ইতালির বর্তমান সরকার দেশটির ইতিহাসে অন্যতম ইসরায়েলপন্থী সরকার। তাই ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইডো ক্রোসেত্তোর সাম্প্রতিক বক্তব্য ইসরায়েলিদের, বিশেষ করে ইসরায়েল সরকারের ভেতরের মানুষদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে ধরা উচিত।

লা স্টাম্পা পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্রোসেত্তো সরাসরি ইসরায়েলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই নিরীহ মানুষ মারার অজুহাত আর হতে পারে না। তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমাদের এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যা নেতানিয়াহুকে সংঘাত থামাতে বাধ্য করবে।’ তাঁর মতে, ‘সে পদক্ষেপগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নয়; বরং নিজেদের জনগণকে এমন এক সরকার থেকে রক্ষা করার উপায়, যে সরকার ভালোমন্দ বিবেচনার বোধ ও মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছে।’

ক্রোসেত্তোর এ বক্তব্য একদম সঠিক। গাজার যুদ্ধ শুধু ফিলিস্তিনিদের ওপর নয়; বরং ইসরায়েলের অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক অবস্থানের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। যদি এখনই দিক পরিবর্তন না করা হয়, তাহলে নেতানিয়াহুর নীতি ইসরায়েলকে কয়েক দশকের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে করে দিতে পারে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তর গাজায় অনেক মানুষ (কমপক্ষে পাঁচ লাখ) এখন তীব্র খাবারের সংকটে ভুগছেন, যা একেবারে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি। ইসরায়েল জুলাই মাসে যে ‘মানবিক শহর’ বানানোর কথা বলেছিল, সেটা আসলে গাজাবাসীদের জোর করে সীমাবদ্ধ জায়গায় আটকে রাখার পরিকল্পনা। এরপর আগস্টে তারা গাজা সিটি দখল করে আরও মানুষকে জোর করে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসব দেখে বোঝা যাচ্ছে, গাজার মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হতে চলেছে।

নেতানিয়াহুর সরকার এ ধ্বংসাত্মক পথে এগিয়ে চলেছে। কারণ, তাঁর নিজের রাজনৈতিক মঞ্চে টিকে থাকা এ যুদ্ধের ওপর নির্ভর করছে। দুর্নীতির মামলাগুলোতে দুর্বল হয়ে পড়া নেতানিয়াহু ক্ষমতায় টিকে থাকতে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নিয়েছেন। এ মনোভাব তাঁর জোট সরকারের সবচেয়ে চরমপন্থী সদস্যদের প্রভাব বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খোলাখুলি বলছেন, গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের বড় আকারে উচ্ছেদ করতে হবে। তাঁদের কাছে দুর্ভিক্ষ ও বাস্তুচ্যুতি অনিচ্ছাকৃত পরিণতি নয়; বরং এটি তাঁদের লক্ষ্য।

গাজার মানুষদের বাঁচাতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশের অভ্যন্তরে প্রবল চাপের মুখে পড়া ইউরোপ চুপ থাকবে না। ইসরায়েলের ওপর ‘টার্গেটেড’ নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। এতে ইসরায়েলের সঙ্গে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ইসরায়েলের সমৃদ্ধিশালী প্রযুক্তি খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা তহবিল বিপদের মুখে পড়বে।

চলমান ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া শুধু নৈতিক বিপর্যয় নয়, এর গভীরতর প্রভাবও আছে। সম্প্রতি ২৪ জন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ (যাঁদের মধ্যে ১১ জন নোবেলজয়ী) নেতানিয়াহুকে এক খোলাচিঠিতে বলেছেন, ইসরায়েল নিজের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনছে।

গাজার মানুষদের বাঁচাতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশের অভ্যন্তরে প্রবল চাপের মুখে পড়া ইউরোপ চুপ থাকবে না। ইসরায়েলের ওপর ‘টার্গেটেড’ নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। এতে ইসরায়েলের সঙ্গে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ইসরায়েলের সমৃদ্ধিশালী প্রযুক্তি খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা তহবিল বিপদের মুখে পড়বে।

এখনই ঋণমান হ্রাস শুরু হয়েছে, ঋণের সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে এবং দক্ষ ইসরায়েলিরা বড় সংখ্যায় দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত কারণে এ খরচের কিছুটা বহন করতে চাইতে পারে, তবু এটা পরিষ্কার যে নেতানিয়াহুর নীতির কারণে ইসরায়েলের অর্থনীতি দীর্ঘ বছর ধরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে পারবে না।

১৯৮২ সালে ইসরায়েল-লেবানন যুদ্ধের পরিণতির মতোই, গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করলে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভবত অতিরিক্ত কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ বহন করতে হবে।

প্রথমত, ইসরায়েলকে অবশ্যই গাজার মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসাসহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু গাজায় খাবারের পরিমাণ পাঠানো নয়; বরং মানুষের হাতে পৌঁছাচ্ছে কি না এবং কার্যকরভাবে বিতরণ হচ্ছে কি না, সেটিই হবে এর মাপকাঠি।

দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলকে অবশ্যই গাজাবাসীর শিবিরে জোর করে স্থানান্তরের পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে।

তৃতীয়ত, ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় সশস্ত্র সংঘর্ষের সময়ও মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হবে। সবশেষে ইসরায়েলকে একটি সত্যিকারের যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নিতে হবে, যা জিম্মিদের মুক্তি এবং যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে।

পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের জন্য ইসরায়েলের ওপর কূটনীতি, অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা।

এরান ইয়াশিভ তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

দানিয়েল সিদ্দন তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

সূত্র, প্রথম আলো