আমাদের দেশের বর্তমান তরুণ সমাজ অত্যন্ত স্মার্ট, সচেতন দূরদর্শী সম্পন্ন ও নেতৃত্ব দানের উপযোগী। তারা পুরাতন ঘুণে ধরা পচা-দুর্গন্ধ সময়কে নতুন করে কাছে টানতে চায় না।
আমাদের দেশের বর্তমান তরুণ সমাজ অত্যন্ত স্মার্ট, সচেতন দূরদর্শী সম্পন্ন ও নেতৃত্ব দানের উপযোগী। তারা পুরাতন ঘুণে ধরা পচা-দুর্গন্ধ সময়কে নতুন করে কাছে টানতে চায় না। তরুণরা চায় ঐক্যের রাজনীতি চায়। বাংলাদেশ আজ এক নতুন অধ্যায়ে এসে অবস্থান করছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর আমরা এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি। যেখানে থাকবে না কোনো হত্যা, সন্ত্রাস, খুন, গুম, হয়রানি, রাহাজানি, ভেদাভেদ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। যেখানে থাকবে না বিভেদ ও অনৈক্যের রাজনীতি। থাকবে শুধু দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক পরিবর্তন। এমন কোনো রাজনৈতিক চর্চা থাকবে না, যা আমাদের তরুণ প্রজন্ম চায় না। যা আমাদের জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির অন্তরায় হয়ে যায়। তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে-অনৈক্য ও বিভেদপূর্ণ রাজনীতির সংস্কৃতি। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারীর দাবিদার একটি রাজনৈতিক দল অনেক আগে থেকেই দেশবাসীকে বারবার বিভেদের রাজনীতির চর্চা করে এসেছে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের গল্প শুনিয়ে আসছে। এসব বিভেদপূর্ণ রাজনীতির গল্প এখন জনগণ আর শুনতে চায় না। কারণ আমাদের তরুণরা বিভেদপূর্ণ রাজনীতি পছন্দ করে না। ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক মহল সবসময় বিভেদের রাজনীতির সংস্কৃতি চর্চা করেছে। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বৈরি মনোভাব সৃষ্টি করতে জনগণকে উসকে দিয়েছে বারংবার। তাদের একটিই উদ্দেশ্য, ইসলাম এবং ইসলামী আন্দোলনমুখী সংগঠনগুলোকে কোণঠাসা করে রাখা, যাতে করে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।
বিগত টানা সাড়ে ১৫ বছর একই গীত গাওয়া হয়েছে। বিভাজনের এ সঙ্গীত দেশে এমনই একটি বাস্তবতা তৈরি করেছিল যেখানে ভিন্নমত পোষণ, গঠনমূলক সমালোচনা কিংবা বিকল্প রাজনৈতিক চেতনার অস্তিত্বও নিয়মিতভাবে অস্বীকার করা হতো। দেশের মানুষ টাটকা খাবার পছন্দ করে। পচা খাবার নয়। একইভাবে পুরাতন দিনের ঘটনাপ্রবাহকে সামনে এনে দেশকে পিছনের দিকে ঠেলে দিতে চায় না। কবি নজরুলের ভাষায়; “বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে; বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি হাদিস ও ফিকাহ চষে”। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ উক্তিটি সত্যিকার অর্থে প্রণিধানযোগ্য। বিশ্বের প্রতিটা দেশ যখন নিজ নিজ উন্নতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে উন্নত থেকে উন্নততর অবস্থা তৈরির কাজে গোটা জাতিকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের একটি ধর্মবিরোধী সেক্যুলার মহল ১৯৭১-কে নগ্নভাবে সামনে এনে কুরুচিপূর্ণ মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। এটিকে সামনে এনে তারা দেশকে ৫৪ বছর পেছনে ফেলে দিতে চায়। এরা দেশের প্রকৃত বন্ধু নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চিরশত্রু। তারা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রকাশ্য দুশমন! তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী সময় থেকে বিভক্তির রাজনীতি ও ইসলামের প্রতি দুশমনি শুরু করেছে। তবে বিষয়টি অতিরিক্ত ডাইমেনশন পর্যায়ে চলে যায় যখন আওয়ামী লীগ ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ’ নাম দিয়ে নতুন করে ট্যাগিংয়ের রাজনীতি করতে শুরু করে। এ ধরনের বিভাজন সৃষ্টিকারী গীত বা শ্লোক রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য সময়বিশেষে কার্যকর হতে পারে, কিন্তু সবসময় নয়। এগুলো সচেতন জনগণ এখন তোয়াক্কা করে না। জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকই সেদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সমান অংশীদার। ইতিহাসের দায়-দায়িত্ব যেমন সকল জনগণের ওপর বর্তায়, তেমনি ভবিষ্যতের স্বপ্নও সবার জীবনের অংশ, জনগণের পরিশ্রমের ফসল। এককভাবে কোনো দল বা রাজনৈতিক পরিবারের নয়। সচেতন জনগণকে শ্রদ্ধার সাথে মনে রাখতে হবে যে, ধর্মহীনতায় বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দলের বিভাজনমুখী কৌশলের কারণেই বিগত দেড় দশকে গণতন্ত্র সংকুচিত হয়েছে এবং মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিরোধী মত দমন করা হয়েছে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। মিডিয়ার স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। মানুষের অধিকার রক্ষায় সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র সবসময় পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে। স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ নামে জাতিকে বিভাজিত করা হয়েছে। এ বাস্তবতায় স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের গান হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দমননীতির একটি মূলমন্ত্র ও যুদ্ধের হাতিয়ার। কিন্তু ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর জনগণ আর এ গান শুনতে চায় না। জনগণ চায় একটি সমৃদ্ধশালী উন্নত নতুন বাংলাদেশ গড়তে। আওয়ামী লীগের প্রতিভূরা যদি বর্তমানে ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার বাইরে থেকে পুরাতন ঘিতে আগুন ঢেলে প্রজ¦লিত করতে চায়, দেশের যুবসমাজ তা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করবে। এছাড়া ক্ষমতার লোভে পাগলপারা একটি দল একই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে তারা ইসলামী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, দাঙ্গাহাঙ্গামা চালিয়ে যাচ্ছে, শিবিরের ওপর হামলা করছে, জামায়াতের ওপর হামলা করছে। যা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বর্বরতাকে হার মানায়।
