দুর্লভ খনিজে চীনের আধিপত্য (বৈদ্যুতিক যান, ইলেকট্রনিক পণ্য, টারবাইন ও প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম তৈরির জন্য অপরিহার্য উপাদান) দীর্ঘদিন ধরে ভারতের জন্য একটি কাঠামোগত দুর্বলতা হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু এখন নয়াদিল্লি এখন সেই দুর্বলতাকে কৌশলগত সুবিধায় রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর ভারত সফরে বেইজিং ভারতের বিরল খনিজের চাহিদা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ঘোষণা এসেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা সম্মেলনে (৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর) ঠিক আগে, আর এ বছরের শেষ দিকে কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজনের প্রাক্কালে।

বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই জোটের সঙ্গে এ কূটনৈতিক তৎপরতা দেখায় যে ভারত কীভাবে দ্বৈত মঞ্চ ব্যবহার করে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে আপস না করেই সরবরাহশৃঙ্খলের ক্ষেত্রে তাদের ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। এটি যতটা ভারতের কূটনৈতিক উদ্যোগ, ঠিক ততটাই এসসিও সম্মেলনের আগে চীনের দিক থেকে উত্তেজনা প্রশমনের কৌশল। চীনের দিক থেকে এটি মোটেই কাঠামোগত বিষয় নয়; বরং তাৎক্ষণিক কৌশলগত হিসাব।

২০২৫ সালের শুরুর দিকে চীন সাত ধরনের বিরল খনিজ রপ্তানি লাইসেন্সের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ চালু করে। এতে ভারতের শিল্পমহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। দেশটির শিল্পমালিকের সতর্ক করে দেন যে, এতে করে বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। সব মিলিয়ে চীনের বিধিনিষেধে ভারতের শিল্প বিকাশ ও সবুজ প্রযুক্তির আকাঙক্ষা বাস্তবায়নে বিরল খনিজের গুরুত্ব যে সীমাহীন সেটা স্পষ্ট।

বেইজিংয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসে ভারত দর–কষাকষির জায়গা তৈরি করে নেয় এবং চীনকে কিছুটা নমনীয় হতে বাধ্য করে। যদিও পর্যবেক্ষকেরা সতর্ক করেছেন, এসব প্রতিশ্রুতি তখনই কার্যকর হবে, যখন রপ্তানি লাইসেন্স লাইসেন্সের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য আসবে।

এদিকে ভারত বিরল খনিজে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। জুন মাসে দেশটির ভারী শিল্প মন্ত্রণালয় স্থানীয়ভাবে বিরল খনিজ উৎপাদনে আর্থিক সহায়তা ও মজুত গড়ে তোলার জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করে। এর উদ্দশ্য হলো চীন থেকে আমদানি করা বিরল খনিজের মূল্যের ব্যবধান কমানো। অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওডিশায় নতুন বিরল খনিজ অনুসন্ধান প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে।

এটি শুধু নীতি পরিবর্তন নয়, ভারতের ভূরাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রমাণ। ভারত চায় চীন কিংবা পশ্চিমাদের ওপর নির্ভর না করে শিল্প ভবিষ্যৎ নিজস্ব শর্তে নির্ধারণ করতে। তবে ভারতের জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা হচ্ছে, দেশি বিরল খনিজের ইকোসিস্টেমটা দ্রুত গড়ে তোলা, যাতে চীনের সদিচ্ছার ওপর দেশটির নির্ভরতা কমানো যায়।

বিশ্বের প্রধান দুটি কৌশলগত জোটে সদস্যপদ থাকার কারণে ভারতের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত নিয়ে গঠিত কোয়াড জোটে যুক্ত হয়ে নয়াদিল্লি সরবরাহশৃঙ্খলের নিরাপত্তা ও উন্নত প্রযুক্তি সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। গত জুলাইয়ে কোয়াড পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এ লক্ষ্য পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

এর বিপরীতে এসসিও সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের উপস্থিতি দেশ দুটির সঙ্গে ভারতের টেকসই সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আনে। তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত এসসিও সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে ভারত যে বাস্তব সমস্যা সমাধানে বহুপক্ষীয় চ্যানেল ব্যবহার করতে আগ্রহী, সে ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছে।

এসসিও জোটের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও কোয়াডের মাধ্যমে প্রযুক্তি অংশীদারিত্ব শক্তিশালী করা—এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে ভারত একটি বাস্তবসম্মত কূটনীতি পরিচালিত করছে। বিশ্বের খুব কম মধ্যম শক্তিই এ বাস্তবসম্মত পথ অনুসরণ করতে পেরেছে।

এই দ্বৈতপথ কোনো বিরোধপূর্ণ অবস্থান নয়; বরং এটি পরিকল্পিত। ভারত কোয়াডের মাধ্যমে চীনের সরবরাহশৃঙ্খলের বিকল্প পথ খুঁজছে আর দেখায়, আবার এসসিওর মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি সুবিধা আদায় করছে।

বিরল খনিজের সরবরাহশৃঙ্খলে যদি আরও বিঘ্ন সৃষ্টি হয়, ভারত আরও বেশি করে কোয়াড অংশীদার হবে এবং দেশি সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে। অন্যদিকে যদি কোয়াডের কার্যক্রম স্থবিরতা নেমে আসে, তাহলে এসসিও জোটের কাছ থেকে সুবিধা নিতে পারবে। তবে সন্দেহবাদীরা সতর্ক করেছেন, চীন যদি নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করে এবং কোয়াড অংশীদারেরা যদি তাদের কাজ বাস্তবায়নে ধীর হয়ে যায়, তাহলে ভারতের কূটনীতি অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়বে। তবে একাধিক বিকল্প রেখে ঝুঁকি কমানোর কৌশল ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের পথেরই অনুসরণ।

ভারত সম্ভাব্য সংকটকে কূটনৈতিক সুবিধায় পরিণত করেছে। এসসিও জোটে যাওয়া, দেশি উৎপাদন এবং কোয়াডের মাধ্যমে ভারত তার বিরল খনিজের দুর্বলতা মোকাবিলা করতে চায়।

এটি শুধু নীতি পরিবর্তন নয়, ভারতের ভূরাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রমাণ। ভারত চায় চীন কিংবা পশ্চিমাদের ওপর নির্ভর না করে শিল্প ভবিষ্যৎ নিজস্ব শর্তে নির্ধারণ করতে। তবে ভারতের জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা হচ্ছে, দেশি বিরল খনিজের ইকোসিস্টেমটা দ্রুত গড়ে তোলা, যাতে চীনের সদিচ্ছার ওপর দেশটির নির্ভরতা কমানো যায়।

মানিশ বৈদ্য ভারতের অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে জুনিয়র ফেলো

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো