৬ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘পৃথিবীর সব সরকারের ভেতরে সরকার থাকে, যাকে “কিচেন ক্যাবিনেট” (যাঁদের প্রভাব বেশি) বলা হয়। তবে সরকারের বাইরের কেউ সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে না।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতি ও কার্যক্রম মূল্যায়নসংক্রান্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। তাঁর এ মন্তব্য নতুন কোনো তথ্য নয়; বরং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি পুরোনো বাস্তবতাকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। এটা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটা ক্ষুদ্রাকার, কিন্তু অন্যদের থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী বা এন্টিটির অস্তিত্বের প্রকাশ্য স্বীকৃতি।

বাংলাদেশে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছোট একটি গোষ্ঠীর প্রভাব বহুবার দেখা গেছে। বিএনপি আমলে ‘হাওয়া ভবন’ ছিল এর প্রতীকী উদাহরণ। যদিও সেটি আনুষ্ঠানিক সরকারি কার্যালয় ছিল না। অভিযোগ ছিল, সেখান থেকেই অনেক বড় সিদ্ধান্ত আসত।

শেখ হাসিনার সময়েও একই ধরনের অভিযোগ শোনা গেছে। তিনি পুরো মন্ত্রিসভাকে নয়; বরং কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও প্রভাবশালী আমলা-ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। যেকোনো স্বৈরশাসকের জন্য এ ধরনের চর্চা অস্বাভাবিক লাগে না। এ অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের বলে যে সরকারের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে সব সময়ই আরও একটি অদৃশ্য কাঠামো সক্রিয় থাকে।

কেন এ ধরনের অদৃশ্য সরকার বা কিচেন ক্যাবিনেট তৈরি হয়? প্রথমত, ক্ষমতার এলিটরা আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষেত্রকে ধীরে ধীরে নিজেদের দখলে নেন। তাঁরা অর্থ, ব্যবসা, আমলাতন্ত্রের ও রাজনীতির জটিল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের নানা দেশেও এ প্রবণতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বহুল আলোচিত ‘আয়রন ট্রায়াঙ্গল’, যেখানে বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী, কংগ্রেসের কিছু সদস্য ও প্রভাবশালী আমলা মিলে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন। অস্ত্রশিল্পের লবিস্টরা, কংগ্রেসম্যানরা ও প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা মিলে বহু বছর ধরে বন্দুক আইন কঠোর করার প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছেন, যদিও জনমত তার বিপরীত ছিল। ভারতের ইতিহাসেও নেহরু-ইন্দিরা আমল থেকে ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর উল্লেখ আছে, যেখানে আনুষ্ঠানিক মন্ত্রিসভাকে পাশ কাটিয়ে ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করতেন।

প্রশ্ন হলো, কেন এ ধরনের অদৃশ্য সরকার বা কিচেন ক্যাবিনেট তৈরি হয়? প্রথমত, ক্ষমতার এলিটরা আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষেত্রকে ধীরে ধীরে নিজেদের দখলে নেন। তাঁরা অর্থ, ব্যবসা, আমলাতন্ত্রের ও রাজনীতির জটিল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন। ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধি বা মন্ত্রীদের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্র সংকীর্ণ হয়ে কেবল প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে চলে যায়, তখন সেখানে সাধারণ নাগরিকের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়ে। তাঁদের ভোট দেওয়ার বাইরে আর কোনো সক্রিয় ভূমিকা থাকে না। এ প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায় আর নাগরিকেরা নিজেদের রাষ্ট্র থেকে দূরে অনুভব করেন।

দ্বিতীয়ত, এ অস্বচ্ছ ব্যবস্থা কেন টিকে থাকে, তার উত্তর খুঁজতে হলে রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকটি দেখতে হবে। কিচেন ক্যাবিনেটের ভেতরে থাকা এলিটরা একটি পারস্পরিক স্বার্থ-জোট গড়ে তোলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য এটি সুবিধাজনক। কারণ, তাঁরা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার জটিলতা এড়িয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সরকারি কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ীদের জন্য এটি লাভজনক। কারণ, তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে সরকারি নীতিকে নিজেদের পক্ষে ঘোরাতে পারেন। এ প্রণোদনার কাঠামো এমনভাবে কাজ করে যে প্রত্যেকে কিছু না কিছু সুবিধা পান, আর পুরো ব্যবস্থাটি টিকে থাকে। জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হলেও এলিটদের জন্য এটি কার্যকর। তাই পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ করা হয় না। এ কারণেই এক সরকারের পতনের পরও আরেক সরকার একই রকম অনানুষ্ঠানিক বলয় গড়ে তোলে।

কিন্তু এর ফল সুদূরপ্রসারী। যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আসল কেন্দ্র আড়ালে থাকে, তখন স্বচ্ছতা হারিয়ে যায়। জনগণ বোঝেন না কেন কোনো আইন হলো বা হলো না। সংসদ দুর্বল হয়ে পড়ে, মন্ত্রিসভা কেবল আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায় এবং দুর্নীতির জন্য উর্বর মাটি তৈরি হয়। একদিকে এলিটরা লাভবান হন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ সেবা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকেন।

এ পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রশ্ন নতুন করে উঠে আসে। উদাহরণস্বরূপ, দেখা গেল সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হঠাৎই চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। অথচ বন্দরটি কোনো বড় সংকটে ছিল না, পরিচালনায় বড় ধরনের অভিযোগও ছিল না কিংবা জনমতের কোনো প্রবল দাবিও ছিল না। তাহলে কেন এমন একটি স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, যার ফলে জনবিক্ষোভের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে?

এর উত্তর খুঁজতে হবে সরকারের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে নয়; বরং সেই অঘোষিত কিচেন ক্যাবিনেটের ভেতরে? একইভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনসহ ১১টি সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যেই কয়েক শ সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে অনেক সুপারিশ ছিল এমন, যা নির্বাহী আদেশেই সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু আজও সে সুপারিশগুলোর বেশির ভাগ আলোর মুখ দেখেনি। কেন এ স্থবিরতা? এটাও কি কিচেন ক্যাবিনেটের পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়?

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরপ্রক্রিয়ায় তাই অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো এ সংস্কৃতি ভাঙা। আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংসদ, মন্ত্রিসভা, স্থানীয় সরকার—আবারও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে ফিরতে হবে। বড় সিদ্ধান্তগুলোকে জন–আলোচনার মধ্যে আনতে হবে, আইন ও নীতির খসড়া নাগরিকদের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে, আর তথ্য অধিকারকে কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। যদি মানুষ জানে, তাঁদের মতামত সত্যিই গুরুত্ব পাচ্ছে, তবে অদৃশ্য ক্ষমতার বলয় নিয়ে হতাশা বা গুজবের জায়গা কমে যাবে।

কাজী মারুফুল ইসলাম অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, প্রথম আলো