোনোটিই অর্জিত হয়নি। ঘটনাপ্রবাহ থেকে যেটা খোলাসা হয়েছে তা হলো, দীর্ঘ মেয়াদে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের জন্যও তা উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। এর কয়েকটি কারণ আছে।
নেতানিয়াহুর লাগাতার চাপের মুখে ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সীমিত ‘সার্জিক্যাল’ হামলার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তিনি খুব সতর্কভাবে জানিয়ে দেন যে, এই বোমাবর্ষণই এই অধ্যায়ের সমাপ্তি। ইরানের বিরুদ্ধে আর কোনো সামরিক অভিযানে যাওয়ার তাঁর ইচ্ছা বা পরিকল্পনা নেই।
কিন্তু ট্রাম্পকে বেশি দিনের জন্য সরে থাকতে দেবেন কি নেতানিয়াহু? এটা সত্যি যে মধ্যপ্রাচ্যে এখনো একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু চলমান রক্তক্ষয়ী পরিবর্তনগুলোর ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ন্ত্রক আর যুক্তরাষ্ট্র নয়, সেই ভূমিকা এখন পালন করছে ইসরায়েল।
গত মাসে যে সংঘাতের ঘটনা ঘটল তাতে দেখা যাচ্ছে, ইরানের পারমাণবিক হুমকি দূর করার ঘোষিত লক্ষ্যের প্রায় কোনোটিই অর্জিত হয়নি। ঘটনাপ্রবাহ থেকে যেটা খোলাসা হয়েছে তা হলো, দীর্ঘ মেয়াদে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের জন্যও তা উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। এর কয়েকটি কারণ আছে।
প্রথমত, এই আক্রমণ অপ্রত্যক্ষভাবে ইরানের বর্তমান শাসকদের শক্তিকে সংহত করেছে। এর কারণ হলো, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ আক্রমণ মোকাবিলায় জাতীয় প্রতিরক্ষা ইস্যুতে ইরানের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইরান এখন হয়তো পারমাণবিক কর্মসূচি আরও জোরদার করবে এবং আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে পরমাণু বোমা তৈরির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, এই ঘটনার ফলে ইরান এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ–বিষয়ক চুক্তি থেকেও সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই চুক্তিতে ইসরায়েল স্বাক্ষর করেনি, কিন্তু ইরান করেছিল। বর্তমানে ইরান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থাকে সহযোগিতার বিষয়টি স্থগিত করেছে এবং সংস্থাটির পরিদর্শকদের পরিদর্শনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
সবকিছুর পরও এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে নেতানিয়াহু অত্যন্ত কৌশলে এক ঢিলে কয়েকটি পাখি মেরেছেন।
নেতানিয়াহু অন্তত অল্প সময়ের জন্য হলেও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিলম্বিত করতে পেরেছেন। একই সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্র-ইরান কূটনৈতিক আলোচনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পেরেছেন। সম্ভাব্য ফ্রান্স-সৌদি সম্মেলন বানচাল করতে পেরেছেন। কেননা ওই সম্মেলন থেকে ইউরোপের দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে পারত।
নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক মনোযোগকে গাজা থেকে অন্যখানে সরিয়ে নিতে পেরেছেন। এর ফলে ইসরায়েলের পক্ষে গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন ও গণহত্যা অব্যাহত রাখা আরও সহজ হয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, স্পেনসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ যখন গাজা ইস্যুতে তীব্র সমালোচনা করছিল এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি বা বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছিল, তখন নেতানিয়াহু ওই সমালোচনাগুলো স্তব্ধ করে দেন। রাতারাতি ইসরায়েলকে ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলোর ঐকমত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ফলে ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছিল, সেটা কিছুটা মজবুত হয়েছে।
সর্বোপরি, নেতানিয়াহু অবশেষে সেই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন, যার জন্য তিনি কয়েক দশক ধরে চেষ্টা করে আসছিলেন। সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে ইরানে বোমাবর্ষণ করানো। এটি নেতানিয়াহুর জন্য বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে ধরা যায়।
একটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে ইরানের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহুর যুদ্ধ ছিল তেহরানের মিত্রদের ওপর তার বহুমাত্রিক আক্রমণের সর্বশেষ পর্ব। গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুতি—অক্টোপাসের শুঁড়গুলোকে নিশানা করার পর সরাসরি ‘প্রতিরোধের অক্ষের’ প্রধান ইরানকে আক্রমণ করে ইসরায়েল।
যদিও এসব সামরিক অভিযানকে নেতানিয়াহু ধারাবাহিকভাবে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করে চলেছেন। কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্য হলো গোটা অঞ্চলকে একটি স্থায়ী অস্থিতিশীলতার মধ্যে ফেলে দেওয়া। আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ার ওপর নেতানিয়াহুর আক্রমণ আরও একবার প্রমাণ করেছে যে ইসরায়েলের এই হিংস্র আগ্রাসনের প্রধান চালিকা শক্তি তথাকথিত ‘আত্মরক্ষা’ নয়।
শেষ পর্যন্ত, নেতানিয়াহুর লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যার কেন্দ্রবিন্দু হবে প্রশ্নাতীত ইসরায়েলি আধিপত্য ও প্রাধান্য।
যদি কেউ জানতে চায়, ইসরায়েলের আধিপত্যে পরিচালিত একটি নতুন বিশ্ব কেমন দেখতে হবে, উত্তরটা খুব সহজ। শুধু গাজার দিকে তাকালেই হবে।
আলাঁ গাবোঁ যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষা অধ্যয়নের সহযোগী অধ্যাপক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত