আজ ১৫ জুলাই। আগামীকাল ১৬ জুলাই। রংপুরের গর্ব তথা বাংলাদেশের গর্ব আবু সাঈদ এদিন হাসিনার পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদে বুক চিতিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান। এরপর পুলিশ প্রাণঘাতি বুলেট দিয়ে পর পর ৩ বার তাকে আঘাত করে। ফলে আবু সাঈদ শহীদ হন। মাত্র ১ বছর আগের কথা। সকলেই সব জানেন। তবুও ১ বছর পরে এলোমেলো ভাব দেখে সদ্য পুরোনো হওয়া কথা গুলি বলতে হচ্ছে। বস্তুত ১৬ জুলাই পুলিশের মধ্যযুগীয় বর্বরতা এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দাবানল জ¦ালিয়ে দেয়। এদিন থেকেই শুরু হয় ছাত্র-জনতার শহীদ হওয়ার পালা। এই রকম অকাতরে প্রাণ বিসর্জন আমাকে মনে করিয়ে দেয় একটি পুরোনো রাজনৈতিক গানের কয়েকটি কলি: ঝরাও রক্ত ছড়াও রক্ত যত খুশি তুমি পারো রাজপথে আজ জনতা জেগেছে যত খুশি তুমি মারো। এই সেই জুলাই। তারপর ৫ আগস্ট। জুলাইয়ের ৩১ দিন এবং অগাস্টের ৫ দিন। এই ৩৬ দিনের ইতিহাস ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার জালিম শাহীর বিরুদ্ধে লক্ষ-কোটি ছাত্র-জনতার প্রচন্ড গণঅভ্যুত্থানের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। ১ বছর হতে চললো। এখন দেখছি এই মহান কিন্তু রক্ত হিম করা অভ্যুত্থানকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধা মতো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। কেউ বলছে এটা ছিলো শেখ হাসিনাকে সরিয়ে একটি নির্বাচন দেওয়ার আন্দোলন। কেউ বলছে, কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বিতাড়িত করে কোটি কোটি গণমানুষের অভিপ্রায় ব্যক্ত করার অভ্যুত্থান। আসলে জুলাই অভ্যুত্থান কী ছিলো? কেনো হয়েছিলো? তার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? সেই বিষয়টি জানার জন্যই একটি তীক্ষè অনুসন্ধানী চোখ নিয়ে আসুন, একটু পেছনে ফিরে দেখি। আপনি যদি সত্যানুসন্ধানী হন তাহলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে এই জুলাই অভ্যুত্থানের টাইম লাইনে। সেটি করতে হলে আপনাকে শুরু করতে হবে ২০২৪ সালের ৫ জুন বুধবার থেকে। ৫ জুন সরকারি ও আধাসরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পরদিন ৬ জুন এই রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ৯ জুন রবিবার সরকারকে রায় বাতিলে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দিয়ে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। তারপর বেশ কিছুদিন বিরতি। ১ জুলাই ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর ৫ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রদের দাবির পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৬ জুলাই আন্দোলনে আসে একটি নতুন শব্দ। সেটি হলো বাংলা ব্লকেড। অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজসমূহে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা। ১০ জুলাই বুধবার সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেডে সারাদেশ থেকে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ॥দুই॥ ১৪ জুলাই রোববার এই আন্দোলনের গতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট। ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেন সেই দুর্বিনীত উক্তি, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা কোটা পাবে না, তো রাজাকারের নাতি পুতিরা চাকরি পাবে?’ শেখ হাসিনার এই উক্তির প্রতিবাদে সেদিনই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সবগুলি হলে সাধারণ সমস্ত ছাত্রদের গগনবিদারী শ্লোগান উচ্চারিত হয়। শ্লোগানটি ছিলো, ‘তুমি কে আমি কে/ রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ ১৫ জুলাই সমস্ত হল কাঁপানো ছাত্রদের শ্লোগানের জবাবে তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের এবং ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন করেন সেই স্পর্ধিত উক্তি, ‘ছাত্রদেরকে ঠান্ডা করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট’। এরপর সেই ১৬ জুলাই। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের সামনে বুক পেতে দেন এবং শাহাদত বরণ করেন। আবু সাঈদের শাহাদত বরণ ছিলো যেনো একটি স্ফুলিঙ্গ। এই স্ফুলিঙ্গ টেলিভিশনে দেখার পর মুহূর্তেই সেটি দাবানলের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আবু সাঈদের শাহাদত ছাত্র-জনতাকে এমনভাবে উজ্জীবিত করে যে, পরদিন ১৭ জুলাই ছাত্র-জনতা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমস্ত হল থেকে ছাত্রলীগের সমস্ত নেতাকর্মীকে পিটিয়ে বের করে দেয়। সমগ্র ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের অশুভ ছায়া থেকে মুক্ত হয়। ওইদিনই রাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে হুমকি-ধামকি দেন। শেখ হাসিনার এই রকম উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা সারাদেশে প্রতিবাদের এক নতুন পরিভাষা ঘোষণা করেন। সেটি হলো, কমপ্লিট শাট ডাউন। এই ঘোষণার পর সারাদেশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি মোতায়েন করা হয়। কমপ্লিট শাট ডাউনের ফলে সারাদেশে ব্যাপক সংঘর্ষ হামলা, গুলি, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনী নামানো হয় এবং দেশে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। একই সাথে সারাদেশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়। ২০ জুলাই শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে পুলিশ তুলে নেয়। ২৩ জুলাই মঙ্গলবার নতুন কোটা ব্যবস্থার গেজেট নোটিফিকেশন হয়। ওইদিন রাত থেকে সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁঈয়া, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশিদের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ জুলাই ২০২৪। আন্দোলন দমনে সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে। এজন্য তারা সমগ্র ঢাকা মহানগরীকে কয়েক ভাগে ভাগ করে ব্লক রেইড দেয়। নাম জানা অথবা না জানা ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে সরকার ৫৫৫টি মামলা দায়ের করে। ওইদিনই ৩ ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁঈয়া এবং আবু বাকের মজুমদারকে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। পরদিন ২৭ জুলাই শনিবার আরো ২ ছাত্রনেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সারজিস আলমকে গ্রেফতার করে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। ১ জুলাই থেকে সারাদেশে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। ২৭ জুলাই পর্যন্ত গ্রেফতার হন ৯ হাজার ১শত ২১ জন ছাত্র-জনতা। পরদিন ২৮ জুলাই আরেক জন ছাত্রনেতা নুসরাত তাবাস্সুমকে গ্রেফতার করে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। ১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হয়। ॥তিন॥ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রতিদিন সরকারের কঠোর দমননীতির ফলে প্রতিদিনই একাধিক ব্যক্তি শহীদ হন। আর প্রতিটি শহীদের পবিত্র রক্ত থেকে জন্ম নেয় অসংখ্য লড়াকু ছাত্র। অবশেষে ২৯ জুলাই ২০২৪ সোমবার আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত ও শিবির নিষিদ্ধ করা হয়। ৩০ জুলাই সকল ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙে রঞ্জিত করা হয়। ২ আগস্ট শুক্রবার শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করা হয়। ৩ আগস্ট সমস্ত আন্দোলনকারীর পক্ষ থেকে নাহিদ ইসলাম আন্দোলনের একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আর সেটি হলো শেখ হাসিনার পদত্যাগ। সাথে সাথে সারাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে সারাদেশ প্রকম্পিত করে। ৪ আগস্ট ছাত্রদের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচির প্রথম দিনে সারাদেশে সর্বাত্মক কর্মসূচি এবং সারাদেশ মিছিলের দেশে পরিণত। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হেলমেট বাহিনীর হামলা এবং প্রায় ১শত ছাত্র-জনতার শাহাদাত বরণ। এই ৪ আগস্টেই পূর্ব নির্ধারিত মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৬ আগস্টের বদলে ৫ আগস্ট এগিয়ে আনা হয়। ৫ আগস্ট লক্ষ-কোটি মানুষের বহুপ্রতীক্ষিত সেইদিন। সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ্জামান ঘোষণা করেন যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। জেনারেল ওয়াকার উজ্জামান আরো ঘোষণা করেন যে, একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হচ্ছে। ॥চার॥ এই হলো রক্তক্ষয়ী জুলাই অভ্যুত্থানের সংক্ষিপ্ততম টাইম লাইন। এই আন্দোলন প্রথমে সরকার পতন আন্দোলন ছিলো না। ছিলো কোটাবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে লৌহ কঠিন হস্তে মোকাবেলার জন্য শেখ হাসিনা পর্যায়ক্রমে আওয়ামী ঘরানার সমস্ত হেলমেট বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সেনাবাহিনী নামায়। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেলে আন্দোলনকে আর কোটা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় না। জনসাধারণের বিপুল সম্পৃক্তি এবং সহ¯্রাধিক ছাত্রজনতার ফিনকি দেওয়া তাজা রক্ত আন্দোলনকে এক দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনার অপসারণের দাবিতে পর্যবসিত হতে বাধ্য হয়। বস্তুত ২৯ জুলাই থেকেই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমন্বয়করা ঘোষণা করেন যে, এখন আর এই আন্দোলন আর শেখ হাসিনার পতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। লক্ষ-কোটি জনতা আন্দোলনে যোগদানের ফলে জনতার নতুন অভিপ্রায় প্রকাশিত হলো। সেটা হচ্ছে, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ যাবে, কিন্তু সেই অভিশপ্ত চন্ডালরূপী সরকার অর্থাৎ নাৎসিবাদী স্বৈরাচার যেনো আর ফিরে না আসে। এজন্য চাই একটি ফুলপ্রুফ রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্ত। জুলাই অভ্যুত্থানের নায়করা পরিষ্কার ঘোষণা করেন যে, ২শত বছর ধরে ভারতে ব্রিটিশ এবং হিন্দুরা মুসলমানদের বঞ্চিত করেছে। এই বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে জনগণ পাকিস্তান কায়েম করেছে। পাকিস্তান কায়েমের পর শাসক গোষ্ঠি আমজনতার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি আনতে পারেনি। তাই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমে শেখ মুজিব এবং পরে শেখ হাসিনা সেই আমজনতার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির বদলে তাদের ভারতীয়দের গোলামে পরিণত করেছে এবং দেশে তাদের ওপর জুলুমের জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। সেই জগদ্দল পাথর অপসারণ করে ৪৭ ও ৭১ এ লক্ষ-কোটি জনতার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির দাবিতে ২০২৪ এর জুলাই ও আগস্ট মাসে সাধিত হয়েছে জুলাই বিপ্লব। এখন তাই জুলাই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হলো (১) ভারতীয় গোলামী থেকে মুক্তি (২) শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনার মতো নিকৃষ্ট কিন্তু দানবীয় নাৎসিবাদীর সরকার যেনো ফিরে আসতে না পারে তার জন্য ফুলপ্রুফ গ্যারান্টি যুক্ত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত (৩) কল্যাণবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম এবং (৪) ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে দেশের ৯২ শতাংশ মানুষের তাহজিব ও তমুদ্দনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি বিনির্মাণ।
Email:[email protected]