ইসরায়েল তার দখলদারি আর জাতিগত নিধনের ইতিহাসজুড়ে বারবার একই কৌশল ব্যবহার করেছে। সেগুলো হলো মিথ্যা বলা, সত্য অস্বীকার করা এবং প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা।

এই মিথ্যাচার শুধু ইসরায়েল একা করে না। পশ্চিমা দেশগুলো অনেক সময় তাকে সহযোগিতা করে। আর বিশ্ব গণমাধ্যম ইসরায়েলি মিথ্যা ভাষ্য নির্দ্বিধায় ছাপিয়ে দেয়। ফলে এসব মিথ্যা একসময় ‘সত্য’ হিসেবে জায়গা করে নেয়।

গাজায় খাবার বিতরণকেন্দ্রে সম্প্রতি যা ঘটেছে, তা এই মিথ্যাচার ও বর্বরতার আরেকটি ভয়াবহ উদাহরণ। ১ জুন ভোরে রাফা শহরে খাবার সংগ্রহের লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। ইসরায়েল সঙ্গে সঙ্গে এর দায় অস্বীকার করে বলে, তারা কোনো গুলির খবর জানে না।

কিন্তু যেসব মানুষ সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছেন; যেসব মানবিক সংগঠন সেদিন সেখানে কাজ করছিল এবং যেসব চিকিৎসক সেখানকার আহত মানুষদের চিকিৎসা দিয়েছেন, তাঁরা সবাই বলেছেন, ঘটনাটি ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার কারণেই ঘটেছে।

ইসরায়েলের এই অস্বীকারকে সরাসরি সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এটিকে ‘ভুয়া সংবাদ’বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এটি নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০২৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আটা নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালিয়েছিল ইসরায়েলি সেনারা। সে ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ১১২ জন। আহত হয়েছিলেন ৭৬০ জনের বেশি। তখনো ইসরায়েল বলেছিল যে মানুষ হুড়োহুড়ি করে চাপা পড়ে মারা গেছে। অথচ ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, সেনারাই গুলি চালাচ্ছিল।

গাজায় এখন শুধু খাবার সংগ্রহই নয়, অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক, এমনকি শিশুদেরও নিশানা বানাচ্ছে ইসরায়েল। সম্প্রতি তারা এক চিকিৎসক দম্পতির বাড়িতে হামলা চালায়। তাতে তাঁদের ১০ সন্তানের মধ্যে ৯ জনই মারা যায়। তাঁদের একমাত্র জীবিত শিশুপুত্র আদমের অবস্থাও সংকটাপন্ন।

একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে খান ইউনিসে। ইসরায়েল বলেছে, তারা ‘সন্দেহভাজনদের’ ওপর হামলা করেছে। অথচ সেই হামলায় নিহত হন আটজন চিকিৎসাকর্মী, ছয়জন বেসামরিক নিরাপত্তাকর্মী এবং একজন জাতিসংঘ কর্মী। পরে মরদেহগুলো বালুর নিচে পুঁতে ফেলা হয়।

ইসরায়েলের দিক থেকে বলা হয়েছিল, একটি অ্যাম্বুলেন্সকে সন্ত্রাসীদের বহনকারী গাড়ি মনে করে হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু ভিডিও থেকে সে দাবিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়। প্রতিবারের মতো তখনো ইসরায়েল ‘ভুল হয়ে গেছে’, ‘দুঃখজনক সিদ্ধান্ত’, ‘তদন্ত হচ্ছে’ ইত্যাদি বলে ঘটনার দায় এড়িয়ে গেছে। জীবন ধ্বংস করার পর এ কেমন দায়মুক্তি?

২০২৪ সালের এপ্রিলে ইসরায়েল সাতজন মানবিক ত্রাণকর্মীকে হত্যা করেছিল। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছিল। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই হোয়াইট হাউস জানিয়েছিল, তারা ‘ইচ্ছাকৃত’ হত্যার প্রমাণ পায়নি। এভাবে গণহত্যা একটি নীরব সরকারি বিবৃতির পাদটীকায় নেমে আসে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালে বিস্ফোরণে প্রায় ৫০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল সঙ্গে সঙ্গে এটিকে ‘ফিলিস্তিনিদের রকেটের ভুল’ বলে অস্বীকার করেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তেলআবিবে গিয়ে সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করেন। কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে তোলা বহু ভিডিও, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও স্বাধীন প্রতিবেদন ভিন্ন কথা বলে।

আরও আগে ২০২২ সালে ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইসরায়েল প্রথমে বলেছিল, শিরিন ‘ফিলিস্তিনিদের গুলিতে’ মারা গেছেন। ভিডিও দিয়ে তারা তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। পরে শিরিনকে ইসরায়েলি সেনাদের হত্যা করার এত শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া যায় যে ইসরায়েল ‘ভুল হয়েছে’ বলতে বাধ্য হয়।

শিরিনকে হত্যা করা ইসরায়েলি সেনার বিচার তো হয়ইনি; বরং তিনি ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি পান এবং নির্ভয়ে অভিযান চালাতে থাকেন। পরে খবর অবশ্য পাওয়া যায় যে তিনি জেনিনে লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েল শুধু যুদ্ধাপরাধ করছে না, এই অপরাধ ঢাকতে তারা ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা বলছে। আর বাকি বিশ্ব তা চুপচাপ সহ্য করছে। এই দায়মুক্তি শুধু সামরিক নয়, এটি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং তথ্যগত দায়মুক্তি। মিথ্যা বলাকে তারা একটা শিল্পে পরিণত করেছে। এর শিকড় জায়নবাদী ভাবনার শুরু থেকে ছড়িয়ে রয়েছে।

আসলে এই যুদ্ধে গাজার শিশুদের মতো সত্যও মরে যাচ্ছে। সত্যকে যাদের রক্ষা করার কথা, সেসব গণমাধ্যম ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অনেকেই এখন ইসরায়েলের মিথ্যাচারের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে।

গাজার মানুষ শুধু গুলি ও বোমায় মারা যাচ্ছেন না, তাঁরা মুছে যাচ্ছেন আমাদের স্মৃতি থেকে, আমাদের খবর থেকে, এমনকি আমাদের বিবেক থেকেও। যতক্ষণ না বিশ্ব (বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো) ফিলিস্তিনিদের জীবনকে ইসরায়েলি ‘মিথ্যা বয়ানের’ চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাববে, ততক্ষণ এই রক্তক্ষয়ী নাটক চলতেই থাকবে।

ইসরায়েল শুধু যুদ্ধাপরাধ করছে না, এই অপরাধ ঢাকতে তারা ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা বলছে। আর বাকি বিশ্ব তা চুপচাপ সহ্য করছে। এই দায়মুক্তি শুধু সামরিক নয়, এটি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং তথ্যগত দায়মুক্তি। মিথ্যা বলাকে তারা একটা শিল্পে পরিণত করেছে। এর শিকড় জায়নবাদী ভাবনার শুরু থেকে ছড়িয়ে রয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এই মিথ্যাচারকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। তারা গাজায় অবরোধ, অনাহার ও গণহত্যাকে মেনে নিয়েছে। ইসরায়েল বারবার মিথ্যা বলছে। কারণ, তারা জানে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা কেবল তা সহ্যই করবে না; বরং পৃষ্ঠপোষকতা দেবে।

এই ব্যবস্থা শুধু নীরব সহমত নয়; এটি কার্যত ইসরায়েলের অপরাধের অংশীদার। তারা চায় না সত্য প্রকাশ পাক। কারণ, একবার যদি সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে নৈতিক জবাবদিহি, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকারের মূল্যবোধ—সবকিছুর সামনে তাদের নিজেদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।

আর যত দিন এই বৈশ্বিক কাঠামো মিথ্যার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থাকবে, তত দিন ইসরায়েলের রক্তাক্ত মঞ্চে মৃত্যুর প্রদর্শনী চলতেই থাকবে।

জামাল কানজ একজন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান লেখক, প্রকৌশলী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো