২৬, ২০২৫ রাতের ঘটনা পরদিন সকালে প্রায় সবগুলো চ্যানেল দেখাচ্ছিল বারবার। মনে হচ্ছিল, একই স্ক্রিপ্ট পড়ছেন সবাই। ডাকসুর ভিপি পদপ্রত্যাশী এক ছাত্র তাঁর রুমমেটকে ‘খুন’ করার চেষ্টায় রক্তাক্ত করেছেন। হলের ছাত্ররা তাতে উত্তেজিত হয়ে তখনই তার ‘হাতবিচার’ করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

প্রভোস্ট প্রমুখ গিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর আবাসিক সিট বাতিল করে উত্তেজিত ছাত্রদের দাবির মুখে তাঁকে পুলিশের হাওলা করে দিয়েছেন। হত্যাচেষ্টার জন্য অভিযুক্ত করে মামলাও করেছে হল কর্তৃপক্ষ। আজকাল কোনো খবরেই আর গা ভাসাই না।

যে হলের ঘটনা, সে হলে ১৯৭৪ সালে পাশের হল থেকে ধরে এনে সাতজনকে গুলি করে মারা হয়েছিল। সেই ঘটনায় কত দিন পরে কারা মামলা করেছিলেন। খুনিদের চিনতেন সবাই, পরের দিন সব পত্রিকায় একই বয়ান ছাপা হয়েছিল। যখন সব বয়ান, সব স্ক্রিপ্ট মিলে যায়, তখন মনে হয় কলকাঠি অন্য কেউ নাড়ছেন নিরাপদ কোনো জায়গায় বসে। টিভির ছবিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির চেহারা বোঝা যাচ্ছিল না।

ফেসবুকে দেখে মনে হলো কোথায় যেন দেখেছি। নাম ও চেহারার মিল জালাল আহমেদ সাকিনের—পেকুয়া, কক্সবাজার। আজ থেকে ১০–১১ বছর আগে ৯ আগস্ট ২০১৪ সালে বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটক থেকে পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল (গুম বলা চলে)। যত দূর মনে পড়ে, প্রায় দুই মাস তাঁর কোনো হদিস ছিল না। এ প্রসঙ্গে তখনকার ডিবির ভাষ্য ছিল, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। তাই আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় লাগায় গ্রেপ্তারের প্রায় দুই মাস পরে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হলো।’ (প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর ২০১৪)।

তখন জালাল আহমেদ সাকিনের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ ছিল—জালাল ‘নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে ২৪ পাতার একটি খসড়া বই লিখে সহিংস আন্দোলনের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে রাষ্ট্রদ্রোহের কাজ করেছেন। আসলে কর্তৃত্ববাদী একটি সরকারকে সরাতে কী কী কৌশল অবলম্বন করা যায়; কোন তরিকায় বিরোধী সমমনাদের ঐক্য গড়ে তোলা আর অটুট রাখা যায়, এসব নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা তিনি লিখে ফেলেছিলেন কাগজে।

বলা যায়, দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর থিসিস ছিল সেটি। সেটি নিয়েই তিনি ছুটে যেতেন পরিবর্তনপ্রত্যাশীদের কাছে।’ আগস্টের ৯ তারিখে আটকের পর তাঁকে কথিত রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় আটক দেখানো হয় ৪ অক্টোবর। পল্টন থানায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি করেন তৎকালীন ডিবির উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান। আরও দিন চারেক পর ১৩ অক্টোবর মহানগর হাকিম রেজাউল করিমের আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চায় ডিবি।

আদালত ১৯ অক্টোবর রিমান্ড শুনানির পর এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তারপর সবাই তাঁর কথা ভুলে যান একসময়। জামিন হতে হতে এক বছর কেটে যায় কারাগারে। যে ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জালাল জড়িত ছিল, তারাও হাত গুটিয়ে নেয়। এ যেন আরেক শামসুল হক ট্র্যাজেডি।

যে তরুণ শামসুল হকের সাহসের ওপর ভর করে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন মুসলিম লীগকে চ্যালেঞ্জ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। দল করার আগেই উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী টাঙ্গাইলের করটিয়ার প্রতাপশালী জমিদার খুররম খান পন্নীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে সারা পাকিস্তানে সাড়া ফেলে দেন। নির্বাচনের পর ৮ মে ১৯৪৯ সালে ঢাকাবাসীর পক্ষে ‘পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবির’ আইন পরিষদের সদস্য জননেতা শামসুল হককে ভিক্টোরিয়া পার্কে গণসংবর্ধনা দেয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বলছিলেন, ‘ছেলেতুল্য এই শামসুল হকই বাংলার ভাবি প্রধানমন্ত্রী হবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করছি।’

১৯৪৭-৫২ সালে অনেকেই শামসুল হককে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ চিফ মিনিস্টার বলে কল্পনা করতেন। সেই শামসুল হককে পার্টির নেতারা মানসিক রোগী হিসেবে জেলে রেখে চলে আসেন। জালালও কি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন?

এই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর মেলে তাঁর এক শুভানুধ্যায়ীর লেখায় ‘পরিবার ও পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্নতা, বৈদ্যুতিক শক-সহ নানা প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন জালালকে মানসিকভাবে পর্যদস্ত করে ফেলে। আটক থাকাকালে নানা থেরাপি, আন্দোলনে মাথায় আঘাত, বিপন্ন জীবন—সব মিলিয়ে জালালের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা জেল–জুলুমের বাইরে খোলা বাতাসে থাকা আর দশজনের মতো থাকার কথা নয়।

জানা যায় মেধাবী ছেলে জালালও সেটি বুঝত, কিছু থেরাপিও নিয়েছেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে পূর্ণ চিকিৎসা করাতে পারেননি। সাংবাদিকতার সামান্য একটি চাকরিতে তার পড়ালেখার খরচ মেটানো কঠিন ছিল। বন্ধুরা তাঁকে বলেছিলেন সরকারের সহায়তায় চিকিৎসা নিতে। জালাল রাজি হননি। নিজের চিকিৎসা নিতে সরকারি পয়সা নিতে নিজের কাছে নিজেকে ছোটো লাগে—এই ছিল তাঁর জবাব।

তবে আহত জালাল দমে যাননি। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন; কিন্তু কিছু কিছু আঘাত মানুষের মন ও মস্তিষ্ককে এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করে যে তার আর উপশম হয় না। যেমন হয়নি কিংবদন্তি ছাত্র জননেতা শামসুল হকের।

জালাল রক্ত দিয়েছেন ঠিকই। ২০১৩ সালে রক্ত দিয়েছেন। ২০১৮ সালে রক্ত দিয়েছেন। ২০২৪ সালে রক্ত দিয়েছেন। ২০১৮ সালে নুর, ফারুক ও রাশেদ গ্রেপ্তার, পুরো আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন জালাল। তাঁদের কারামুক্ত করতে দৌড়েছিলেন জালাল। বিনিময়ে কী পান জালাল? বারবার আহত হয়ে, জেলে গিয়ে, নিপীড়ত হয়ে নস্যাৎ হয় পড়াশোনা, রুদ্ধ হয় মসৃণ ক্যারিয়ার। এমনকি স্নাতক শেষ হতে হতে পেরিয়ে যায় জীবনের এক দীর্ঘ দশক।

জালালের আরেক বন্ধু বলছিলেন, ‘জ্বালাময়ী জালালের আগুন জ্বালানো ঝলক আমরা দেখেছি ২০১৮ সালের আন্দোলনে। ২০১৮ সালে নুর-ফারুক-রাশেদ গ্রেপ্তার, পুরো আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন জালাল। জানুয়ারি মাসে রিট হওয়ার পর টিএসসিতে প্রথম ৩০-৩৫ জনের ছোট্ট মিটিংয়ে যে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে, সেই স্ফুলিঙ্গ থেকেই জেগে ওঠেন জালাল। কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ থেকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিলে আমরা আড়ালে চলে গেলেও জালাল আরও সামনে আসেন। জানুয়ারি মাসে যখন অল্প কজন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, টিএসসি ও শাহবাগ ঘুরে ঘুরে সমর্থক সংগ্রহের কাজ চালাচ্ছিলেন, সেই সময় থেকেই জালাল সক্রিয়ভাবে আন্দোলন সংঘটিত করতে থাকেন। অন্যদের আড়ালে থেকে কাজ করার পরামর্শ দিলেও তিনি সামনেই থেকে যান বুক ফুলিয়ে বুলেটের সামনে। জালাল বলেছিলেন, “রক্ত না দিলে পরিবর্তন আসে না। আমি রক্ত দেব।”’

জালাল রক্ত দিয়েছেন ঠিকই। ২০১৩ সালে রক্ত দিয়েছেন। ২০১৮ সালে রক্ত দিয়েছেন। ২০২৪ সালে রক্ত দিয়েছেন। ২০১৮ সালে নুর, ফারুক ও রাশেদ গ্রেপ্তার, পুরো আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন জালাল। তাঁদের কারামুক্ত করতে দৌড়েছিলেন জালাল।

