জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উদ্যাপনের লক্ষ্যে নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু করেছে। এক মাসে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা সফর করবে এনসিপির জুলাই পদযাত্রা।
আত্মপ্রকাশের পর থেকেই এনসিপি নানা ধরনের মন্তব্য, সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। টিএসসিকেন্দ্রিক দল, ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনীতি—এমন নানা তকমায় এনসিপিকে জর্জরিত করা হয়েছে। পবিত্র রমজান মাসের ঠিক আগের দিন আত্মপ্রকাশ করা দলটি রমজানের পুরো মাস কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম করতে পারেনি বললেই চলে। এরপর আড়াই মাসের ব্যবধানে এসেছে দুটি ঈদ।
এসব বাস্তবতা সত্ত্বেও আত্মপ্রকাশের চার মাসের মাথায় এনসিপি দেশজুড়ে পদযাত্রা করার মতো কঠিন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গ্রাম–শহর, পাড়া–মহল্লা ও বাজারে এনসিপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা মানুষের কাছে যাচ্ছেন, কথা বলছেন। মানুষ বুকে টেনে নিচ্ছেন ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের সন্তানদের।
আমার মতো জাতীয় রাজনীতিতে যাঁরা নতুন, তাঁদের জন্য এই পদযাত্রা, প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানো অত্যন্ত সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। মানুষের কথা শুনলে, তাঁদের চাওয়া–পাওয়া জানলে পুরো জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
আমি একটা কথা প্রায়ই বলি, যাঁরা নতুন দল এনসিপিকে সমর্থন করবেন বা যাঁরা এনসিপির কাছে প্রত্যাশা করেন, তাঁরা কিন্তু ঘরে বসে এনসিপিকে নজরে রাখছেন, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁরা সাধারণত সভা–সমাবেশে যাবেন না; উল্টো এনসিপিকে তাঁদের দুয়ারে দুয়ারে, পাড়ায় পাড়ায় যেতে হবে।
কারণ, যে বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল, তারা মূলত নির্দলীয়, প্রথাগত রাজনৈতিক সভা–সমাবেশে তাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে না। কিন্তু তারা রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিকভাবে সচেতন। আর এনসিপির মূল ভরকেন্দ্র মূলত তারাই।
ঢাকার শহুরে গণ্ডি থেকে বের হয়ে এনসিপির এই দেশজুড়ে পদযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। বারবার প্রান্তিক, তৃণমূলের মানুষের কাছে ফিরে যেতে হবে, তাঁদের অধিকারের পক্ষে কথা বলা অব্যাহত রাখতে হবে।
জুলাই পদযাত্রায় মানুষের সাড়া, স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন থেকে বোঝা যায়, এনসিপি সঠিক পথে এগোচ্ছে। নিঃসন্দেহে এনসিপিকে অনেক দূর যেতে হবে, অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু এই যে গণমানুষের দরজায় দরজায় যাওয়ার যে প্রচেষ্টা, সেটাতেই মানুষ আশার আলো দেখছেন, নতুনকে ঘিরে গণতান্ত্রিক আগামীর স্বপ্ন বুনছে।
এনসিপির নারীদের মূলধারার রাজনীতিতে আসা, ফ্যাসিবাদীব্যবস্থা বিলোপের প্রত্যয়, গণতান্ত্রিক জাগরণের জন্য মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিতকরণে দৃঢ়তা—সব বয়সের নারীদের নতুন করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভাবতে বাধ্য করছে। ঢাকার বিদ্বৎসমাজ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহল—প্রায়ই শোনা যায়, মানুষ সংস্কার বোঝেন না, আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও জুলুমের ব্যাপারে তাঁরা নির্বিকার। অথচ প্রান্তিক বাস্তবতা এমন ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।
সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ হবে, কৃষকের ঋণের বোঝা শেষ হবে, কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন, অসুস্থ হলে বিনা মূল্যে চিকিৎসা পাবেন, প্রত্যন্ত এলাকার সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া কিশোরীরা মূলধারায় আসতে বাধাগ্রস্ত হবে না, সন্তান জন্মের সময় মা নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা পাবেন; মানুষ এসব চান। মানুষ ফসলের মাঠ থেকে শহরের সুপারশপ পর্যন্ত যে সিন্ডিকেট, তার অবসান চান; এরই গালভরা নাম সংস্কার।
মানুষ বিশ্বাস করতে চান, নতুনেরা এসে পুরোনো সিস্টেমে নিজেদের মানিয়ে নেবেন না; বরং এক নতুন ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। বিগত ১৫ বছরের অবৈধ শাসন ও জুলুমের বিচারের প্রশ্নে এই মানুষেরা লালন করেন দৃঢ়প্রত্যয়।
সৈয়দপুরে পদযাত্রা শেষে আরেক শহরে যাওয়ার জন্য গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। প্রচণ্ড রোদে একটা দোকানের ছাউনিতে দাঁড়াতেই ফল বিক্রেতা ভেতরে বসতে বলেন, তাঁর ছোট্ট টেবিল ফ্যানটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিজে থেকে আলাপ শুরু করেন। এনসিপি নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কারা কারা আছেন এই দলে। আলাপ করতে করতে আশপাশের আরও দু–চারজন দোকানি যুক্ত হন। তাঁরা কেউ রাজনীতি করেন না, কিন্তু হাসিনা পালানোর পর তাঁরা নতুন দলের খোঁজখবর রাখেন। নতুন দলের পাশে থাকতে চান।
জিজ্ঞেস করলাম, কেন? জবাব পেলাম, সবাই লুটপাট করে, আশা করেন নতুনেরা মানুষের ‘হক’ খাবেন না। যখন অপরিচিতদের সঙ্গে এ রকম কথা চলে, তখন নিজের অজান্তেই দায়বদ্ধতা, একধরনের দায়িত্ব অনুভব করি। কথা শেষ করে গাড়ির জন্য এগোতেই পাশের পেয়ারা বিক্রেতা এক চাচা একটা পেয়ারা ধুয়ে দিলেন খেতে। কিছুতেই তিনি টাকা নেবেন না। সৈয়দপুরের বিশিষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘সৈয়দপুরের মানুষ আমরা, আমাদের মন অনেক বড়, টাকা লাগবে না, শুধু দেশের জন্য ভালো কইরো।’
এ রকম ছোট ছোট গল্প কুড়াতে কুড়াতে এগোচ্ছি আমরা। মানুষের সঙ্গে এই মিথস্ক্রিয়ার পর এনসিপিও দল হিসেবে আমূল বদলে যাবে। এনসিপি বুঝতে পারবে, কেন তাদের পুরোনোদের থেকে যেকোনো মূল্যে আলাদা হতে হবে।
হাতিখানা বিহারি ক্যাম্পের ছোট ছোট এক রুমের সারি সারি বাসা, একেক রুমে এক পরিবারের পাঁচ–ছয়জন করে থাকেন। এঁদের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের জীবনের নানা অভিযোগ–অনুযোগ ও নানা বঞ্চনার গল্প পুরো দিন শুনলেও যেন শেষ হবে না। এই দেশে ক্ষমতার হাতবদল, সরকারের উত্থান-পতন চলমান, শুধু যেন থেমে আছে এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবন।
এনসিপিকে তাঁদের কণ্ঠস্বর হতে হবে। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে এনসিপিকে এগিয়ে যেতে হবে। গ্রাম–শহর ও পাড়া–মহল্লায় যেসব সাধারণ মানুষ এনসিপির উপকারে আসবেন না, যেসব মানুষ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান না, যাঁদের কাছে রাজনীতি মানে ক্ষমতার খেলা, যাঁরা নিজেদের জীবনের গ্লানি টানতে টানতে ক্লান্ত, এনসিপিকে কাজ করতে হবে তাঁদের জন্যই। আর ঠিক এ রকম মানুষেরাই মন থেকে নতুনকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের বাড়িতে যখন সবাই গেলেন, আমরা দু-একজন ভিড় থেকে বের হয়ে একটু আশপাশের বাড়িতে গেলাম। উৎসুক জনতা তো বের হয়ে আসেন; কিন্তু ঘরের মা, বোন ও ভাইদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। তাঁরা স্বাগত জানালেন আন্তরিকতার সঙ্গে। কেউ বাগানের পাকা আম খেতে দেন, কেউ বিস্কুট এনে দেন।
কথায় কথায় তাঁরা জানালেন, বাড়ির মেয়েদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, নিরাপত্তা চান। তাঁদের দাবি, জীবন নিয়ে আহামরি কোনো উচ্চাশা তাঁদের নেই; কিন্তু অসুস্থ হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য দূরে যেতে হয়, ঢাকা যেতে হয়। উন্নত চিকিৎসা নিজ জেলায় কেন হয় না। এই প্রশ্ন আমাদেরও। মানুষের খাওয়া-পরা, চিকিৎসার ন্যায্য ব্যবস্থা হলেই এ দেশের অধিকাংশ মানুষ তৃপ্ত। কিন্তু একদম মৌলিক চাহিদাই পূর্ণ হওয়া থেকেই বঞ্চিত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
ঢাকার শহুরে গণ্ডি থেকে বের হয়ে এনসিপির এই দেশজুড়ে পদযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। বারবার প্রান্তিক, তৃণমূলের মানুষের কাছে ফিরে যেতে হবে, তাঁদের অধিকারের পক্ষে কথা বলা অব্যাহত রাখতে হবে। যে দায়-দরদের রাজনীতি আমরা করতে চাই, সেটাতেই মূল লক্ষ্য স্থির রেখে এগোতে হবে। নানা পরিসরে প্রশংসিত হচ্ছে এনসিপির এই জুলাই পদযাত্রা। বুদ্ধিজীবী, সমালোচক, আড়ালের সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীরাও স্বাগত জানাচ্ছেন নতুন প্রজন্মের এই রাজনৈতিক উদ্যোগকে।
ছাত্র-তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া পাচ্ছে জেলায় জেলায় গণমানুষের কাছে। এই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়ার পেছনে একটাই কারণ, মানুষ নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে পুরোনো বন্দোবস্তের পরিবর্তন চান। মানুষ মনে করেন, যাঁরা গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম ফ্যাসিবাদী শাসককে পালাতে বাধ্য করেছেন, তাঁরা এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম ও সফল হবেন।
আর এনসিপিও বুঝেছে, দায়িত্ব অনেক, পাশাপাশি বাধাও অনেক। এনসিপির জুলাই পদযাত্রার এই কার্যক্রমের মাধ্যমে জেলায় জেলায় প্রতিদিন যে গণজোয়ার তৈরি হচ্ছে, প্রতিদিন দুটি জেলায় চার–পাঁচটি করে পথসভা হচ্ছে, তার খুব কমই মূলধারার গণমাধ্যমে আসছে। মানুষের কাছে পৌঁছাতে যত বাধাই আসুক, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে যতই ছাত্র–জনতার নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা থাকুক, এভাবে চলতে থাকলে কোনো এনসিপি মানুষের মনে জায়গা করে নেবে।
রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মূলধারার গণমাধ্যম, গোয়েন্দা সংস্থাসহ পুরো দেশ হাসিনার হাতের মুঠোয় থাকার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। হাসিনাকে পাশের দেশে পালিয়ে যেতে হয়েছে। ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতন ঘটিয়ে যে আত্মবিশ্বাস অর্জিত হয়েছে; ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ তথা নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে সেই উদ্যম কাজে লাগাতে হবে।
তাজনূভা জাবীন যুগ্ম আহ্বায়ক, এনসিপি
*মতামত লেখকের নিজস্ব