আমাদের তরুণ সমাজ এ ধরনের বিভাজন ও হিংসার রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের একপেশে উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতে শুনতে তারা যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, একইভাবে ক্ষমতার আকাক্সিক্ষত দলটিও অসভ্য আচরণ করছে। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম সকল দলের অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক শাসন দেখতে চেয়েছিল। তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখের ফেনা নয়, মুখের বুলি নয়, গানের চরণ নয়, বক্তৃতা ও জিগির নয়, তারা চায় সত্যিকার সমাজ বিনির্মাণ করতে, তারা চায় সত্যিকার কাজের বাস্তব প্রমাণ উপস্থাপন করতে। তরুণদের কাছে দেশপ্রেম মানে শুধু গলাবাজি নয়, দেশপ্রেম মানে জনগণকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা নয়, দেশপ্রেম মানে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, দেশপ্রেম মানে অর্থ পাচার নয়। বরং দেশপ্রেম মানে দেশের জন্য সৎভাবে, দক্ষভাবে কাজ করা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা। দেশের প্রকৃতি, পত্র-পল্লব সবকিছুকে সমানভাবে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা। আওয়ামী লীগ সে প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে পারেনি বলেই গত বছর জুলাই-আগস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। জুলাই বিপ্লব চলাকালে আওয়ামী বিরোধী সকল মঞ্চ, সকল প্লাটফর্ম একই ব্যানারের আওতায় চলে এসেছিল। স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত করতে দল-মত, পেশা, ধর্ম, বর্ণ সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেছে। যার ফলে জাতি একটি জগদ্দল পাথরকে জাতির বুকের ওপর থেকে সরাতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বিপ্লবের দীর্ঘ ৯ মাস পর আমরা আবারও অভিনব কায়দায় বিভেদের রাজনীতির আভাস দেখতে পাচ্ছি। নানামহল থেকে সুপরিকল্পিত উপায়ে ভাঙনের রাজনীতির ছন্দময় সুর ব্যঞ্জনায় তরঙ্গের সৃষ্টি করা হচ্ছে। এমনকি সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার চেষ্টায় বিভেদের রাজনীতির ঢোল পিটানো হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলে যারা জনগণকে আশান্বিত করেছিল, তারা আবার পাকিস্তানপন্থি আর বাংলাদেশপন্থি রাজনীতি বলে দেশ এবং জাতিকে খণ্ড-বিখণ্ড করার অপচেষ্টা করছে। এটিকে বলা যায়, আওয়ামী আমলে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ সারেগামার লেটেস্ট ভার্সন। এ ভার্সনকে কাজে লাগিয়ে ঐ গোষ্ঠী এখন নতুন ধান্দায় মগ্ন। এ ধরনের ধান্দা বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জাতিকে আরো বেশি বিভক্ত ও দুর্বল করে তুলবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। সম্প্রতি আ’লীগ কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত আসার পরপরই এ ধরনের বিভাজনের সুর বেশি ওঠায় অনেকেই এর নেপথ্যে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে আশংকা করছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলছেন; পুরাতন আগুনে নতুন করে ঘি ঢাললে আগুনের ডাইমেনশন আরো প্রদীপ্ত হবে। ফলে দেশের উন্নয়ন এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ৫০ বছর পিছিয়ে যাবে।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এমতাবস্থায় সচেতন ও দায়িত্বশীল শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, শ্রমিক, ছাত্র, খেটে খাওয়া মানুষ প্রতিটি মহলের উচিত আওয়ামী লীগের মতো বিভেদপূর্ণ রাজনীতির পালাগান থেকে বেরিয়ে আসা। ইতিহাসের দায় যথার্থভাবে পালন করা। কিন্তু সেটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন বিরোধী মতকে দমন করার চেষ্টা এখন আর কারো কাম্য নয়। রাজনীতি হবে মত ও পথের ভিন্নতা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলার সংস্কৃতি। সেখানে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে দেওয়া বা পাকিস্তানপন্থি, জঙ্গীপন্থি আখ্যা দেওয়া সঙ্গত নয়। জাতিকে বিভেদপূর্ণ রাজনীতির দিকে নিক্ষেপ করা আত্মঘাতী যুদ্ধের শামিল। বিভাজনের রাজনীতির পরিণতি সম্পর্কে আমরা অতীতে যা দেখেছি তা সমর্থনযোগ্য নয়। সহিংসতা, নির্বাচন বর্জন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি, আইনের অপব্যবহার, দিনের ভোট রাতেই সম্পন্ন করার সংস্কৃতি, বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ইত্যাদি ঘটেছে।
সুতরাং এসব অসাধু রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের প্রয়োজন রাজনীতির অঙ্গনে একটি মৌলিক পরিবর্তন আনা। এ লক্ষ্যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরো গতিশীল করতে হলে, সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হলে, রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী করতে হলে ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সাসটেইনেবল করতে হলে বিভেদের রাজনীতি পরিহার করা এবং ঐক্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা এখন আমাদের তরুণ সমাজের অপরিহার্য দাবি। দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে তরুণদের এ দাবি উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
লেখক : শিক্ষাবিদ।