বিনিময়ে কী পান জালাল? বারবার আহত হয়ে, জেলে গিয়ে, নিপীড়ত হয়ে নস্যাৎ হয় পড়াশোনা, রুদ্ধ হয় মসৃণ ক্যারিয়ার। এমনকি স্নাতক শেষ হতে হতে পেরিয়ে যায় জীবনের এক দীর্ঘ দশক।

জালাল মানসিকভাবেও অনেকটা একা হয়ে যান এরই মধ্যে। গণ–অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাঁই হয় তাঁর। আশা ছিল, তাঁর দল জালালের আপসহীনতা ও সাহসের মূল্যায়ন করবে। কিন্তু হায়! ওর বন্ধু বা সমবয়সীরা কেউ তো হলে নেই। আর যারা মাস্টার্সে পড়েন, তাঁরাও তাঁর পাঁচ-ছয় বছরের জুনিয়র। বয়সের পার্থক্য মানসিকতার পার্থক্যকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। একদিকে যেহেতু জালাল দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে এত অবদান রেখেছেন, আর তিনি এত সিনিয়র, তাই জুনিয়রদের থেকে একটু সম্মান ও শ্রদ্ধা আশা করতেন।

অন্যদিকে গণ–অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশের তরুণদের মনে কাউকে না গোনায় ধরার যে উত্তরাধুনিক ঢেউ বয়ে গেছে, তার সঙ্গে জালালের প্রত্যাশার সংঘর্ষ ঘটে। তার ওপর আছে ক্যাম্পাসে নানামাত্রিক রাজনৈতিক চাল-প্রতিচাল। কাকে ডাউন করে কে উঠবেন, এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা পেয়েছে যেন।

তাৎক্ষণিকভাবে সিট বাতিল করে পুলিশের হাতে খুনের আসামি হিসেবে জালালকে তুলে দেওয়ার আগে হল কর্তৃপক্ষকে এগুলো বিবেচনা করা উচিত ছিল। তাঁরা বলতে পারেন, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করার আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তাঁরাও প্রাণের ভয়ে ছিলেন, তাই জালালকেই বলি দিতে হয়েছে।

সেদিন রাতে জালালের পক্ষে দু–একজন দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের ক্ষীণস্বর হল কর্তৃপক্ষের কান পর্যন্ত যায়নি। তাঁরা বলেছিলেন ‘মব’ না করে জালালকে উদ্ধার করে সবকিছু শুনে ঠান্ডা মাথায় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

যে হলের এই ঘটনা, তার পাশের হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থী আবদুল ওয়াহেদ জানান, ‘ঘটনার পর আবদ্ধ রুমে জালালের আত্মহত্যার আশঙ্কা করছিলাম। তাই বলি যে এ রকম ঘটনা ঘটলে রুমের সামনে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের দায় নিতে হবে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ও পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা কথা দেন, তাঁর গায়ে হাত তোলা হবে না। কিন্তু রুম থেকে বের হওয়ার পর তাঁকে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামনেই প্রচণ্ড মারধরে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। সে সময় তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ঠিক হচ্ছে না। জালাল দোষী হলেও আইন অনুযায়ী তাঁর শাস্তি হোক; কিন্তু হামলা ও মারধর সমাধান নয়। তখন একদল শিক্ষার্থী আমার মুঠোফোন কেড়ে নেন এবং জালালের ওপর হামলার ভিডিও ফেসবুক থেকে ডিলিট করতে বাধ্য করেন। এ সময় তাঁরা আমার গায়েও হাত তোলেন। এ ছাড়া আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া মুঠোফোনটি থানা থেকে এক ঘণ্টা পরে উদ্ধার করেছি।’

এ লেখা প্রকাশের আগেই হয়তো জালালের জামিন হবে কিংবা হবে না। তবে তাঁকে নিয়ে এখন কেউ ভাবছে না। যেমন আওয়ামী লীগ ভাবেনি তাদের পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্তম্ভ শামসুল হকের কথা। পাগলা গারদে পাঠিয়ে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে দায় সেরেছিলেন সবাই। তাঁর শূন্য চেয়ারটা সারা জীবনের জন্য দখলের প্রত্যাশায় থাকা ব্যক্তিরা কেন তাঁকে নিয়ে ভাববেন?

তবে নতুন বাংলাদেশে শামসুল হকদের নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে আন্দোলনের অন্যতম রূপকার কেন এভাবে হারিয়ে যাবেন। জেল আর রিমান্ডের অত্যাচারে জেরবার হওয়া নেতা– কর্মীদের সঠিক চিকিৎসা আর মানসিক পুনর্বাসনের অঙ্গীকার করতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

সূত্র, প্রথম আলো